ফরাসি বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব ছিল। ফরাসী বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব ?
ভূমিকা:
১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের প্রকৃতি বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক বিতর্কের শেষ নেই। অনেক ঐতিহাসিকের বক্তব্য মূলত ফরাসী বিপ্লব ছিল বুর্জোয়া বিপ্লব। লেফেভরের মতে বুর্জোয়াদের অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ফরাসী বিপ্লব একটি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ফরাসি বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব ছিল।
ফরাসী বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণী এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিছুদিন বিপ্লব বুর্জোয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল এবং সে সময়ে ফ্রান্সে যেসব সংস্কার প্রবর্তিত হয়। সেগুলি ছিল বুর্জোয়াদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। প্রচলিত ব্যবস্থায় ফ্রান্সে অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় যে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করত তার জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ ছিল বুর্জোয়া শ্রেণী।
ফরাসী বিপ্লবের সময়ে মূলধনের লগ্নী কারবারী, সম্পত্তির অধিকারী, আইনজীবি, চিকিৎসক, অধ্যাপক, শিক্ষক, পদস্থ কর্মচারি, কারিগর ও শিল্পপতিদের নিয়ে এই শ্রেণী গঠিত ছিল। এই শ্রেণীর সঙ্গে কৃষক ও শহরের জনতা যুক্ত ছিল। অষ্টাদশ শতকে ফরাসী বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটলে এই বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে প্রচুর অর্থ চলে আসে। অর্থনীতির দিক দিয়ে তারা সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেও পুরানতন্ত্রের জন্য তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা থাকে না। তাই তারা পুরানোতন্ত্রের উচ্ছেদ চেয়েছিল। বিত্তশালী এই শ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের জন্য স্বপ্ন দেখে। শ্রেণীগত দিক দিয়ে তারা যে শ্রেষ্ঠ সে ধারণা তাদের মধ্যে দেখা দেয়। এই অবস্থায় তারা পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় বাধা ছিল। প্রচলিত সামন্ততন্ত্র। এজন্য সামন্ততন্ত্র প্রথার বিলোপের প্রয়োজন ছিল। সম্পদশালী ও দার্শনিকদের রচনায় সমৃদ্ধ মানসিকতা সম্পন্ন এই শ্রেণী প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়লে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
প্রাক বিপ্লব যুগে কৃষিভিত্তিক সমাজে অভিজাতদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ক্রমশ উৎপাদন ও বিনিময়ের নতুন পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল এক নতুন সমাজ গড়ে উঠার ফলে পুরানো সমাজব্যবস্থার সঙ্গে নতুন শ্রেণীর সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। বিপ্লব ছাড়া বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসা সম্ভব ছিল না। তাই তাদেরকে পুরানো ব্যবস্থা ভাঙ্গতে তৎপর হতে হয়। তারই পরিণাম হল ফরাসী বিপ্লব।
প্রচলিত ব্যবস্থায় বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। অভিজাত শ্রেণী সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করত এবং তারা শ্রেণীগতভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর গুরুত্বকে অস্বীকার করে তাদেরকে কোন সুযোগ দিতে রাজী ছিল না। বুর্জোয়াদের অভিজাত শ্রেণী দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। ইংল্যান্ডেও একই সংকট দেখা যায়। কিন্তু সেখানে রাজা ও অভিজাতরা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে উদীয়মান বুর্জোয়াদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিল। ফলে অতি সহজে ইংল্যান্ডে এই সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণী কোনভাবেই বুর্জোয়াদের ক্ষমতার অংশীদার করতে রাজি হয়নি। যদি অভিজাতরা ইংল্যান্ডের মতো নীতি গ্রহণ করে বুর্জোয়াদের কিছু সুযোগ সুবিধা দিত তাহলে বুর্জোয়ারা সম্ভবতঃ সমঝোতায় আসত।
রাজা অভিজাত ও বুর্জোয়াদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি হলে সমস্যার সমাধান হতে পারত। কিন্তু অভিজাতদের সঙ্গে রাজার স্বার্থমূলক মৈত্রী সে আশাকে নির্মূল করে দেয়। বুর্জোয়া শ্রেণী উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি বলে তারা প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। তারা সমানাধিকারের জন্য দাবি তোলে। অর্থসংকটে অসহায় রাজা ষোড়শ লুই ১৭৮৯ সালের ১লা মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হয়েছিলেন মূলতঃ অভিজাতদের চাপে। অভিজাতদের বিদ্রোহের সময়ে বুর্জোয়া শ্রেণী নীরব দর্শক ছিল না। স্টেটস্ জেনারেলে তারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই তারা এই সভায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। অথচ অভিজাতরা বুর্জোয়াদের কোণঠাসা করতে চেয়েছিল।
বুর্জোয়াদের দাবি ছিল তিন শ্রেণীর একসঙ্গে অধিবেশন ডাকতে হবে। কিন্তু অভিজাতরা তাতে বাধা দেয়। বুর্জোয়ারা নিজেদের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। তারা দাবি করেছিল তৃতীয় শ্রেণী হল জাতির মেরুদণ্ড। বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি এ্যাবে সিয়ে Essay on Privileges পুস্তিকায় বুর্জোয়াদের অবস্থানকে তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য ছিল তৃতীয় শ্রেণী হল আসল জাতি। তারাই জাতীয় সভার মূল স্তম্ভ। সংবিধান সভায় বুর্জোয়াদের আধিপত্য চরমে উঠেছিল। আইনসভা, কমিউন, ন্যাশনাল গার্ডের মাধ্যমে তারা তাদের প্রাধান্য বজায় রাখে। বুর্জোয়াদের সঙ্গে অপর দুই সুবিধাভোগী শ্রেণীর পার্থক্য খুব একটা ছিল না। জমি জায়গা এবং ব্যবসা বাণিজ্যে বুর্জোয়ারা যেভাবে যুক্ত ছিল এবং বিত্তের দিক দিয়ে তাদের অবস্থা যেরূপে ছিল তাতে করে অন্য দুই সুবিধাভোগী শ্রেণী অপেক্ষা তাদের অবস্থা খারাপ ছিল না। কিন্তু তাদের কোন শ্রেণী কৌলিন্য ছিল না এবং ক্ষমতাও ছিল না। তাই তারা অপর দুই শ্রেণীর সুবিধাপ্রাপ্ত মর্যাদাকে নষ্ট করতে তৎপর ছিল। দেশের শাসনকাজে তারা যুক্ত হতে চেয়েছিল। সংবিধান সভায় তারা বাস্তব রাজনীতির পরিচয় দেয় এবং সংবিধান সভাকে কিভাবে নিজেদের স্বার্থে প্রয়োগ করা যেতে পারে সে বিষয়ে তাদের ধারণা ছিল স্পষ্ট।
সংবিধান সভায় বুর্জোয়ারা দার্শনিকদের রচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে Right of Man and eitiza নামে এক ঘোষণাপত্র জারি করেছিল। এই ঘোষণায় বুর্জোয়ারা সম্পত্তির অধিকারকে বেশি জোর দেয়। বিনা কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না একথা ঘোষণাপত্রে ছিল। কিন্তু সার্বজনীন ভোটাধিকারকে স্বীকার করা হ্যানি। এ থেকে বোঝা যায়। বুর্জোয়ারা সাধারণের অধিকারের চেয়ে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় বেশি যত্নবান ছিল। কৃষক বিদ্রোহকে প্রশমিত করার জন্য তারা কৃষকদের জন্য কিছু করতে মনস্থির করেছিল। তারা সামন্ততন্ত্র ও সামন্ততান্ত্রিক করের বিরুদ্ধে ছিল। বিচারবিভাগের দুর্নীতি বন্ধ করতে তারা সচেষ্ট হয়। তারা সুবিধাভোগীদের বিশেষ সুবিধা রোধ করেন। পুরানো দিনের অবিচার গুলিকে দূর করেন। ফলে আইন পরিষদে বুর্জোয়াদের একক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
বুর্জোয়াদের পরিচালনায় রাজতন্ত্রকে শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত করা হয় এবং আইন পরিষদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। রাজা যদিও শাসনবিভাগের প্রধান ছিলেন কিন্তু আইন ও বিচার বিভাগে তার কোন ভূমিকা ছিল না। যে আইনসভা গঠিত হয় তা কিন্তু সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে হয়নি, ভোটাধিকার সম্পত্তির ভিত্তিতে হয়েছিল। যে সব প্রার্থী নির্বাচিত হবেন তাদেরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হতে হবে বলে ঘোষণা করা হয়। জনগণের অধিকাংশকে ‘নিষ্ক্রিয় নাগরিক করে তাদের ভোটাধিকারকে হরণ করা হয়। রুশোর বাণী : ‘মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে’ তা কথার কথায় পরিণত হয়।
প্রদেশগুলিকে সংবিধান অনুযায়ী ৮৩টি বিভাগে বিভক্ত করা হয় এবং প্রাদেশিক শাসনে বুর্জোয়াদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রদেশের উপর কেন্দ্রের আধিপত্য অনেক কমে যায়। বুর্জোয়াদের আধিপত্য ও শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। সংবিধানসভা রাজার উপর আস্থা রাখতে পারেনি। এই সভা দেশের জন্য শাসনব্যবস্থার সঠিক রূপায়ণের চেয়ে রাজার উপর কর্তৃত্ব করতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। আইন সভার সঙ্গে রাজার কোন যোগাযোগ ছিল না। আইন সভার সঙ্গে রাজার ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। খাদ্যসংকট ও অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বুর্জোয়াদের প্রভাব কমতে থাকে। জেকোবিন দল বুর্জোয়াদের ক্ষমতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বুর্জোয়াদের স্বার্থ চরিতার্থ হলে বিপ্লব সম্পর্কে তাদের মনে উদাসীনতা আসে। তারা মনে করে বিপ্লব জয়যুক্ত হয়েছে।
মূল্যায়ন:
সামগ্রিকভাবে বলা যায় ফরাসী বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সুবিধাভোগী শ্রেণীর সুবিধাকে তারা নষ্ট করেছিল। সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের পতনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বুর্জোয়া বিপ্লব জাতীয় বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছিল। ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস হল কয়েকটি শ্রেণী বিপ্লবের সমষ্টি। বুর্জোয়ারা তার অংশ ছিল।