শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে আলোচনা কর। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
ভূমিকা:
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান (Educational Sociology), সমাজবিজ্ঞানের (Sociology) একটি শাখা হলেও, শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান তার নিজস্ব ক্ষেত্রে আজ সমৃদ্ধ। যে যে বিষয়গুলি শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানে প্রাধান্য পেয়েছে, যে গুলোকে কেন্দ্র করে তার আপন ক্ষেত্রের ভিত দৃঢ় করেছে, সেগুলো হল —
- শিক্ষার লক্ষ্য,
- পাঠক্রম,
- শিক্ষার পরিচালন,
- পারস্পরিক মানবিক সম্পর্ক,
- দলগত মানসিকতা প্রভৃতি।
[1] শিক্ষার লক্ষ্য:
আদিকাল হতে বর্তমানকাল মাঝের দীর্ঘপথ, ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে মানবগোষ্ঠী অতিক্রম করে এসেছে। আদিকালের মানুষ কিছু জন্মগত বৈশিষ্ট্য ও সহজসরল দৃষ্টিভঙ্গিকে পাথেয় করে শিক্ষা সম্বন্ধীয় কিছু কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণা অর্জন করে এবং সেগুলো সংরক্ষণ করে। সেই সংরক্ষিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণাগুলো ক্রমশ সমাজের আঙিনায় এসে সামাজিক ভাবধারায় নতুন রূপ নেয়। এই নতুন রূপ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে বহুলাংশে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এই দুই পরস্পর-বিরোধী ধারা থেকে জন্ম নেয় দুটি ভিন্ন মতবাদ (i) ব্যক্তিস্বার্থের বিকাশ সম্বন্ধীয় মতবাদ — ব্যক্তিতান্ত্রিক মতবাদ (Individualistic view) এবং (ii) সমাজস্বার্থ সংরক্ষণ সক্ষমীয় মতবাদ — সমাজতান্ত্রিক মতবাদ (Socialistic view) ।
ব্যক্তিতান্ত্রিক ভাবধারা থেকে জন্ম নিয়েছে শিক্ষায় ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য (Individualistic aim) এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা থেকে জন্ম নিয়েছে শিক্ষায় সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য (Socialistic aim)। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা শিক্ষাকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁদের মতে সমাজকল্যাপের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকল্যাণ সাধিত হতে পারে। সমাজকধনের মাধুর্য, সমাজবন্ধনের সামাজিক চেতনা, সামাজিক শক্তি এনে দেয় সুস্থ জীবনযাপনের রসদ নব নব উপহার। তাই সামাজিক কল্যাণসাধনই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।
হার্বার্ট স্পেনসার (Herbert Spencer), হেগেল (Hegel), রেমন্ট (Raymont) প্রমুখ শিক্ষাবিদ শিক্ষার লক্ষ্যে সমাজের কল্যাণসাধনে ব্রতী হতে বলেছেন। এ জন্য শিক্ষার যথার্থ লক্ষ্য স্থির করার জন্য শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান বিবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণা করে চলেছে। সামাজিক চাহিদা, আদর্শ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার লক্ষ্য কী হবে, সে সম্বন্ধে অন্বেষণ স্পৃহা জাগানোও ও শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানের (Educational Sociology) কাজ।
[2] পাঠক্রম:
শিক্ষার লক্ষ্যের পর পাঠক্রম নির্ধারণ প্রয়োজন, কারণ পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যের দ্বারে। উপনীত হওয়া যায়। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানে (Educational Sociology) আলোচিত হয়, শিক্ষার পাঠক্রম কী হবে, কী জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে প্রভৃতি। পাঠক্রমের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই পরিকল্পিত পথপ্রদর্শকরূপে শিক্ষার্থীদের তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।
[3] শিক্ষার পরিচালন:
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে সুষ্ঠু সামাজিক নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার হাত ধরে আসে। সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের জন্য দরকার শিক্ষালয়গুলোর যথার্থ সাংগঠনিক পরিকাঠামো এবং পরিচালন ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সুই নিয়ন্ত্রণ। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানে (Educational sociology) শিক্ষালয়গুলোর পরিচালনা ও প্রশাসন সম্পর্কিত প্রভৃতি দিক সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়।
[4] পারস্পরিক মানবিক সম্পর্ক:
মানুষ, মানুষের জন্য; মানুষ সমাজের জন্য; আবার সমাজ মানুষের জন্য। এই সমাজের মাঝেই মানুষের জন্ম, মানুষের বৃদ্ধি ও বিকাশ (Growth and development), সর্বশেষে লয় । সমাজবিজ্ঞান হল সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান, যে সমাজের অজ্ঞান মানুষের বাসভূমি, শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান ও পারস্পরিক মানবিক সম্পর্কের বিজ্ঞান।
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একটি শিক্ষামূলক সমাজে বাস করে। তাই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ John Dewey বলেছেন, “School is a simplified, purified and better balanced society”। তাই বিদ্যালয়রূপ পবিত্র শিক্ষামূলক সমাজে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, প্রশাসক প্রভৃতি সমাজজীবনের মতোই নিবিড় মানবিক সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা থাকে বা থাকেন।
[5] দলগত মানসিকতা:
শিক্ষালয়ে শিক্ষার্থীরা সামাজিক দল বা গোষ্ঠীভুক্ত সদস্যদের মতো আচরণ করে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে শিক্ষার্থী বাড়িতে একক অবস্থায় যেরকম আচরণ করে, শিক্ষালয়ে দলবদ্ধ অবস্থায় তার আচরণে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়; অবশ্য সে আচরণ ভালো হতে পারে, আবার খারাপ হতেও পারে। দলের প্রভাবে আচরণ নির্ধারণ করার পদ্ধতিকে বলা হয়, দলীয় গতিধর্মিতা (Group Dynamics) ।
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানে (Educational Sociology) দলগত মানসিকতা নির্ধারণের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবনাদর্শ গঠনে সহায়তা করে।
- উপসংহার:
- শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান (Educational sociology) শিখন-শিক্ষণ সহায়ক সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারণ করে, নির্ধারণ করে কীভাবে সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সমাজজীবনকে সমৃদ্ধ করার পঙ্খা। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সমাজজীবনের মেলবন্ধন রচনা করার গুরুদায়িত্ব শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান (Educational Sociology) গ্রহণ করে থাকে।