StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা করো

 

গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা করো । সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব।

ভূমিকা : 

বিশ্ব ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন কিছু প্রতিভাবান শাসকের উদয় হয় যাঁরা নিজকর্মগুণে শুধু সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্য নয়, তৎকালীন রাজনীতি তথা সামগ্রিক ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনেন। এই কর্মধারাকে প্রধানত দুটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। একটি হল সংস্কারমূলক ধারা। যার মাধ্যমে কোনো শাসক তাঁর প্রতিভাকে বিচ্ছুরিত করতে পারেন। এই ধারার অন্যতম দৃষ্টান্ত হল মৌর্য সম্রাট অশোক, যিনি তাঁর মানবহিতৈষী কাজকর্মের সুবাদে মানুষের হৃদয়ে যথাযোগ্য স্থান করে নিয়েছেন। অপরটি হল কোনো শাসক কর্তৃক একের পর এক রাজ্যজয়ের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যের পরিধিকে বিস্তৃত করা এবং তারই সূত্র ধরে সমকালীন রাজনীতির ধারাবাহিকতাকে ভিন্নমুখী করা। অর্থাৎ প্রথমটিতে শাস্তি ও অহিংসার আদর্শ এবং দ্বিতীয়টিতে ঠিক এর বিপরীতভাবে রাজ্য জয় ও হিংসার নীতি প্রতিফলিত হয়।

প্রাচীনকালে এই শেষোক্ত ধারার অন্যতম ভারতীয় ব্যক্তিত্ব হলেন গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত। বস্তুতপক্ষে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন খ্যাতিমান শাসকের সন্ধান পাওয়া যায় যাঁরা বিজেতা হিসাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। এই অল্প কয়েকজন শাসকের মধ্যে অন্যতম হলেন সমুদ্রগুপ্ত।

সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব : 

সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার :

সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার সম্পর্কে জানার জন্য অন্যতম প্রধান উপাদান হল এলাহাবাদ প্রশস্তি। এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা একটু পরে হবে। এখন প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলার এরান (প্রাচীন ঐরিবিন)-এ সমুদ্রগুপ্তের একটি লেখ পাওয়া গেছে। এই লেখটিকেও তাঁর প্রশস্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই প্রশস্তিটির বেশিরভাগ অংশ ভেঙে গেলেও এর প্রাপ্তিস্থান থেকে বোঝা যায় যে এরান বা পূর্ব মালব অঞ্চল তাঁর অধিকারে এসেছিল। এছাড়া, জে. এফ. ফ্লিট ঐ লেখটির একটি অংশের অনুবাদ করে দেখিয়েছেন যে ঐরিবিন (এরান) ছিল এমন একটি প্রদেশ বা নগর যেখানে সমুদ্রগুপ্ত সময় অতিবাহিত করতেন এবং তা ছিল তাঁর নিজস্ব নগর (স্ব-ভোগ-নগর ঐরিকিন-প্রদেশ)।

এবার এলাহাবাদ প্রশস্তির কথায় আসা যাক।” তেত্রিশটি ছত্র বা পঙক্তি অথবা ১৭টি স্তবকের সমন্বয়ে এই প্রশস্তিটি লেখা হয়েছিল। লেখটি তারিখবিহীন এবং এর প্রথমদিকের বেশ কিছু অংশ ভেঙে গেছে। তথাপি সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য জয় ও সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে এই প্রশস্তিটির সাহায্য অপরিহার্য। বস্তুতপক্ষে এটি এমন একটি ঐতিহাসিক দলিল যার সাহায্য ছাড়া খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের ইতিহাস অনেকটাই আমাদের অজ্ঞাত থেকে যেত। উল্লেখ্য, ৩৫ ফুট উচ্চ এই প্রশস্তিটি অশোকের স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা হয়। অর্থাৎ শান্তিকামী অশোকের লিপি এলাহাবাদের যে স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা হয়েছিল, সেই স্তম্ভটিতেই সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই প্রশস্তিটি রচনা করেছিলেন মহাদণ্ডনায়ক ধ্রুবভূতির পুত্র হরিষেণ, যাঁর উল্লেখ রয়েছে এই প্রশস্তিটির একত্রিশ নং ছত্রে।

হরিষেণ অন্ততপক্ষে তিনটি পদ অলংকৃত করেছিলেন। এগুলি হল সান্ধিবিগ্রহিক (শান্তি ও যুদ্ধ বিভাগের মন্ত্রী), কুমারমাত্য এবং মহাদণ্ডনায়ক। খুব সম্ভবত তিনি সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে তাঁর সামরিক অভিযানে সঙ্গী হয়েছিলেন। এই কারণেই বোধহয় সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে তিনি বেশি ওশাকিবহাল হতে পেরেছিলেন। এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক যে হরিষেণের মতো পদাধিকারী একজন সভাকবি তাঁর প্রভু সম্রাটের কর্মকাণ্ডকে অতিরঞ্জিত করবেন। এর ফলে ঐ প্রশস্তিতে বর্ণিত সমস্ত ঘটনাবলীকে একেবারে নিখুঁত হিসাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। তবে এজন্য ভারতের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রশস্তিটিতে পরিবেশিত হয়েছে সেগুলিকে নগণ্য বলে এড়িয়ে যাওয়া মোটেই সমীচীন হবে না।

যাই হোক না কেন, এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের সামরিক প্রতিভা, রাজ্য জয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারের এক বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক দলিলটিতে যেভাবে তাঁর রাজ্য জয়ের তালিকা উদ্ধৃত হয়েছে তা ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে না রাজ্য জয়ের ক্রমপর্যায় অনুযায়ী—সে বিষয়ে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক বিরাজমান। হরিষেণ রচিত এই প্রশস্তিতে স্পষ্ট করে এ ব্যাপারে উল্লেখ না থাকায় ঐ বিতর্ক বেড়েছে। (পরবর্তী পর্যায়ে ‘সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবাদী নীতি’ এই শিরোনামে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে)। এছাড়া প্রশস্তিতে এমন কিছু শাসক ও জায়গার নাম উল্লেখিত হয়েছে যেগুলির সঠিক শনাক্তকরণও বেশ কষ্টসাধ্য। এই সমস্ত সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্রগুপ্তের মত বিশাল সামরিক প্রতিভার রাজ্য জয়ের ধারাবাহিক ক্রমপরম্পরাযুক্ত ও ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক বিবরণ উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এই কারণে এলাহাবাদ প্রশস্তিতে যেভাবে অভিযানগুলি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলিকে সেই অনুযায়ী একের পর এক নিন্মে তুলে ধরা  হলো। 

এলাহাবাদ স্তম্ভলেখটির প্রথমদিকের ছয়টি স্তবকের বেশ কিছু অংশ ভেঙে গেছে। যে অংশটি এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে তার ভিত্তিতে বোঝা যায় যে প্রথমদিকের এই অংশটিতে হরিষেণ তাঁর প্রভু সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের শিক্ষা, পাণ্ডিত্য, সিংহাসনের জন্য মনোনয়ন এবং পিতার জীবদ্দশায় বেশ কিছু যুদ্ধে যোগদান ও সাফল্য প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সপ্তম স্তবক থেকে তাঁর বিশাল সামরিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। সপ্তম স্তবকের কিছু অংশ ভেঙে গেলেও এর প্রথম অংশে কয়েকজন পরাজিত রাজার নাম আছে। এঁরা হলেন যথাক্রমে অচ্যুত, নাগসেন এবং ‘গ.’…..। এখানে ‘গ’-এর পরবর্তী অংশ ভেঙে গেলেও তিনি যে গণপতিনাগ সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। এই তিনজন রাজার পরাজয় সম্পর্কে প্রশস্তিটিতে ‘উমূল্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের উচ্ছেদ বা মূলোৎপাটন করেছিলেন। সপ্তম স্তবকের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে যে সমুদ্রগুপ্ত যখন পুষ্পনগরীতে আনন্দ উপভোগ করছিলেন তখন তাঁর সেনাদল কোটা পরিবারের এক রাজাকে পরাস্ত করেছিলেন।

সমুদ্রগুপ্তের সামরিক অভিযান  :

সামগ্রিকভাবে এলাহাবাদ প্রশস্তির সপ্তম স্তবক অর্থাৎ তের ও চোদ্দো নং ছত্র থেকে সমুদ্রগুপ্তের সামরিক অভিযান প্রসঙ্গে অচ্যুত, নাগসেন, গণপতিনাগ ও কোটা পরিবারের ওপর তাঁর আক্রমণ হানা ও সাফল্যের যে বিষয়টি জানা গেল এখন সে সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথম তিনজন পরাজিত শাসকের নামের সঙ্গে যেহেতু রাজবংশের কোনো উল্লেখ করা হয়নি; সেহেতু তাঁদের শনাক্তকরণের ব্যাপারে পণ্ডিতমহলে মতানৈক্য আছে। এই মতানৈক্যের মধ্য থেকেই একটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা নেওয়া হবে। এখানে এক এক করে ঐ রাজাদের শনাক্তকরণ সংক্রান্ত আলোচনা করা হল।

অচ্যুত

‘অচ্যু’ নামাঙ্কিত কতকগুলি তাম্র মুদ্রা পাওয়া গেছে অহিচ্ছত্রে (বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বেরিলি জেলার রামনগর)-এ। মুদ্রাগুলি আনুমানিক খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের। ই. জে. র‍্যাপসন ও ভিনসেন্ট স্মিথ মুদ্রাগুলি পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উল্লেখিত অচ্যুত ও মুদ্রায় অচ্যু নামাঙ্কিত রাজা ছিলেন এক ও অভিন্ন। সুতরাং, সিদ্ধান্ত হল এই যে অচ্যুত সেই সময় অহিচ্ছত্রে শাসন করছিলেন। র্যাপসন ও স্মিথের এই শনাক্তকরণই প্রায় সমগ্র পণ্ডিত মহল গ্রহণ করে থাকেন।

নাগসেন

নাগসেনের উল্লেখ আছে কিছুটা পরবর্তীকালের রচনা বাণভট্টের হর্ষচরিতে। সেখানে বলা হয়েছে যে নাগবংশ জাত নাগসেন পদ্মাবতী (বর্তমান মধ্যপ্রদেশের নরওয়ারের পঁচিশ মাইল উত্তর-পূর্বে পদম পাওয়া)-তে শাসন করতেন। ই. জে. র‍্যাপসন এলাহাবাদ উগুলেখর নাগসেন-কে হর্ষচরিতে উল্লেখিত পদ্মাবতীর নাগসেনের সঙ্গে শনাক্ত করেছেন। এই মতই সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

গণপতিনাগ

গণপতিনাগের শনাক্তকরণের ব্যাপারে সাধারণত দুইটি মত প্রদান করা হয়ে থাকে ৷ একটি মত হল, তিনি মথুরায় শাসন করতেন। অপর মতটি হল তিনি বেসনগর বা বিদিশার শাসক ছিলেন। বেসনগরে তাঁর নামাঙ্কিত কয়েকটি মুদ্রা প্রাপ্তির ভিত্তিতে ডি. আর. ভাণ্ডারকার মনে করেন যে তিনি বিদিশা শাসন করতেন। কিন্তু এই মত খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা মথুরায় গণপতিনাগের শতাধিক মুদ্রা পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে এ. এস. আলতেকার সিদ্ধান্তে এসেছেন যে তিনি মথুরার শাসক ছিলেন। এছাড়া পুরাণ থেকেও মথুরার নাগবংশের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সুতরাং, তিনি মথুরা শাসন করতেন বলেই মনে হয়।

কোটা পরিবার

প্রশস্তিটিতে রাজার নাম না থাকলেও তিনি যে কোটা পরিবারভুক্ত তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, পূর্ব পাঞ্জাব ও দিল্লিতে কোটা পরিবারের কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে বেশিরভাগ পণ্ডিত সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকার কোনো এলাকায় তাঁরা শাসন করতেন। কিন্তু আলেকজান্ডার কানিংহাম মুদ্রাগুলি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে এগুলি অনেক পরবর্তীকালের (৫০০ খ্রিঃ ৮০০ খ্রিঃ-এর মধ্যে)। এই কারণে ঐ মুদ্রাগুলির সঙ্গে এলাহাবাদ স্তম্ভলেখর কোটা পরিবারের শনাক্তকরণে সংশয় প্রকাশ করেছেন পি. এল. গুপ্ত। উয়ান চোয়াঙ-এর বিবরণের ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন যে খুব সম্ভবত উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকায় বিশেষ করে দক্ষিণ পঞ্চালে কোটারা শাসন করতেন।

সামগ্রিকভাবে ঐ চারজন রাজার ওপর সমুদ্রগুপ্তের অভিযান প্রেরণের বিষয়টি প্রথম আর্যাবর্ত (উত্তর ভারত অভিযান হিসাবে সাধারণভাবে পরিচিত। ১১ এখন প্রশ্ন হল, কোথায় এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল? কে. পি. জয়সওয়াল যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে কৌশাম্বীকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যের হয়তো কিছুটা যুক্তি আছে। কেননা, এমন হতে পারে যে, প্রথম আর্যাবর্ত অভিযানের সাফল্যকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ঐ এলাকাতেই তিনি প্রথম এলাহাবাদ স্তম্ভলেখটি স্থাপন করেছিলেন। এছাড়া, মথুরা, অহিচ্ছত্র, পদ্মাবতী ও দক্ষিণ পঞ্চালের শাসকদের সকলের পক্ষেই কৌশাম্বী ছিল একটা উপযুক্ত স্থান । কে. পি. জয়সোয়াল, এস. কে. আয়াঙ্গার প্রমুখ আরো বলেছেন যে, অচ্যুত নাগসেন ও কোটা পরিবারের রাজকুমার ঐক্যবদ্ধভাবে সমুদ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে জোট গঠন করেন এবং যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাঁদের এই বক্তব্যের অবশ্য দৃঢ় ভিত্তি নেই। উপযুক্ত তথ্যের অভাবে এই অভিমত যথেষ্ট দুর্বল।

এই তথাকথিত প্রথম আর্যাবর্ত অভিযান প্রসঙ্গে পূর্বে উল্লেখিত পুষ্পনগরীর শনাক্তকরণের ব্যাপারে এখন আলোচনা করা যেতে পারে। একটা ধারণা অনুযায়ী। ‘পুষ্প’ বলতে কান্যকুব্জ বা কনৌজকে বোঝানো হয়েছে। অপর একটি ধারণা অনুযায়ী পুষ্পপুর ছিল পাটলিপুত্রেরই অপর নাম। উল্লেখ্য, দশকুমারচরিত-এ পাটলিপুত্রকে পুষ্পপুর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া, উয়ান চোয়াঙ তাঁর বিবরণে পাটলিপুত্রকে কু-সু-ম-পু-লো (কুসুমপুর) বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং পুষ্পপুর ও কুসুমপুর যে প্রাচীনকালে পাটলিপুত্রকেই বোঝাত সে বিষয়ে সংশয়। নেই।

পাটলিপুত্র ছিল সমুদ্রগুপ্তের রাজধানী। এস. কে. আয়াঙ্গার যুক্তিপূর্ণ কোনো তথ্যের ওপর নির্ভর না করেই বলেছেন যে অচ্যুত, নাগসেন ও কোটা পরিবারের রাজা সংঘবদ্ধভাবে সমুদ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে আক্রমণ হেনেছিলেন, যদিও তাঁরা পরাজিত হন। আগেই বলা হয়েছে, এই অভিমতের কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই। যাই হোক, এই শ্রেণীর ঐতিহাসিকদের মতে যুদ্ধে জয়লাভের পর বিজয় গর্বে উচ্ছ্বসিত সমুদ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রে আনন্দ উপভোগ করছিলেন। অথবা এমনও হতে পারে, সমুদ্রগুপ্তের সেনাদল যখন কিছুটা দূরবর্তী এলাকায় কোটা পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত ছিল। তখন সম্রাট পাটলিপুত্রে বরাবরের ন্যায় স্বাভাবিক সময় অতিবাহিত করছিলেন। আবার এমন মনে করাও অস্বাভাবিক নয় যে কোটা পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযানের এই ঘটনাটি ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। তাই ঐ বিষয়টি কেবল সৈন্যদের ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজে দূরবর্তী নগরীতে অবস্থান করছিলেন।

প্রাচীনকালে কান্যকুব্জের একটি নাম ছিল পুষ্পপুর। কান্যকুব্জের অবস্থান এমনই জায়গায় যেখান থেকে অচ্যুত, নাগসেন, গণপতিনাগ ও কোটা পরিবার অর্থাৎ অহিচ্ছত্র, মথুরা, পদ্মাবতীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা ছিল সহজসাধ্য। এতদ্‌সত্ত্বেও পুষ্পপুরের শনাক্তকরণের ব্যাপারে ঐ দুটি অভিমতই তথ্যভিত্তিক নয়— অনুমানমাত্র।

এলাহাবাদ প্রশস্তির অষ্টম স্তবকে সামরিক বিষয় সংক্রান্ত কোনো কথাবার্তা নেই। সেখানে কেবল সমুদ্রগুপ্তের বিভিন্ন গুণাবলী, তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কাবে নৈপুণ্য প্রভৃতি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। নবম স্তবকে কবি হরিযেণ সমুদ্রগুপ্তের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে গিয়ে শতযুদ্ধে শতাবতরণ’) তাঁর দক্ষতার কথা উল্লেখ করেছেন। অবশ্য এক্ষেত্রে কোনো যুদ্ধের উল্লেখ নেই। হরিষেণের এই বক্তব্য অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট বলেই মনে হয়।

এরপর দশম স্তবক থেকে দ্বাদশ স্তবক পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক বিভিন্ন শাসকের ওপর আক্রমণ ও তাদের রাজ্যজয় এবং স্বেচ্ছায় তাঁর কাছে কয়েকটি রাজ্যের শাসকদের আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি বিস্তৃত তালিকাও এলাহাবাদ প্রশস্তিতে আছে। এই পর্বে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তাকে সম্রাট কর্তৃক রাজ্য অধিগ্রহণ বা জয়ের পর গৃহীত পদক্ষেপের ধারা অনুসারে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে।

চারটি স্তরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে দক্ষিণের সমস্ত রাজাদের (‘সর্ব-দক্ষিণা-পথরাজ’) প্রসঙ্গ হরিষেণ উল্লেখ করেছেন। সমস্ত দক্ষিণের রাজাদের কথা বলতে গিয়ে অবশ্য বারো জন রাজার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। শাসকদের নামের পাশাপাশি তাঁদের রাজ্যের নামও উল্লেখিত হয়েছে। দক্ষিণাপথের এই বারো জন রাজা হলেন যথাক্রমে কোসলের মহেন্দ্র, মহাকান্ডারের ব্যাঘ্ররাজ, কুরল (কৌরালক)-এর মন্তরাজ, পিষ্টপুরের মহেন্দ্রগিরি, কোটুরের স্বামীদত্ত, এরান্দপল্লের দমণ, কাঞ্চির বিষ্ণুগোপ, অবমুক্তের নীলরাজ, বেঙ্গির হস্তিবর্মণ, পালক্ক-র উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের কুবের, কুস্থলপুরের ধনঞ্জয়। । ১২ দক্ষিণ ভারতের রাজাদের প্রতি সমুদ্রগুপ্ত কী ধরনের নীতি নিয়েছিলেন তারও উল্লেখ আছে এই ঐতিহাসিক দলিলটিতে। সেখানে বলা হয়েছে যে এক্ষেত্রে তিনি, গ্রহণ, মোক্ষ ও অনুগ্রহ (‘গ্রহণ-মোক্ষানুগ্রহ) নীতি নেন। এই তিনটি নীতির আক্ষরিক অর্থ হল নিম্নরূপ— ‘গ্রহণ’ বলতে বোঝায় শত্রুকে জোরপূর্বক বন্দি করা ; ‘মোক্ষ’র অর্থ হল শত্রুকে মুক্তিদান এবং ‘অনুগ্রহ’ হল শত্রুকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের পরিধি  :

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের পরিধি আলোচনা করতে হলে একে দুটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া বাঞ্ছনীয় হবে। একটি পর্যায়ে ছিল সেই সমস্ত এলাকা যেগুলিতে সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল। এর মধ্যে প্রধান ও উল্লেখযোগ্য ছিল উত্তর ভারত। বস্তুত এটাই ছিল তার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনের পূর্বদিকে ছিল বাংলার এক উল্লেখযোগ্য অংশ। উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। পূর্ব পাঞ্জাবের কর্ণল থেকে মধ্যপ্রদেশের ভিলসা বরাবর ছিল তাঁর সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমা। সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমা ছিল মধ্যপ্রদেশের সগর ও দামো জেলা থেকে জব্বলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায় যে, কাশ্মীর, পশ্চিম পাঞ্জাব, পশ্চিম রাজপুতানা, সিন্ধু ও গুজরাট তাঁর এই সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল।

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য-সীমা : 

প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ঐ সাম্রাজ্য সীমার বাইরে অবস্থিত ছিল এক বিস্তৃত এলাকা যার ওপর তাঁর পরোক্ষ প্রভাব ছিল। প্রধানত পশ্চিম রাজপুতানা, কাশ্মীর ও পশ্চিম পাঞ্জাব ছিল এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত। এগুলির বেশিরভাগই ছিল করদ রাজ্য। এছাড়াও পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের শক-কুষাণরাও তাঁর ঐ সাম্রাজ্য সীমার বাইরে ছিল। প্রত্যক্ষ শাসনাধীন এলাকার বাইরে অবস্থিত এই সমস্ত শক্তিগুলি খুব সম্ভবত গুপ্ত সম্রাটের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল। অন্ততপক্ষে এগুলির ওপর সমুদ্রগুপ্তের কিছুটা প্রভাব ছিল। সিংহল ও অন্যান্য দ্বীপের বাসিন্দারা কেবল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ছিল বলেই মনে হয়। রোমিলা থাপার বলেছেন যে, সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল কেবল গাঙ্গেয় উপত্যকায়—অন্যান্য এলাকা তাঁর সাম্রাজ্য সীমার বাইরেই থেকে গিয়েছিল। 

মূল্যায়ন : 

সামরিক প্রতিভা, বাস্তব বৃদ্ধি, পরিস্থিতি অনুযায়ী যথাযোগ্য পথ বেছে নেবার ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়গুলি সমুদ্রগুপ্তকে বিজেতা হিসাবে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল সে বিষয়ে সংশয় নেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাস্তব পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে কোনো ব্যক্তি বা শাসকের পক্ষে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজসাধ্য হয়। এক্ষেত্রে সমুদ্রগুপ্তের উত্থান ও সামরিক সাফল্যের পিছনেও নিশ্চিতভাবে কিছু অনুকূল পরিস্থিতি কাজ করেছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে সমুদ্রগুপ্তের আমলে (আঃ ৩৩৫-৭৫ খ্রিঃ) অর্থাৎ খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যভাগে ভারতবর্ষে শক্তিশালী কোনো শাসক আবির্ভূত হননি। কুষাণ সাম্রাজ্য তখন বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম ভারতের শকদের মধ্যেও আর তখন রুদ্রদামনের মতো সামরিক নেতার আবির্ভাব ঘটেনি। এককথায়, কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতে কোনো শক্তিশালী শক্তির আবির্ভাব ঘটেনি। এর ফলে অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সমুদ্রগুপ্ত তার সামরিক প্রতিভার সাহায্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে বিশাল আকার দানে সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব অপরিসীম।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *