পরিবারের কার্যাবলী সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ লেখো

 

পরিবারের কার্যাবলী আলোচনা কর। পরিবারের কার্যাবলী সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ লেখো।

ভূমিকা :

ঝঞ্ঝামুখর জগৎ এবং জীবনে সুস্থসবলভাবে মানবজীবন অতিবাহিত করতে পরিবারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এ বিষয়ে সকলেই সহমত পোষণ করে থাকেন। কিন্তু পরিবারের বহুমুখী কার্যধারায় পরিবার সমাজে কী কী কার্য করে থাকে, সে বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরিবারের কর্মধারা উপস্থাপন করেছেন। 

পরিবারের কার্যাবলী :

ডেভিস ও বটোমোর মত (Opinion of Kingsley Davis & TB Bottomore): ডেভিস পরিবারের কার্যাবলিকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি হল-

  1. সন্তান প্রজনন (Reproduction).
  2. সন্তান প্রতিপালন (Maintenance),
  3. কর্মনিযুক্তির ব্যবস্থা (Placement),
  4. সামাজিকীকরণ (socialization) |

তবে টি বি বটোমোর-এর লিখিত Sociology প্রশ্নে তিনি প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ভাগের ওপর বিশেষ পুরুত্ব আরোপ করেছেন, কিন্তু ‘কর্মনিযুক্তির ব্যবস্থা (Placement) সর্বজনীন বলে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর কথায়—”of these the first two and the fourth are most important, since placement, in the sense of allocation to a position in the occupational system or the status hierarchy is not universal function.” মারডক অগবার্ন ও নিম্নকক্ষের মত (Opinion of the GP Murdock, W FOgburn & M F Nimkoff): সমাজবিজ্ঞানী মারডক (Murdock) তাঁর ‘Social Structure’ গ্রন্থে পরিবারের চারপ্রকার কার্যধারার কথা ব্যক্ত করেছেন, সেগুলো হল—

  1. যৌন কার্যধারা,
  2. অর্থনৈতিক কার্যধারা,
  3. প্রজনন কার্যধারা,
  4. শিক্ষা বিষয়ক কার্যধারা। 

অগবার্ন ও নিমকফ (Ogburn & Nimkoff) পরিবারের কার্যাবলিকে (Functions of the family) ৬টি ভাগে ভাগ করেছেন, সেগুলো হল–

  1. স্নেহ সম্পর্কিত কার্যধারা,
  2. অর্থনৈতিক কার্যধারা, 
  3. প্রমোদমূলক কার্যধারা,
  4. নিরাপত্তামূলক কার্যধারা,
  5. ধর্মীয় কার্যধারা
  6. শিক্ষা বিষয়ক কার্যধারা।

ম্যাকাইভার এবং পেজের মত (Opinion of R M Maciver & C H Page): ম্যাকাইভার এবং পেজ পরিবারের কার্যাবলিকে যে দু-ভাগে ভাগ করেছেন, তার এক ভাগ পরিবারের ক্ষেত্রে অপরিহার্য, দ্বিতীয় ভাগ অপরিহার্য নয়। অপরিহার্য কার্যের তালিকায় আছে— যৌন আকাঙ্ক্ষার স্থায়ী পরিতৃপ্তিসাধন, সন্তান প্রজনন ও প্রতিপালন এবং একটি গৃহের ব্যবস্থা করা। অপরিহার্য নয় তালিকায় আছে—ধর্মীয়, শিক্ষা বিষয়ক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ও বিনোদন বিষয়ক বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর মত বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত কার্যাবলিকে বিশেষভাবে গ্রহণ করা হয়—

[1] সন্তান প্রজনন এবং প্রতিপালন (Production & rearing of children):

পরিবার হল সন্তান প্রজননের স্বীকৃত সংস্থা বিবাহের মধ্য দিয়েই তৈরি হয় নরনারীর মিলনক্ষেত্র, যার ফলশ্রুতিতে এক প্রজন্মের গমন, আর এক প্রজন্মের আগমনের মধ্য দিয়ে মানবের অস্তিত্ব বজায় আছে। ধরনির এই মিলনক্ষেত্রে মহামিলনের মধ্য দিয়েই পরিবারের পরিধি প্রসারিত হয়ে চলেছে। সুতরাং সন্তান প্রজনন পরিবারের কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। তবে সন্তান প্রজননের মধ্য দিয়ে পরিবারের দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, দায়দায়িত্ব যেমন নবজাতকের লালনপালন, ভরণ-পোষণ প্রভৃতি মহান কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, যা অস্বীকার করা মানবধর্মবিরোধী কার্যকলাপ। স্মরণ রাখতে হবে, পৃথিবীর বুকে ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতক দীর্ঘকাল থাকে পরনির্ভরশীল, অসহায়। সন্তান প্রতিপালন (Rearing of Children) মানবধর্ম, যা থেকে মানব বিচ্যুত হতে পারে না, যা মানব অধীকার করতে পারে না। সুতরাং, পরিবারের কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত হল সন্তান প্রতিপালন।

[2] যৌন প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তি (Satisfaction of sex need):

জৈব গোষ্ঠী হিসেবে পরিবার যৌন প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তিসাধনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। পারিবারিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের দেহজ কামনাকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিতৃপ্ত করার বিশেষ সুযোগ মানুষ পেয়ে থাকে। তাই এক চিন্তাবিদ বলেছেন, “The fundamental function of the family is to regulate and gratify sexual needs.”

[3] সামাজিকীকরণ (socialization):

অধ্যাপক Kingsley-এর মতে, যে পদ্ধতিতে মানবশিশু ক্রমশ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়, তাকে বলে সামাজিকীকরণ। এক্ষেত্রে পরিবার বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। কারণ পরিবারের মধ্যেই শিশুর জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশ হয়। সেই পারিবারিক ক্ষেত্রেই শিশুর সামাজিকীকরণের সূত্রপাত ঘটে। এক্ষেত্রে পরিবার বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। পারিবারিক সংস্থার মধ্যেই শিশু সামাজিক প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, সংস্কার, নৈতিক আদর্শ প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হয় এবং সেগুলো আয়ত্ত করে থাকে। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার প্রভাবে শিশু প্রভাবিত হয়। সুতরাং, সামাজিকীকরণের (socialization) ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।

[4] অর্থনৈতিক দায়িত্ব (Economic responsibility):

অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রত্যাশা মানুষ করে, তা মূলত পরিবারের মধ্যেই করে। সকল পরিবার তার অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করে। সদস্যদের ভাবনাচিন্তা, চাহিদা, হৃদয়াবেগ প্রভৃতি প্রশমনে ব্রতী হয়। অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং অনস্বীকার্য।

(5) দৈহিক ও মানসিক নিরাপত্তা (Physical and Psychic security):

পরিবার তার অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের শারীরিক সুস্থতা এবং দৈহিক নিরাপত্তা গ্রহণের দায়দায়িত্ব পালন করে। পরিবারই সর্ব শক্তি সর্ব প্রচেষ্টা দিয়ে অসুস্থকে সুস্থ করতে পারে। রচনা করতে পারে দেহমনের সুষ্ঠু সেতুবন্ধন। তাই দৈহিক ও মানসিক নিরাপত্তার (Physical and Psychic security) ক্ষেত্রে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।

[6] মানসিক আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি (Satisfaction of mental desire):

মানুষ প্রেমের কাঙাল, মানুষ ডালোবাসার কাঙাল, প্রেমপ্রীতি পিয়াসি মানুষের মূল আশ্রয়স্থল হল পরিবার। সে প্রীতিপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশে মানসিক বৃত্তিসমূহের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে যে আত্মিক কখন থাকে, সে যখন পরিবারের আঙিনায়, পরিবারের সাহচর্যে দৃঢ় হয়। মানবের মানবিক সত্তার বিকাশ ঘটে। সুতরাং, মানসিক আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

(7) সামাজিক মর্যাদা প্রদান (Ascription of social prestige ):

সাধারণত পারিবারিক পরিচিতির মাধ্যমে সমাজে ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিপন্ন হয়। যে পরিবারে ব্যক্তির জন্ম সেই সূত্র ধরেই ব্যক্তির পরিচিতি। সাধারণত স্বস্থ পরিবারের সুনাম, দুর্নাম, প্রসার, প্রগতি প্রভৃতি পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিমানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়। এই কারণে বিভিন্ন পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে সামাজিক মানমর্যাদার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়।

[8] ধর্মকেন্দ্রিক ভূমিকা (Religious role) :

মানুষ ধর্মভিত্তিক পরিবারের অংশীদার। সনাতন প্রমায় পরিবারের সদস্যরা তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, প্রথা প্রভৃতি সম্বন্ধে অবহিত করেন। ফলে সন্তান-সন্ততিরা ধর্মশিক্ষায় মনকে শিক্ষিত করে, নিয়ন্ত্রিত করে, পরিচালিত করে। ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত মনে নবচেতনার উন্মেষ ঘটে। সুতরাং, ধর্মীয় বিষয়ে ও পরিবারের ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

[9] শিক্ষা বিষয়ক ভূমিকা (Educational role):

 পরিবারের মাঝেই শিশুর জন্ম, পরিবারের মধ্যেই শিশুর হাতেখড়ি। তাই পরিবারের মাঝে পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে শিশুরা শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে। বর্তমানেও অনেকক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা তাদের পারিবারিক বৃত্তি উত্তরপুরুষের কাছে সঞ্চালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং, শিক্ষা বিষয়ক বিষয়েও পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

[10] সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ (Inheritance):

 সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রেও পরিবার বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। পারিবারিক বিষয়সম্পত্তি, জমিজমা, টাকাকড়ি প্রভৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে এক পুরুষ হতে পরবর্তী পুরুষের কাছে হস্তান্তরিত হয়। সুতরাং, সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণে পরিবারের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।

[11] সংস্কৃতির সংরক্ষক (Guardian of culture):

প্রতিটি পরিবারে প্রচলিত সাংস্কৃতিক ধারা বহমান। শিশু পরিবারের মধ্যে থেকে সমাজের সংস্কৃতির ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। সমাজের সংস্কৃতির ধারার অনুজদের, সমাজের সাংস্কৃতির জীবনের উপযোগী করে তাদের আপন আপন জগতে নানাবিধ বৈচিত্র্যময় সবার উম্মোচন ঘটাতে সাহায্য করে।

(12) সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (Social control):

পরিবার সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে। সামাজিক অস্তিত্ব রক্ষার হাতিয়ার হল সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (social control)। তাই মনোবিজ্ঞানী E A Ross বলেছেন, “Social control is the system of devices whereby society brings its members into conformity with the accepted standard of behaviour.” অর্থাৎ, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল কৌশলগত পদ্ধতি, যার দ্বারা সনাজ তার সমাজস্থ সদস্যদের মধ্যে আগে আচরণের গ্রহণীয় ধারা। পরিবার কৌশলগত পদ্ধতি অবলম্বনে সমাজস্থ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে, সামাজিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *