StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

নতুন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আনাল গোষ্ঠীর অবদান আলোচনা করো

 

নতুন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আনাল গোষ্ঠীর অবদান আলোচনা করো।  আনাল গোষ্ঠীর অবদান ।

ভূমিকা :

ফ্রান্সের আনাল গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকগণ সামগ্রিক ইতিহাস রচনা (Total History)-র ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আনাল হল একটি পত্রিকার নাম যা 1929 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসচর্চাকে কেন্দ্র করে আরম্ভ হয়। আনাল গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকগণের মূল বৈশিষ্ট্য হল যে এরা শুধুমাত্র মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপকেই প্রাধান্য দেননি, বরং ভূগোল, ইতিহাস, আবহাওয়া বিজ্ঞান (Climatology), ধর্ম, চিরাচরিত সংস্কার, উৎসব ইত্যাদির মাধ্যমে মানব সমাজের বিভিন্ন আঙ্গিককে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসীয় বস্তুবাদী দর্শন ও রোমান্টিক ভাববাদ – উভয়ই এই ইতিহাসচর্চার উপাদানের অন্তর্গত।

নতুন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আনাল গোষ্ঠীর অবদান :

আনাল গোষ্ঠীর প্রথম পর্যায়ে তিন প্রধান স্তম্ভ হলেন লুসিয়েন ফের (Lucien Febvre, CE 1878-1956), মার্ক ব্লখ (Mark Bloch, CE 1886-1944) এবং ফার্নান্দ দেল (Fernand Braudel)। এর পরবর্তী আনালপন্থীরা হলেন পিয়ের শূন্যো (Pierre Chaunu), ইম্যানুয়েল লি রয় লাদুরি (Emmanuel Le Roy Ladurie), লি গফ (Le Goff) প্রমুখ। লুসিয়েন ফেবর এবং ইহুদি বংশজাত লিওপোল্ড বেঞ্জামিন মার্ক ব্লখ উভয়েই স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। উভয়েই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার এবং জ্ঞান পিপাসু।
ফেবর অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, প্রতীকবিজ্ঞান ( Iconography) ইত্যাদি ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন করেন। ফেবরের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলি হল দ্য রিজিয়ন অফ ফান্স (The Region of France, Phillip II এবং মার্টিন লুথার (Martin Luther )। এছাড়া তাঁর পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত দ্য আর্থ অ্যান্ড সোশ্যাল ইভোলিউশন (The Earth and Social Evolution) ইতিহাস এবং ভূগোলের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে। ফেবর পরবর্তীকালে ব্রাজিলে চলে যান এবং ওখানেই বসবাস করেন।
মার্ক ব্লখ একজন ঐতিহাসিক ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসেবে লড়াই করেন এবং 1940 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর গোপনে জার্মান দখলদারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। তিনি অবশেষে গেস্টাপোর হাতে ধরা পড়েন এবং 1944 খ্রিস্টাব্দে তাঁকে গুলি করে মারা হয়।
ইতিহাসচর্চার জন্য ব্লখ শুধুমাত্র লেখ্যাগারের নিষ্প্রাণ তথ্যের ওপর নির্ভর করেননি, বরং সাধারণ মানুষের স্মৃতিবিজরিত মৌখিক বিবরণ (Memory and Oral Tradition), প্রাচীন সংস্কার, লোকসংস্কৃতি ইত্যাদিকে উপাদান (Source) হিসেবে ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন। ব্লখ বিশ্বাস করতেন যে একজন প্রকৃত ঐতিহাসিককে তথ্য নিরূপণ ও বিশ্লেষণের জন্য সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে বিচরণ করতে হবে; যথা ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান ইত্যাদি।
মধ্যযুগের খাজনা সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি, আদালতের রায়, মঠের নথি ইত্যাদি উপাদান হিসেবে সমান গুরুত্বপূর্ণ। ব্লখের মতানুসারে ইতিহাস শুধুমাত্র মানব কার্যকলাপের ভাষ্য না হয়ে সামাজিকভাবে প্রাথমিক একটি বিষয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রাখে। এইভাবে তিনি ইতিহাসকে একটি ফলিত সমাজ বিজ্ঞানের (Applied Social Science) মর্যাদা দেওয়ার প্রয়াস করেন।
মার্ক ব্লখের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে হল দ্য হিস্টোরিয়ানস ক্রাফট (The Historian’s Craft), দ্য আইল্যান্ড অফ ফ্রান্স ( The Island of France), কিংস অ্যান্ড সার্ফস (Kings and Serfs), দ্য রয়াল টাচ (The Royal Touch), ফ্রেঞ্চ রুরাল হিস্ট্রি (French Rural History) এবং ফিউডাল সোসাইটি (Feudal Society, CE 1940)।
আনাল ঐতিহাসিকবৃন্দের Total History-র তত্ত্বের মূর্ত রূপ দেন তাঁর প্রখ্যাত রচনা দ্য মেডিটেরানিয়ান ওয়ার্ল্ড ইন দ্য এজ অফ ফিলিপ টু-র (The Mediterranean World in the Age of Phillip II, CE 1949) মাধ্যমে। এখানে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে ভূমধ্যসাগরকে তুলে ধরা হয়েছে। ঐতিহাসিক অঁরি পিরেনের (Henri Pirenne) ভূমধ্যসাগরভিত্তিক আখ্যানের পর এটি সম্ভবত ওই অঞ্চলের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব রাখে।
লি রয় লাদুরি রচিত দ্য পেডেন্টস অফ ল্যাংগুদ (The Peasants of Languedoc), ল্যাংগুদ্যক প্রদেশের গ্রাম্য সমাজের সার্বিক ইতিহাসের একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বিশেষ আনাল ঐতিহাসিকদের কার্যপ্রণালীর দুই প্রধান বিষয় হল মতালিতে (Mentalite) এবং লংড্যুরি (Long Duree)। প্রথমটি সময়োচিত প্রেক্ষিতে কোনো ঘটনার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির (Attitude) সূচক ,
দ্বিতীয়টি কোনো ঘটনার দীর্ঘসূত্রিতার ইঙ্গিত বহন করে। এই দুই প্রণালী থেকে সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন দিকগুলিকে ব্যাখ্যা করা সহজ হয়। এই Model ইতিহাসের দ্রুত সংঘটিত ঘটনাবলিকে স্তিমিত করে দেয় যাতে সমাজবিজ্ঞানীগণ সুষ্ঠুভাবে তা পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনা করতে পারেন।
আনাল গোষ্ঠীর চিন্তাজনিত বিবিধ কার্যকলাপ পাশ্চাত্য তথা বিশ্ব-ইতিহাসবীক্ষণকে আরও অধিক সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করে।

  • মূল্যায়ন :

  • পরিশেষে উপরোক্ত সমস্ত আলোচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে ইতিহাস তথা ঐতিহাসিকের প্রাসঙ্গিকতা আজও অম্লান। ইতিহাস মানবসভ্যতা তথা সংস্কৃতির দিশারি। যুগে যুগে ঐতিহাসিকগণ এই কর্মযজ্ঞকে নথিভূক্ত করার আপ্রাণ প্রয়াস করেছেন যা এই আধুনিক সময়েও অব্যাহত। আগের তুলনায় ইতিহাস রচনা অনেক যুক্তিযুক্ত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক। সভ্যতার সংকট যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখনই মানুষের ইতিহাসবোধ তাকে উক্ত সংকট থেকে মুক্তির উপায় নির্দেশ করে। তাই মানুষ ইতিহাসভ্ৰষ্টা এবং ইতিহাসনির্মাতা যা স্থান, কাল, পাত্রকে অতিক্রম করে। ইতিহাস সম্বন্ধে মার্ক ব্লখ যথার্থ মন্তব্য করেছেন: The Science of Men in Time । নতুন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আনাল গোষ্ঠীর অবদান অবিস্মরণীয়।
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *