অবশিল্পায়ন তত্ত্ব কি অলীক কল্পনা মাত্র ছিল

অবশিল্পায়ন তত্ত্ব কি অলীক কল্পনা মাত্র ছিল।অবশিল্পায়ন কি একটি অলীক ভাবনা ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা :

অবশিল্পায়ন বা De-industrialisation এর আভিধানিক অর্থ হল শিল্পায়নের বিপরীত প্রতিক্রিয়া অথবা প্রচলিত শিল্পের ধ্বংসশোধন। আধুনিক অর্থনীতি বিদদের মতে, কোন স্থানে প্রচলিত শিল্প গুলি যদি বন্ধ হয়ে যায় এবং তার জায়গায় যদি নতুন কোন শিল্প গড়ে না ওঠে তাহলে সেই প্রক্রিয়া বা অবস্থাকে অবশিল্পায়ন বলা চলে। ঐতিহাসিক সব্যসাচী ভট্টাচার্য লিখেছেন”শিল্পায়নের লক্ষণ হল কৃষিকাজ থেকে উৎপন্ন জাতীয় আয়ের অংশের তুলনায় অনুপাতে শিল্পকর্ম থেকে উৎপন্ন অংশ বাড়ে, শিল্পকর্মী নিয়োজিত জনসংখ্যা কৃষি কাজে নিয়োজিত মানুষের অনুপাতে বৃদ্ধি পায়। এর বিপরীত যদি হয় অর্থাৎ যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষ আবাদের জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় আয়ের কৃষিজ ও অংশ বাড়তে আর শিল্পয অংশ কমতে থাকে তাকে অবশিল্পায়ন বলা চলে।

অবশিল্পায়ন তত্ত্ব কি অলীক কল্পনা মাত্র/অলীক ভাবনা  ছিল।

সাধারণভাবে উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় হস্তশিল্পের বিপর্যয়কে ঐতিহাসিকরা অবশিল্পায়ন বা বি শিল্পায়ন, শিল্প বিনাসন, বা শিল্পাই এর রোধ নামে অভিহিত করেছেন। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানারে, থেকে শুরু করে মার্কসীয় ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত, ইরফান হাবিব, দীপান চন্দ্র, সুমিত সরকার প্রমুখ ভারতে উপনিবেশিক যুগে অবশিল্পায়নের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। আবার ড্যানিয়েল থানার এবং বিশেষ করে মরিস ডি মরিস এর বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তাকে অতি কথন বা মিথ (myth) বলতে চেয়েছেন।

মুঘল যুগের শেষ ভাগের সঙ্গে সমকালীন ব্রিটেন অর্থাৎ প্রাক শিল্প বিপ্লব যুগের বৃটেনের পরিস্থিতির তুলনা করলে দেখা যাবে ভারতের দেশয শিল্পজাত দ্রব্যের গুণমান ও তাদের পরিচিতি ব্রিটেনের তুলনায় বেশি ছিল। বৃহদায়াতন নয় হস্তশিল্পই ছিল ভারতীয় শিল্পের ভিত্তি। বস্ত্র , মৃৎশিল্প, চর্ম, ধাতব, রাসায়নিক প্রভৃতি শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা ছিল এশিয়া মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে। বিশেষত সুতিবস্ত্র ও রেশমী বস্ত্রের খ্যাতি ছিল জগৎ জোড়া। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনে ভারতের সমাজ অর্থনীতিতে যে শোষণ ও লুণ্ঠন হয় তা সুপ প্রাচীন ভারতীয় হস্ত্র শিল্পের সার্বিক বিনাশ ডেকে আনে। পশ্চিম পুঁজিবাদের এই অগ্রাসনে দেশীয় শিল্পের বিপর্যয়কে ঐতিহাসিকরা অব শিল্পায়ন বলেছেন।

আদি জাতীয়তাবাদী লেখক রায় প্রথম ভারতীয় শিল্পের পশ্চাদপদ তাই জন্য দেশীয় শিল্পের বিনাশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাদের মতে ভারতবর্ষের মূল সমস্যা হলো শিল্পের অবস্থা কেন্দ্রিক এবং ভারতের সীমানাহীন দারিদ্রের কারণ অস্ত্র শিল্পের বিনাশ ও তার পরিপূরক হিসেবে আধুনিক বৃহদায়তন শিল্পের সীমিত বিনাশ। তাপ ও অন্যান্য হস্তশিল্প লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিলেও ভারত বর্ষ থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচামালের নিষ্কাশন এবং ব্রিটেনের কারখানায় প্রস্তুত সুতি বস্ত্র ভারতবর্ষের বাজারে ছেয়ে যাওয়াই যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তার পরিণতি ছিল বেকারত্ব বৃদ্ধি।

1809-10 নাগাদ মোট জনসংখ্যার 18.6% ছিল হস্তশিল্পী ,1901 এ জনসংখ্যা তথ্য তা কমে দাঁড়িয়েছিল 8.5%এ অমিয়কুমার বাগচীর সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, 1809-13 তে শিল্পী কারিগরিদের মোট জনসংখ্যার 62.3% ছিল তাঁতি। 1901 এ কমে দাঁড়ায় 15% এ । 1828 থেকে 1840 এর মধ্যে ভারত ব্রিটেন বাণিজ্যের ভারতের আমদানির তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ বেশি থাকায় তখনও পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে ছিল কিন্তু এই বাণিজ্য প্রক্রিয়ার সুনির্দিষ্ট আধুনিক বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে ভারত থেকে ব্রিটেনে রপ্তানি হত কাঁচামাল ও ব্রিটেন থেকে আমদানি হত শিল্পজাত পণ্য।

উনবিংশ শতকে অবশিল্পায়নের কারণে অনুসন্ধান করতে গিয়ে গ্যাড়গিল বলেছেন রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাতে ক্ষমতাচ্যুত রাজ্য মহারাজাদের সৌখিন বস্ত্রের চাহিদা কমে যায়। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও সারাদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা প্রাথমিক উৎপাদনের উপর কোম্পানির এজেন্ট দেশীয় গমন্থা এবং নিম্নতন কর্মচারীদের অত্যাচার ছিল কুটির বা হস্তশিল্পের ধ্বংসের কারণ। কিন্তু সারদা রাজু দেখেছেন যে অষ্টাদশ শতকের দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধবিগ্রহ সংক্রান্ত গোলযোগের ফলে ওই অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী তাঁতিদের বসতি গুলির বিশেষ ক্ষতি হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে 1813 পর দুটি মূল পরিবর্তন লক্ষণীয়

1) ভারতে কুটির শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানি গ্রাস করে। কেবলমাত্র কাঁচামাল ইংল্যান্ডে পাঠানো।

2)ল্যাঙ্কা ম্যানচেস্টার, লংকা সায়ারের মিলে তৈরি শ্রুতিবস্ত্রের ভারতে অবাধ আমদানি অসম শুল্কহারের কারণে ইংল্যান্ড জাত কাপড় প্রায় বিনাশুলকে ভারতে আসতে থাকে এবং ভারতীয় শিল্পজাত দ্রব্যাদির ওপর চাপানো হয় বিরাট শুল্কের বোঝা। 1815 খ্রিস্টাব্দে একটি আইনে ইংল্যান্ডের শিল্পজাত বস্ত্রের উপর মাত্র আড়াই শতাংশ আমদানি শুল্ক চাপানো হয়। অথচ 1813 তে বাংলার মোসলিনের ওপর ৪৪ শতাংশ এবং ক্যালিকো কাপড়ের ওপর 85% আমদানি শুল্ক কে ব্রিটিশ সরকার ধার্য করে। সুতরাং বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার জন্য নয় ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব ও উপনিবেশিক শুল্কনীতির কারণেই ভারতের বস্ত্র শিল্পের ধ্বংস হয়েছিল। বলে মনে করেন রাসব্রুক উইলিয়ামস, হ্যামিলটন, রমেশ চন্দ্র দত্ত, রানাডে, রজনী পাণ দত্ত, নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ, অমিও বাগচি প্রমুখ। একদিকে কাঁচামালের অভাব কম মূল্যে মিলে তৈরি বিলেতি কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি, ও অসম শুল্কনিতি ভারতীয় বস্ত্র শিল্পকে পিছনে ফেলে দেয়।

ড্যানিয়েল থানারের মতে, অবশিল্পায়নের যদি কোন ঝোক থাকে তবে তা 1815 থেকে1880 এর মধ্যে তারপরে নয়। 1881-1931 সময়সীমায় আদমশুমারি তে উল্লিখিত পেশা তাত্ত্বিক তথ্যের সংখ্যা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছেন যে হস্তশিল্পের অবক্ষয় হয়েছিল। এ কথা সংখ্যাতত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করা কঠিন এবং শিল্পের উপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা হ্রাসের কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।। অন্যদিকে মার্কিন গবেষক মরিস ডি মরিস অবশিল্পায়ানের তত্ত্বকে অলীক কল্পনা বা অলীক ভাবনা (কল্প কাহিনী)বা myth বলে নসাৎ করেছেন। তার যুক্তি

  • 1) উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে বাংলার তাঁতিদের সংখ্যা মোটেই কমেনি আর তাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ও হয়নি।
  • 2) মরিসের দ্বিতীয় যুক্তি শিল্প দ্রব্যের আমদানি মানেই অবশিল্পায়ন নয় যদি জনসংখ্যা ও জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ঘটে তবে বিদেশি পণ্য সামগ্রী আমদানি করা হলেও দেশীয় শিল্পের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
  • 3) ব্রিটেনে প্রস্তুত বস্ত্রাদী ভারতীয় হস্ত্র শিল্প উৎপাদনকে যেমন প্রতিযোগিতায় মুখে দাঁড় করিয়েছিল তেমনি বৃটেনের তৈরি কমদামী সুতো আমদানি হওয়ায় তাতে বাংলার তাঁতিদের সুবিধায় হয়েছিল।

মরিস,যে অবশিল্পায়ানের তত্ত্বকে অলীক কল্পনা বা অলীক ভাবনা বলেছেন, তার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন বহু দেশী ও বিদেশী ঐতিহাসিক। 1968 সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তোরামাৎসুই লিখেছেন যে উনবিংশ শতকে তাঁতিদের সংখ্যা কমে যায় এবং তাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। সব্যসাচী ভট্টাচার্য প্রশ্ন তুলেছেন, জনসংখ্যা ও জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ঘটলে বিদেশী পণ্য আমদানি সত্ত্বেও দেশি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

মরিসের এই যুক্তির সমর্থনে প্রমাণ কোথায় মরিস যখন যুক্তি দেখান যে কমদামি বিদেশি সুতো আমদানি করার ফলে তাঁতীরা সুবিধা পেয়েছিল তখন তিনি উল্লেখ করেননি যে বিদেশী বস্ত্র ভারতের বাজারে দখল করার ক্রাইম ১ দশক পরে সুতো আমদানির সূত্রপাত ঘটে। ফলে ছোট উৎপাদক তাঁতিরা তার পূর্বেই ধ্বংস হয়ে যায়, ইংল্যান্ডে কারিগরি উদ্ভবের ভিত্তিতে শিল্প বিপ্লব হওয়ার উৎপাদন ব্যয় প্রচুর পরিমাণে হ্রাস পায় । তাই এসব পণ্যের দাম ভারতীয় বস্ত্র শিল্পের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই কম ছিল।

মূল্যায়ন:

অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরীর মতে, এক ধরনের কারিগরি উদ্ভাবন ভারতে নয়, ইংল্যান্ডে সবাই সুতো ও বস্ত্র উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই ল্যাঙ্কা সায়ারের শিল্পপতিরা এই সুবিধা পায় বাংলার হস্তশিল্পরা নয়। বেপানচন্দ্র লিখেছেন, যে পরিমাণে সুতো আমদানি করা হয় তার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে বিদেশি কাপড় এদেশের বাজার ছেয়ে ফেলে।

বাংলার তাঁতিদের কমদামী বিদেশি বস্ত্রের সঙ্গে আসন প্রতিযোগিতায় নামতে হয় ফলে তাদের জীবন যাত্রার মানের উন্নতি নয় অধোগতি দেখা দিয়েছিল, আর তোরুমাৎসুর সহ অন্যান্য লেখকরা যখন মরিচসের বক্তব্য খন্ড করেছেন তখন বাংলার অবশিল্পায়ন ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপনিবেশিক শাসনের প্রতিঘাতে শুধু ভারতীয় শিল্প ধ্বংসই হয়নি পরবর্তী কাজের সুযোগও তা সৃষ্টি করেনি, পশ্চিমী পুঁজিবাদকে পথ করে দিতে ভারতীয় সমাজকে যেসব মূল্য দিতে হয়েছিল অবশিল্পায়ন ছিল তার অন্যতম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *