StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

গুপ্ত যুগের নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো

 

গুপ্ত যুগের নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো। গুপ্ত যুগের নারীদের অবস্থা ।

ভূমিকা : 

যে-কোনো যুগের সমাজের প্রকৃত চেহারা বা অনুপুঙ্খ বিবরণ পেতে গেলে সেই সংশ্লিষ্ট যুগের নারীর অবস্থান ও মর্যাদা কেমন ছিল তা বোঝা জরুরি। কেননা নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের চিন্তা অকল্পনীয়। কন্যা, মাতা ও জায়া হিসাবে নারীর অস্তিত্ব আবহমানকাল ধরে বিরাজিত। গুপ্তযুগও এর ব্যতিক্রম নয়। পূর্ববর্তী কয়েকটি অনুচ্ছেদে গুপ্তযুগে বিবাহ ব্যবস্থা সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন আলোচনা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নারীদের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে তৎকালীন নারীর অবস্থান ও মর্যাদার সামাজিক ও প্রকৃত চিত্র উদ্‌ঘাটিত হয় না।

ভারতবর্ষের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বরাবরই নারীদের পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকার চিত্রটি পরিষ্কার। বিশেষ করে গুপ্তযুগ তথা প্রাচীন ভারতে এর কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় না। গুপ্ত আমলের সমাজে মনুসংহিতার অনুশাসনই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছিল। কিছু পরিবর্তন অবশ্য ঘটেছিল। বাৎস্যায়নের কামসূত্র (খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতক), বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা, (খ্রিস্টীয় পঞ্চম ষষ্ঠ শতক)-বৃহস্পতি ও কাত্যায়ন স্মৃতি এবং এ যুগের সাহিত্য বিশেষ করে কালিদাসের কাব্য ও নাটক থেকে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা লাভ করা সম্ভব।

গুপ্ত যুগের নারীদের অবস্থা :

গুপ্তযুগে সামগ্রিকভাবে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে অবিবাহিতা, বিবাহিতা এবং বিধবা অবস্থায় নারীর চিত্রটি তুলে ধরা বাঞ্ছনীয় হবে। বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্রে অভিজাত বংশের কন্যাদের শাস্ত্রানুশীল এবং চৌষট্টি কলা বা কাজে পারদর্শিতার ওপর জোর দিয়েছেন। এই চৌষট্টিটি কলা সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণও তিনি দিয়েছেন। (১.৩.১৬)। ঐ চৌষট্টি কলায় জ্ঞানলাভের জন্য তার শিক্ষিকা হিসাবে তার সেবিকা বা সেবিকার কন্যা, বিশ্বস্ত একজন সহচরী, একজন বয়স্কা পরিচারিকা-র কথা বাৎস্যায়ন উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন শব্দের ধাঁধার সমাধান, বই থেকে কোনো বিষয়ে আবৃত্তি করা, অসমাপ্ত কোনো স্তোত্রের সমাধান এবং ছন্দ ও শব্দার্থ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন প্রভৃতি এই চৌষটি কলা (অঙ্গবিদ্যা)-র অন্তর্ভুক্ত ছিল। কামসূত্রে বর্ণিত অভিজাত কুমারীদের শিক্ষার ব্যাপারে বাৎস্যায়ন নির্দেশিত এই ব্যবস্থা আদর্শ ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণিত হলেও বাস্তবে তা কতখানি কার্যকরী হত সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এছাড়া গুপ্তযুগের সাহিত্য থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে উচ্চ বংশের কন্যারা প্রাচীন ইতিহাস ও কিংবদন্তী সম্পর্কে পড়াশোনা করত এবং অনেক ক্ষেত্রে স্তোত্র রচনাও করত। এমনকি উচ্চবংশের কন্যারা ও রাজদরবারে বসবাসকারী কন্যারা নাচ-গান, চিত্রকলা, কাব্য রচনা প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করত।

কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকে ইতিহাস সংক্রান্ত ব্যাপারে অনসূয়ার জ্ঞানলাভের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এছাড়া ঐ নাটকের চতুর্থ অঙ্কে অনসূয়ার চিত্রকলা ও অঙ্কন সংক্রান্ত জ্ঞানের কথা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। কিছুটা পরবর্তীকালের রচনা বাণভট্টের হর্ষচরিতে’র চতুর্থ অঙ্কে নাচ-গান ও অন্যান্য শিল্পে রাজকুমারী রাজ্যশ্রীর দৈনন্দিন জ্ঞান বৃদ্ধির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। গুপ্তযুগের রচনা অমরসিংহের অমরকোষ-এ ‘উপাধ্যায়া’ ও ‘উপাধ্যায়ী’ শব্দগুলির উল্লেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে সে যুগে মহিলাদের মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রথা প্রচলন ছিল। ঐ গ্রন্থে বৈদিক মন্ত্রের শিক্ষিকা হিসাবে আচার্য-র উল্লেখও আছে।

পূর্ববর্তী যুগে প্রচলিত নারীর মর্যাদা গুপ্তযুগে কমবেশি পরিমাণে প্রচলিত ছিল এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসাবে সম্পত্তির ওপর নারীদের অধিকারের কথা বলা যেতে পারে, যা কাত্যায়ন স্মৃতিতে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া গুপ্তযুগে ভারতবর্ষে মহিলারা শাসনকার্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে গুপ্ত শাসক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা ও বাকাটক বংশের রানী প্রভাবতী গুপ্তার কথা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে। তৎকালীন শিলালেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে প্রভাবতী গুপ্তা তাঁর নাবালক পুত্রের অভিভাবক হিসাবে বাকাটক রাজ্য শাসন করেছিলেন।

গুপ্তযুগে আদর্শ স্ত্রীর এক সুন্দর প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্রে’। আদর্শ বা গুণবতী স্ত্রীর কর্তব্য কর্ম সম্পর্কে তিনি এক বিস্তৃত তালিকা দিয়েছেন (৪.১.১-৫৫)। বাৎস্যায়ন লিখেছেন যে একজন আদর্শ স্ত্রী তাঁর স্বামীকে দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করবে। তার যাবতীয় সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সদা সর্বদা দৃষ্টি রাখবে। স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন ব্রত ও উপবাস পালন করবে। কেবলমাত্র স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষেই সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উৎসব ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করবে। কোনো অসৎ বা দুঃশ্চরিত্রা মহিলাদের সঙ্গে সে কখনও মেলামেশা করবে না। স্বামীর বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি যতটা সম্মান দেখানো দরকার তা সে কার্পণ্য করবে না।

স্বামী যদি কখনো প্রয়োজনের তাগিদে প্রবাসী হয় তাহলে কেবল তারই প্রতীক্ষায় আদর্শ ও সংযত জীবনযাপন করা তার কর্তব্য। এছাড়া, আদর্শ স্ত্রীর যে চিত্র তিনি এঁকেছেন তাতে দেখা যায় যে তাকে সত্যিকারের সুশিক্ষিতা হতে হত এবং সংসারের বাৎসরিক আয় ব্যয়ের হিসাব তৈরি করতে হত। সবচেয়ে বড় কথা হল সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব আদর্শ স্ত্রী-র ওপরেই আরোপ করেছেন বাৎস্যায়ন। এক জায়গায় তিনি বলেছেন (৪.১.২৭-২৯), জিনিসপত্রের দাম কম হলে যথোপযুক্ত সময়ে সেগুলি কিনে সংসারের খরচকে সীমিত রাখার দায়িত্ব তার কাজ। এই সমস্ত জিনিসপত্রের মধ্যে মাটির পাত্র, ঝুড়ি, লবণ, তেল, ঘি, এমনকি শস্যবীজ প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বামী ছাড়াও শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি সেবাপরায়ণতা আদর্শ স্ত্রীর অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে বাৎস্যায়ন নির্দেশ দিয়েছেন। বড়ির দাসদাসীদের নিযুক্ত করা, তাদের কাজকর্ম দেখাশোনা করা, গৃহ পরিচ্ছন্ন রাখা তার কর্তব্য বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

বাৎস্যায়নের প্রায় অনুরূপ চিত্র পাওয়া যায় কাত্যায়ন স্মৃতিতে। কাত্যায়ন ঘোষণা করেছেন যে স্ত্রী কখনো তার স্বামীকে পরিত্যাগ করবে না। সে সর্বদাই তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে ও সেবা করবে। স্বামীর মৃত্যুর পর পবিত্র জীবনযাপন করা তার অন্যতম কর্তব্য। ঐ যুগের সাহিত্যেও এর প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। এ-প্রসঙ্গে কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কথমুনির আশ্রম থেকে কন্যা শকুন্তলাকে বিদায়ের মুহূর্তে কথ তাকে আশীর্বাদ করার সময় যেসব উপদেশ দিচ্ছেন তা হল— “গুরুজনদের শুশ্রূষা করো, সপত্নীদের সঙ্গে প্রিয় সখীর মতো আচরণ করো। স্বামী রেগে গেলে তুমি কখনো রেগে তার বিরুদ্ধ আচরণ করো না….। এই পথেই নারীরা গৃহিণী পদ প্রাপ্ত হয়, এর অন্যথা যারা  করে তারা বংশের ব্যাধিস্বরূপিণী” (৪/১৮)।

পিতৃকুলে নারী পিতার কাছে গচ্ছিত স্বামীর সম্পত্তি; বিবাহের পরে স্বামীর ব্যক্তিগত এবং শশুরকুলের পরিবারগত সম্পত্তি; নিজের ওপরে তার কোনো অধিকার নেই। প্রায় এই ধরনের কথাই উচ্চারিত হয়েছে কণ্ঠমুনির শিষ্য শাঙ্গরবের মুখে। রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে পরিত্যাগ করার পর শাঙ্গরব দুষ্মন্তকে বলছে, “একে পরিত্যাগ-ই করুন, আর গ্রহণই করুন, এ হল আপনার স্ত্রী ; স্ত্রীর ওপরে স্বামীর সর্বতোমুখী প্রভুত্ব আছে” (৫/২৬)। শাঙ্গরবের এই উক্তি নিশ্চিতভাবে শুধু গুপ্তযুগ নয়, পরবর্তী বহু শতক ধরে বিরাজমান । কারণ ভরণপোষণের জন্য নারী স্বামীর ওপরে নির্ভরশীল। এককথায়, স্ত্রীর খাওয়া পরার বিনিময়ে স্বামী তার ওপর যথেচ্ছ প্রভুত্ব আরোপ করতে পারে এই বিষয়টি ঐ উক্তি থেকে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

গুপ্তযুগেরই রচনা বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় নারীর অবস্থান সম্পর্কে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। নারীদের সম্পর্কে বরাহমিহির অনেকটা ‘উদার’। বৃহৎসংহিতায় (৭৪.৫-১৬) বলা হয়েছে, নারী তথা স্ত্রী জাতির ওপরেই নির্ভর করে ধর্ম তথা অর্থ। তারা গৃহের লক্ষ্মী। তাদের প্রতি সর্বদা সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। তিনি আরো বলেছেন, স্ত্রী জাতির কাছ থেকেই পুরুষেরা সত্যিকারের সুখ সমৃদ্ধি লাভ করে। এরপর তিনি সেই সমস্ত মনীষী ও স্মৃতিশাস্ত্রকারদের নিন্দা করেছেন, যাঁরা পার্থিব কিছু সুখ-সুবিধার দিকে তাকিয়ে স্ত্রী জাতির দোষত্রুটি উদ্ঘাটি করে যান, অথচ তাদের গুণ সম্পর্কে নীরব থাকেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই ঘোষণা করেন, প্রকৃতপক্ষে পুরুষের তুলনায় নারীর মধ্যে বেশি গুণ নিহিত। যুক্তিস্বরূপ তিনি বলেছেন যে, স্ত্রীদের সাংসারিক কাজে ব্যবহার করে পুরুষরা গৌরব বোধ করে। কিন্তু স্ত্রীদের মৃত্যুর পর তারা তাদের সম্পর্কে কোনো কথাই বলে না। অপরদিকে স্বামীর মৃত্যুর পরেও স্ত্রীরা তাকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে, এমনকি অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জনও দেয়।

স্বামীর প্রতি স্ত্রীর নির্ভরতা অথবা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রভুত্ব সত্ত্বেও গুপ্তযুগ তথা প্রাচীন ভারতের স্মৃতিশাস্ত্রকাররা কিছু সুযোগ-সুবিধা দানের কথা বলেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল স্ত্রীধন। স্ত্রীধন হল নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সাধারণভাবে নারীর দামী অলংকার ও পোশাককে স্ত্রীধন বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যাজ্ঞবল্ক্য ও নারদ স্মৃতিতে বলা হয়েছে যে বিরুদ্ধ কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেও নারীরা তাদের স্ত্রীধন থেকে বঞ্চিত হত না। স্ত্রীর মৃত্যু হলে ঐ সম্পত্তি তার কন্যা সন্তানরা পাওয়ার অধিকারী ছিল। অপরদিকে, স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরের বিনা অনুমতিতে বিধবা স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করলে স্ত্রীধন থেকে বঞ্চিত হত।

গুপ্তযুগে অবশ্য সামাজিক কিছু নিন্দনীয় বা কুপ্রথার পূর্বতন প্রচলন শিথিল হয়ে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে নিয়োগ প্রথা’র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। স্বামী  হীনবীর্য হলে অথবা স্বামীর মৃত্যু হলে তার ভাই বা কোনো নিকট আত্মীয় পুরুষ (‘নিয়োগিন’)-কে সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করার প্রথাকে নিয়োগ প্রথা বলে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রথা ঋগ্-বৈদিক যুগ থেকে চলে আসছিল (১০.৪.২)। কৌটিল্য (৩.৬.২৪), বৌধায়ন (২.৪.৯-১০), যাজ্ঞবল্ক্য (১.৬৮-৬৯) নারদ (১২. ৮০.৮১) প্রমুখ স্মৃতিশাস্ত্রকাররাও এই প্রথার উল্লেখ করেছেন। তবে গুপ্তযুগের অন্যতম স্মৃতিগ্ৰন্থ বৃহস্পতিস্মৃতিতে এই ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে এবং তা নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে (২৫.১২.১৪)। উল্লেখ্য, তৎকালীন বাস্তব পরিস্থিতি এই ধরনের সামাজিক কুপ্রথা নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।

গুপ্তকালীন সমাজে নারীদের বিধবা অবস্থার চিত্র সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এক্ষেত্রে বিধবা-বিবাহ ও সতীদাহ প্রথা এই দুটি বিষয় সংক্রান্ত আলোচনায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যেতে পারে। বৈধব্য জীবনে নারীদের কঠোর সংযমের মধ্যে চলার বিধান নির্দেশিত হয়েছে এযুগের ও সমকালীন স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে। পুত্রহীনা বিধবার স্বামীর সম্পত্তির ওপর উত্তরাধিকারের কথা ঘোষিত হয়েছে যাজ্ঞবক্ষা, বিষ্ণু ও কাত্যায়ন স্মৃতিতে। এমনকি কিছু স্মৃতিশাস্ত্র ও এই যুগের অন্যান্য গ্রন্থে বিধবা বিবাহের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। অমরসিংহের অমরকোষে (২.৬.২৩) কেবল ‘পুনর্ভু’ (পুনর্নির্বাহিতা বিধবা) ও তার স্বামীর উল্লেখ আছে তাই নয়, ঐ বিধবাকেই পরবর্তী স্বামীর প্রধানা স্ত্রী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কাত্যায়ন কোনো বিধবা নাবালক অথবা সাবালক পুত্রের অশ্রদ্ধার পাত্রী হলে তাঁর পক্ষে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের পরামর্শ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে ঐ বিধবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে এ ব্যাপারে অবশ্য একটু ভিন্ন কথা বলা হয়েছে। তিনি ‘পুনর্জ’ (পুনর্বিবাহিতা বিধবা)-কে বিবাহিতা স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা দানের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন।

গুপ্তযুগের সমাজে সতীদাহ প্রথার অস্তিত্ব ছিল না, এমন কথা বলা যাবে না। তবে তখন এর প্রচলন কতটা ছিল এবং তা কতখানি সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সতীদাহের প্রথম নিশ্চিত প্রমাণ গুপ্তযুগেই পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ৫১০ খ্রিস্টাব্দের এরান শিলালেখর কথা উল্লেখ করা যায়। ঐ লেখতে বিধৃত হয়েছে যে গুপ্তরাজ ভানুগুপ্তের সহযোগী হিসাবে তার সামস্ত প্রধান গোপরাজ এক ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ঐ যুদ্ধে গোপরাজ নিহত হন এবং তাঁর স্ত্রী আত্মাহুতি দেন। সুতরাং গুপ্তযুগে সতী হবার এটি একটি আকর উপাদান এবং যে ক্ষুদ্র স্তম্ভে এটি বিস্তৃত হয়েছে সম্ভবত তা এই ঘটনারই স্মারক।” এ-যুগের অন্যতম স্মৃতিশাস্ত্রকার বৃহস্পতি বিধবাদের সতী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

বরাহমিহির তাঁর বৃহৎসংহিতায় (৭৪.১৪.১৬) সতীপ্রথার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সতীপ্রথার ব্যাপক প্রচলন বোধহয় সে যুগে ছিল না। এক্ষেত্রে সাধারণত দুটি কারণ দেখানো যেতে পারে। প্রথমত, আগের অনুচ্ছেদে স্মৃতিগ্রন্থগুলিতে বিধবাদের বৈধব্য জীবনে কঠোর সংযম অনুসরণ করার কথা আলোচিত হয়েছে। যদি সতীদাহ প্রথার প্রচলন থাকবে তাহলে কঠোর বৈধব্য জীবনের প্রশ্ন ওঠা কিছুটা অবান্তর। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের একটি সামাজিক ব্যাধির যদি বহুল প্রচলন থাকত তাহলে চীনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণে তা স্থান পেত। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসাই স্বাভাবিক হবে যে সতীদাহ প্রথার প্রচলন গুপ্তযুগে থাকলেও তা ছিল সীমিত।

গুপ্ত তথা প্রাচীন ভারতের সমাজে এমন কিছু নারী ছিল যাদের পারিবারিক সম্পর্কের দ্বারা কোনো শ্রেণীভুক্ত করা যায় না। গণিকা, দেবদাসী প্রভৃতি এই পর্যায়ে পড়ে। বস্তুত, পরিবারের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যখন কোনো নারী অন্য পুরুষকে অর্থ বা বস্তু প্রাপ্তির বিনিময়ে দেহদান করে তখনই সে গণিকা বলে চিহ্নিত হয়। গুপ্ত যুগের সাহিত্যে গণিকার অনেক প্রতিশব্দ পাওয়া যায় যেমন কুলটা, রূপাজীবা, বারস্ত্রী, বারবনিতা প্রভৃতি। বাৎস্যায়নের কামসূত্র এবং গুপ্তযুগের অন্যান্য গ্রন্থ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় গণিকার স্থান সবচেয়ে ওপরে। রূপে, যৌবনে, শিক্ষাদীক্ষায় সেই শ্রেষ্ঠ (কামসূত্র ১.৩.২০)। তার নীচে রূপাজীবা শিক্ষাদীক্ষা, রূপযৌবন, ধনসম্পদ ও সামাজিক প্রতিপত্তিতে গণিকার তুলনায় নীচে বিরাজ করত। সমাজে গণিকার প্রথম অপরাধ হল যে সে তার রূপে, গুণে, শিক্ষাদীক্ষায় কুলপুত্রকে প্রলুব্ধ করে এবং দ্বিতীয় অপরাধ হল সে নানা কৌশলে কুলপুত্রের অর্থ শোষণ করে।

কামসূত্র থেকে বোঝা সম্ভব হয় নাগরক বা ধনী অভিজাত নগরবাসীর জীবনে গণিকাদের বিশেষ প্রয়োজন হত। কিন্তু সমাজে তার পাওনা ছিল অবিমিশ্র ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য। গণিকার কন্যারা ‘গণিকা’ ও পুত্ররা ‘বন্ধুল’ বলে চিহ্নিত হত। গুপ্ত যুগেরই রচনা শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকে খুবই করুণভাবে বন্ধুলরা তাদের আত্মপরিচয় দিয়েছে। এছাড়া ঐ নাটকেরই নায়িকা বসন্তসেনা রূপযৌবন, শিক্ষাদীক্ষা, রুচি ও চরিত্রে মহানুভবতা সত্ত্বেও গণিকাবৃত্তি ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রাথমিক প্রচেষ্টায় যথেষ্ট সামাজিক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিল। শেষপর্যন্ত নিজের পছন্দমতো যোগ্য ব্যক্তিকে সে বিবাহ করতেও পেরেছিল। কিন্তু প্রাথমিক পর্বে বসন্তসেনা যখন এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বেশ বিব্রত তখন তার অনুচর বিট তাকে বারেবারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে যদিও সে উজ্জয়িনীর নগরলক্ষ্মী বলে পরিচিত তথাপি সে শ্মশানের জুঁই গাছের ফুলের মতো কোনো শুভকাজে লাগে না । তার পছন্দ অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা বলে কিছু থাকতে পারে না। বলাবাহুল্য, বসন্তসেনার মতো উচ্চপর্যায়ের গণিকার চিত্র যদি এই হয়, তাহলে তৎকালীন সমাজে গণিকারা সাধারণভাবে কীভাবে বিবেচিত হতেন তা সহজেই অনুমেয়। 

গণিকাদের মতো না হলেও পারিবারিক সম্পর্কহীন সমাজের আরো এক শ্রেণীর নারীর উল্লেখ পাওয়া যায় গুপ্ত ও সমকালীন যুগের সাহিত্যে। এরা দেবদাসী নামে পরিচিত। ভারতীয় মন্দিরে দেবদাসী রাখার প্রচলন বহুকালের। কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে (স্তবক ৩৫) উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে দেবদাসীদের নৃত্যের উল্লেখ করেছেন।

মূল্যায়ন :

গুপ্তযুগের অবসানের অল্পকাল পরে এদেশে আগত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণে সিন্ধু দেশের পূর্বে অবস্থিত একটি শহরের সূর্যমন্দিরে দেবদাসীদের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং সামাজিক দিক বিচার করে বলা যায় যে, পুরোপুরি মানুষের মর্যাদা না পাওয়াই ছিল গুপ্তযুগের সমাজের নারীর যথার্থ চিত্র।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *