খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনা কর।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রধানত তিনটি ঘটনার দ্বারা বিশেষভাবে চিহ্নিত। ১. এই সময়েই ভারতে প্রচলিত বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, ধর্মান্দোলন শুরু হয়েছিল ।
২. এই শতাব্দীতেই ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অন্তত একটি অংশ বৈদেশিক (পারসিক) আক্রমণের শিকার হয়েছিল।
৩. ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটেছিল এই শতাব্দীতে, যা এই অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য বিষয়। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীকে রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়ের মর্যাদা দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, এর আগে অর্থাৎ বৈদিক যুগে বা তারও আগে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না।
মানুষ যখন বসবাস করত তখন তাদের পরিচালনার জন্য কোনো কাঠামো নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস, ঘটনাপঞ্জী ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমিত ও অস্পষ্ট। কেননা, প্রয়োজনের তুলনায় তথ্য অপ্রতুল, বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া এবং তুলনামূলকভাবে কম নির্ভরশীল। এ. এল. ব্যাশাম তাই বলেছেন যে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতবর্ষের ইতিহাস তার অতীতের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল এবং নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। এই সময় থেকেই ভারতের ইতিহাসে এমন কিছু মহান শাসকের পরিচয় আমরা পাই যাঁদের ঐতিহাসিকর সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকে না। সর্বোপরি, এই শতাব্দী থেকেই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস অনেকটা স্বচ্ছতর হয়ে ওঠে।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করে থাকে সমকালীন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকায় থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ ষোলোটি মহাজনপদ (ষোড়শ মহাজনপদ)-এ বিভক্ত ছিল। এতে প্রদত্ত ষোলটি মহাজনপদ হল যথাক্রমে কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বৃজি বা বজ্জি, মল্ল, চেদি, বৎস বা বংস, কুরু, পঞ্চাল, মৎস্য, শূরসেন, অশ্বক বা অসূসক, অবন্তী, গন্ধার ও কম্বোজ।
সমকালীন ভারতবর্ষ যে ষোলোটি ভাগে বিভক্ত ছিল সেকথা বলা হয়েছে অপর বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবস্তুতেও। তবে অঙ্গুত্তর নিকায়-তে উদ্ধৃত মহাজনপদগুলির সঙ্গে এর কিছু অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। গন্ধার ও কম্বোজ—এই দুটি মহাজনপদের উল্লেখ মহাবস্তুতে নেই ; এর পরিবর্তে পাঞ্জাব অথবা রাজপুতানার সিবি এবং মধ্যভারতের দশার্ণ—এই দুই মহাজনপদের কথা সেখানে স্থান পেয়েছে। জৈন গ্রন্থ ভগবতীসূত্র (‘ব্যাখ্যা প্রজ্ঞাপতি’)-তেও ষোড়শ মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য অঙ্গুত্তর নিকায়-তে উল্লেখিত মহাজনপদগুলির সঙ্গে ভগবতীসূত্রে উদ্ধৃত মহাজনপদগুলির কিছু তারতম্য আছে। ভগবতীসূত্রে উদ্ধৃত মহাজনপদগুলি হল অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ বা মগহ, মলয়, মালব (ক), অচ্ছ, বৎস (বচ্ছ), কচ্ছ, লাট বা রাঢ়, পাড় বা পাণ্ড্য, বজ্জি, মোলী বা মল্ল, কাশী, কোশল, অবাহ ও সত্তুত্তর।
‘অঙ্গুত্তর নিকায়’ ও ‘ভগবতীসূত্র’ গ্রন্থ দুটির মধ্যে মহাজনপদগুলির তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে যে অঙ্গ, মগধ, বৎস, বজ্জি, কাশী এবং কোশল—এই ছয়টি মহাজনপদ উভয় তালিকারই অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, ভগবতীসূত্রে যে মালব মহাজনপদের উল্লেখ আছে তা অঙ্গুত্তর নিকায়-র অবন্তীর সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। মোলী খুব সম্ভবত মল্ল-রই ভ্রান্তরূপ। অন্যান্য যে সমস্ত মহাজনপদগুলি জৈন গ্রন্থটিতে উল্লেখিত হয়েছে সেগুলি সবই নতুন, যার অনেকগুলি ভারতবর্ষের সুদূর দক্ষিণ ও পূর্বে অবস্থিত। ভগবতীসূত্রে নতুন মহাজনপদগুলির উল্লেখ খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণ করে যে বৌদ্ধ গ্রন্থের তুলনায় জৈন গ্রন্থটি কিছুটা পরবর্তীকালের। তাই খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনার জন্য বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘অঙ্গুত্তর নিকায়’-ই অধিকতর নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
ষোলোটি মহাজনপদ সম্বন্ধে বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা গেলেও এবিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ কোনো ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ছিল না; তা ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত। ‘অঙ্গুত্তর নিকায়’, ‘মহাবন্ধ’, ‘ভগবতীসূত্র’—এই তিনটি গ্রন্থে ষোড়শ মহাজনপদের উল্লেখ ঐ ধারণাকে দৃঢ়তর করে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ষোলোটি রাজ্যের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল রাজতন্ত্রের আওতাভুক্ত এবং কিছু ছিল অরাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি। এদের মধ্যে কোনো সম্ভাব ছিল না। সর্বদাই এক রাজনৈতিক অনৈক্য বিরাজমান ছিল। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকল্পে ঐ মহাজনপদগুলি একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত থাকত।
Thanks 😊
Most welcome, explore more content at studymamu.in