গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ কর।গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো ।
১) গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বিচারব্যবস্থা। গুপ্ত বিচারব্যবস্থায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করতেন রাজা স্বয়ং। বৃহস্পতি ও যাজ্ঞবন্ধ্য স্মৃতিশাস্ত্রে এই যুগের বিচার পদ্ধতি সংক্রান্ত বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায়। রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চে রাজা অধিষ্ঠিত হলেও এবং তাঁর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হলেও বৃহত্তর সাম্রাজ্যের বিচারব্যবস্থা কেবলমাত্র তাঁর দ্বারাই পরিচালিত হত না।
২) জেলা ও প্রাদেশিক শহরগুলিতে আদালত ছিল। অনেক ক্ষেত্রে গিল্ড বা নিগমগুলিও বিচারকার্য সমাধা করত। সাম্রাজ্যের রাজধানীতে অবস্থিত বিচারালয়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর মনোনীত বিচারপতি বিচারকার্য সম্পাদন করতেন।
৩) নালন্দা ও বৈশালীর অভিজ্ঞান মুদ্রাগুলি থেকে বোঝা যায় যে গিল্ডগুলির নিজস্ব সীলমোহর ছিল। এছাড়া, তীরভুক্তির শাসন আলোচনা প্রসঙ্গে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বিনয়স্থিতিস্থাপক নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন, যাঁদের কাজ ছিল ন্যায়নীতি রক্ষা করা। এমনকি, এদের নিজস্ব কার্যালয়ও ছিল। ‘বিনয়স্থিতি স্থাপকাধিকরণসা’ শব্দগুলি থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়ে থাকে।
৪) বিচারের ধরন কেমন ছিল অর্থাৎ বিচারের মান কঠোর না লগ্ন ছিল সে সম্পর্কে দেশীয় সাহিত্যিক ও শিলালৈখিক উপাদানগুলি প্রায় নীরব। এ ব্যাপারে আমাদের একান্তভাবে নির্ভর করতে হয় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে এদেশে আগত এবং উত্তর ভারতে ভ্রমণরত চীনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে মধ্যরাজ্য (মথুরার পূর্ব ও দক্ষিণের মধ্যবর্তী অঞ্চল)-এর বিবরণ দিতে গিয়ে চীনা পর্যটক তাঁর প্রদত্ত বিবরণের এক জায়গায় লিখেছেন, “… মৃত্যুদণ্ড প্রথা ব্যতিরেকে এদেশের রাজা তাঁর রাজ্য শাসন করেন। অপরাধের তারতম্য অনুসারে অপরাধীকে লঘু ও গুরুদণ্ড দেওয়া হয়। এমনকি যারা কঠোর রাজদ্রোহী তাদের কেবলমাত্র ডান হাত কেটে ছেড়ে দেওয়া হয়।”
৫) ফা-হিােনের বিবরণে ফৌজদারি আইনের উদারতার বিষয়টি স্থান পেয়েছে। এ-প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইউ. এন. ঘোষালের বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেছেন যে গুপ্তযুগের আগে বিশেষ করে মৌর্যযুগে কিংবা তারও আগে থেকে দীর্ঘকাল ধরে ভারতে গুপ্তচর ব্যবস্থা ও অপরাধীদের কঠোর শাস্তিদানের প্রথা বলবৎ ছিল। কিন্তু ফা-হিয়েন প্রদত্ত বিবরণ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের সংস্কারমূলক পরিবর্তন ঘটিয়ে গুপ্ত শাসকেরা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন।
৬) বিচারব্যবস্থা তথা শান্তি রক্ষার এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। এই সাফল্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের বিবরণে। তাঁর বিবরণ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে, সমগ্র “মধ্যরাজ্য” জুড়ে গুপ্ত শাসকেরা শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কেননা, নিঃসঙ্গ একজন বিদেশীয় ভ্রমণকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সুদীর্ঘ যাত্রাপথে ফা-হিয়েন একবারও দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হননি। এছাড়া, মধ্যরাজ্য পাটলিপুত্রের অধিবাসীদের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন যে, তারা ছিল ‘সুখী’। মধ্যরাজ্যের বিবরণ প্রসঙ্গে তিনি আরো লিখেছেন, ‘এদেশের অধিবাসীরা যখন খুশি ও যেখানে খুশি চলে যেতে পারেন অথবা বাস করতে পারেন।’ ফা-হিয়েন প্রদত্ত এই সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে, গুপ্তযুগে মোটামুটিভাবে শান্তি বজায় ছিল। বস্তুতপক্ষে, মৌর্যযুগের ন্যায় পুলিশী নিয়ন্ত্রণ ও ফৌজদারি দণ্ডবিধির কঠোরতা ব্যতিরেকে গুপ্ত শাসকেরা তাঁদের প্রজাবর্গকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রদানে সক্ষম হয়েছিলেন।
৭) সাম্রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছাড়াও গুপ্ত শাসকরা কিছু উদারনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা গুপ্ত শাসনব্যবস্থার একটা অন্যতম দিক হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালের গোড়ায় ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম ভারতে প্রাচীন সুদর্শন হ্রদ (যা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রাদেশিক শাসক কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল)-এর সংস্কার সাধন করা হয়। স্কন্দগুপ্তের জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায় যে সুরাষ্ট্রের শাসনকর্তা পর্ণদত্ত এবং তার পুত্র চক্রপালিতের সক্রিয় উদ্যোগে এই বিরাট কাজ সুসম্পন্ন হয়েছিল। সুদর্শন হ্রদ পুনর্নির্মাণের এই বিষয়টি ছাড়াও গুপ্ত সম্রাটরা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করতেন। এলাহাবাদ প্রশস্তি-র আলোকে সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক এবং জুনাগড় লেখর আলোকে স্কন্দগুপ্ত কর্তৃক পরিদ্রদের প্রতি তাঁদের উদারতা প্রদর্শন ও কর্মকাণ্ডের বিষয়টি ইতিপূর্বে প্রসঙ্গ ক্রমে আলোচিত হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষার প্রসার ও ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা প্রসারের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী তপ্ত শাসকেরা নালন্দায় বেশ কিছু মঠ নির্মাণ করেছিলেন।
৮) গুপ্ত শাসকেরা প্রধানত তরবারি ও যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত রূপ দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক সংগঠনের ওপর তাঁরা যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেন। সাধারণভাবে শাসকেরা নিজেরাই সামরিক বাহিনীর শীর্ষে অধিষ্ঠিত থাকতেন। সামরিক বিভাগের বেশ কিছু কর্মচারীর নাম পাওয়া যায় বিভিন্ন শিলালেখ থেকে। এঁরা হলেন মহাদণ্ডনায়ক (প্রধান সেনাপতি), রণভাণ্ডাগারাধিকরণ (যুদ্ধ বিভাগের প্রধান কোষাধ্যক্ষের দপ্তর বা কার্যালয়), বলাধিকরণ (যুদ্ধদপ্তর)। এছাড়াও অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনী প্রভৃতি যে সমস্ত বাহিনী নিয়ে সেনাদল গঠিত হত সেই সমস্ত বিভাগের প্রধানদের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলি পরিচালিত হত। যেমন—মহাপিলুপতি (হস্তি বিভাগের প্রধান), মহাশ্বপতি (অর্থবিভাগের প্রধান) প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
৯) গুপ্তযুগে সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে সামরিক ক্ষেত্রে এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। ফা-হিয়েন তাঁর বিবরণের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘রাজার দেহরক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পেতেন।’ এই তথ্যের ভিত্তিতে ইউ. এন. ঘোষাল সিদ্ধান্তে এসেছেন যে সাম্রাজ্যবাদী গুপ্তরা মৌর্যদের ন্যায় তাদের সৈন্যদের একটা নির্দিষ্ট বেতন নিতেন। ফা-হিয়েনের প্রদত্ত এই বিবরণ অবশ্য পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা ঠিক হবে না। কেননা, এ যুগের বিভিন্ন শিলালেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে অনেক ক্ষেত্রে কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে জমি প্রদান করা হত। যাই হোক না কেন, এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে গুপ্তযুগের সামরিক বাহিনী ছিল বেশ দক্ষ। আর কিছু না হোক, অন্তত স্কন্দগুপ্তের সময় পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে গুপ্তশাসকেরা পরাজিত হননি।
১০) গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার আর এক বৈশিষ্ট্য ছিল রাজস্ব ব্যবস্থা। রাজস্ব ব্যবস্থা শাসনব্যবস্থার একটা অপরিহার্য অঙ্গ। গুপ্ত শাসনও এর ব্যতিক্রম নয়। গুপ্ত রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে এর পরবর্তী অধ্যায়ে। তাই এখানে প্রসঙ্গক্রমে দু-একটি বিষয় উল্লেখিত হল মাত্র। ভূমি রাজস্ব ছিল এযুগের অন্যতম প্রধান রাজস্ব। জমির মালিক কে ছিল এবং সর্বোপরি, কর ব্যবস্থা কেমন ছিল এ সব বিষয়গুলি বেশ বিতর্কিত।