StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বের মূল্যায়ন আলোচনা কর

 

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বের মূল্যায়ন আলোচনা কর ।দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বের  মূল্যায়ন ।

ভূমিকা : 

খ্যাতনামা সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের শাসনকালের বিভিন্ন দিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের একটা মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হওয়া যাক। প্রথমে নতুন রাজ্য জয় তথা গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে তাঁর অবদান প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য হল, সমুদ্রগুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের জন্য রাজ্য জয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ওপর এই কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল এবং তিনি এক্ষেত্রে অনেকটা সফল হয়েছিলেন। তিনি আরো বলেছেন যে সমুদ্রগুপ্তের সময় বিজিত উপজাতীয় ও সীমান্ত রাজ্যগুলি তিনি সুসংগঠিত রূপ দিয়েছিলেন। 

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বের মূল্যায়ন : 

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শুধুমাত্র একজন সেনাধ্যক্ষ ও সুদক্ষ শাসকই ছিলেন না, একজন উঁচু মানের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শাসক হিসাবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ড ও ব্যক্তিত্বের দরুনই সাম্রাজ্যে শাস্তি বিরাজিত ছিল। জনসাধারণ এই সাম্রাজ্য নির্মাতার তুলনায় এর সুসংহতি দানকারী দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। তথাকথিত শত যুদ্ধে জয়ী সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন। ইতিহাসের মহান বীর নায়ক। কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সাম্রাজ্যকে রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। তাঁর আমলেই সাংস্কৃতিক জাগরণ নতুন মাত্রা পায়। তাই তাদের হৃদয়ে তিনি দীর্ঘস্থায়ী আসন লাভ করেছিলেন। 

পরবর্তীকালে পি. এল. গুপ্তও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। আর. সি. মজুমদারের মতের সঙ্গে প্রায় একমত হয়ে তিনি বলেছেন, সমুদ্রগুপ্তের আমলে রাজ্য জয়ের যে কাজ শুরু হয়েছিল তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত উপজাতীয় প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য ও সীমান্ত রাজ্যগুলিকে সুসংহত রূপ দান করেছিলেন। কুষাণ ও শকদের দ্বারা একসময় শাসিত অঞ্চলগুলিও তাঁর সময় এই সুদৃঢ় ও সুসংহত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠরের আঙ্গিকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে ওপরে যে আলোকপাত করা হয়েছে তা অবশ্য সর্বজনসম্মত নয়। এ ব্যাপারে তাঁর আপত্তি এসেছে এস. আর. গয়াল ও তাঁর অনুগামীদের কাছ থেকে। এস, আর, গয়ালের বক্তব্য হল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব এই যে তিনি নালব ও পশ্চিম ভারতের শক শক্তিকে পরাজিত করে তাদের শাসিত এলাকা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এছাড়া, বিজেতা হিসাবে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব নেই বলে তিনি মনে করেন। পিতার অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি বলে তিনি দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট প্রমাণ হিসাবে দাক্ষিণাত্যে সমুদ্রগুপ্তের অভিযানের পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মেহেরাউলি লৌহ স্তম্ভ লেখয় উল্লেখিত ‘চন্দ্র’কে এস. আর. গয়াল সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে শনাক্ত করে বঙ্গ ও বাহ্লীক দেশ জয়ের কৃতিত্ব তাঁর ওপর আরোপ করেছেন।

সমর বিশারদ ও বিজেতা হিসাবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বকে ম্লান করার ব্যাপারে শ্রীরাম গয়াল যেসব যুক্তি উত্থাপন করেছেন তা অবশ্য সর্বজনগ্রাহ্য নয়। একথা ঠিক যে পিতা সমুদ্রগুপ্তের মতো সামরিক প্রতিভা তাঁর ছিল না। দাক্ষিণাত্যে পিতার আরব্ধ কাজ সমাপ্ত করার জন্য কোনো অভিযান তিনি প্রেরণ করেননি একথাও ঠিক। কিন্তু তাই বলে পশ্চিম ভারতে শকদের রাজ্য জয় করা ছাড়া তাঁর আর কোনো সামরিক কৃতিত্ব ছিল না, এধরনের দৃঢ় অভিমত পোষণ করা শক্ত। কেননা, আলোচনা প্রসঙ্গে দেখা গেছে যে, মেহেরাউলি লৌহ স্তম্ভ লেখর রাজা চন্দ্রকে দ্বিতীয় চন্দগুপ্তের সঙ্গে শনাক্ত করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। এই শনাক্তকরণকে যথার্থ বলে মনে করলে এই সিদ্ধান্তে আসাই বাঞ্ছনীয় হবে যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তারের যে ছক সমুদ্রগুপ্ত তৈরি করেছিলেন তার বাস্তব রূপায়ণ ঘটান দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত।

সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তারে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু সাম্রাজ্যে সুসংহত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। বস্তুত, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এবং নিজ কর্মপ্রতিভার দরুন অর্জিত বিস্তৃত গুপ্ত সাম্রাজ্যে তিনি সুশাসনব্যবস্থা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে অন্যতম প্রধান তথ্য হল ফা-হিয়েনের বিবরণ, যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। এখানে শুধু একথা বলাই যথেষ্ট হবে যে সুশাসক হিসাবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা বজায় রেখেছিলেন।

রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক দিক ছাড়াও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর রাজত্বকাল স্মরণীয় হয়ে আছে। গুপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতির যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল তাঁর আমলে। ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা ও বিমানে এক অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছিল এযুগে। সংস্কৃত ভাষা যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার যথার্থই বলেছেন যে গুপ্ত সভ্যতা সংস্কৃতির উৎকর্যের পিছনে কেবল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অবদান ছিল মনে করলে ভুল হবে। প্রকৃত অর্থে এটি ছিল সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত—উভয়েরই কৃতিত্বের ফসল। কেননা, তাদের কর্ম প্রতিভার দরুনই বৃহত্তর এলাকা গুপ্ত সাম্রাজ্যভু হয়েছিল ও সাম্রাজ্যে শাস্তি শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়েছিল। 

সাম্রাজ্যিক শান্তি বজায় থাকার ফলশ্রুতি হিসাবেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতি সম্ভবপর হয় বলে মনে করেন আর সি. মজুমদার। সভ্যতা-সংস্কৃতির অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতেই একে ‘সুবর্ণযুগ’, ‘ধ্রুপদীযুগ’ প্রভৃতি বিশেষণে অভিহিত করা হয়। অবশ্য গুপ্ত যুগ সম্পর্কে ব্যবহৃত এই সমস্ত বিশেষণগুলির যথার্থতা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে ঐতিহাসিক মহলে নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।

মুদ্রা প্রচলনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে কিছুটা ধারাবাহিকতা বহির্ভূত চিত্র লক্ষ করা যায়। উল্লেখ্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পূর্বসূরিরা কেবল স্বর্ণমুদ্রা চালু রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর সময়ে স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও তাম্র ও বিশেষ করে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন লক্ষণীয়। রৌপ্যমুদ্রাগুলির প্রাপ্তিস্থান প্রধানত পশ্চিম ভারতে। পশ্চিমের শক ক্ষত্রপদের রৌপ্যমুদ্রাগুলির অনুকরণে তিনি ঐ ধরনের মুদ্রার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। শক-ক্ষত্রপদের অনুকরণে মুদ্রা প্রচলনের পিছনে প্রধান লক্ষ্য ছিল খুব সম্ভবত তাদের কাছ থেকে বিজিত অঞ্চলগুলি সম্পর্কে জনসমক্ষে প্রচার করা। 

রৌপ্যমুদ্রাগুলির এক পিঠে শক-ক্ষত্রপদের মুদ্রার অনুকরণের বিষয়টি উৎকীর্ণ থাকলেও এগুলির উল্টো দিকে তিনি শকদের ব্যবহৃত চৈত্য প্রতীক ব্যবহৃত করেননি। সেখানে বিষ্ণুর বাহন গরুড় প্রতীক চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রাতে লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মোট আট ধরনের স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ‘সিংহবিক্রম’ শব্দ যুক্ত মুদ্রাগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। রমেশচন্দ্র মজুমদার, এস. আর. গয়াল প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন যে ‘সিংহবিক্রম’ অভিধা সম্ভবত তাঁর গুজরাট জয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। আট ধরনের স্বর্ণমুদ্রার মধ্যে দু’ধরনের মুদ্রা তাঁর সামরিক প্রতিভার ইঙ্গিত দেয়।

উপসংহার :

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বের মূল্যায়ন সংক্রান্ত বিস্তৃত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সমুদ্রগুপ্তের মতো সামরিক প্রতিভার অধিকারী না হয়েও তিনি জনমানসে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের স্থিতাবস্থা ও শান্তি-শৃঙ্খলার দরুন তাঁর সময়ে এর সুদৃঢ়করণ সম্ভব হয়েছিল। একটি শক্তিশালী অথচ উন্নত শাসনব্যবস্থা তাঁর আমলে গড়ে উঠেছিল। সর্বোপরি, গুপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *