দ্বিশক্তি মৈত্রী স্বাক্ষরিত হবার ঘটনাক্রম বর্ননা কর। দ্বিশক্তি মৈত্রী স্বাক্ষরিত হবার প্রেক্ষাপট বা পটভূমি।
বিসমার্ক যতদিন ক্ষমতায় সমাসীন ছিলেন ততদিন ফ্রান্সের পক্ষে শক্তিশালী মিত্র পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বিসমার্ক অনুভব করেন ফ্রান্সের মিত্র হতে পারত অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া। এই দুই দেশ জার্মানির বিরোধিতা যাতে না করে সেজন্য বিসমার্ক সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৬৩ সালে পোলান্ডের বিদ্রোহের সময় তিনি রুশ জারকে সমর্থন করেছিলেন, সেজন্য তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা পেয়েছিলেন।
ক্রিমিয়া যুদ্ধের পর প্যারিসের শাস্তি চুক্তিতে রাশিয়ার আগ্রসনকে বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে পুনরায় আগ্রাসী নীতি গ্রহণে অগ্রসর হলে বিসমার্ক রুশজারকে উৎসাহিত করেন। ফলে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সহজেই বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হন। ১৮৬৬ সালে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করেও তিনি তার উপর অপমানকর শর্ত আরোপ করেননি। এজন্য অস্ট্রিয়া জার্মানির প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। পরিণতিতে বিসমার্ক এই দুই দেশের সঙ্গে ফ্রান্স বিরোধী তিন সম্রাটের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ফলে ইউরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্স মিত্রহীন হয়ে পড়েছিল।
ফরাসী নেতারা অনুভব করেন রাশিয়ার সঙ্গে তাদের মৈত্রী গড়ে তোলা সম্ভব হলে সব দিক দিয়েই ফ্রান্সের মঙ্গল হবে। ফ্রান্স ভবিষ্যৎ জার্মান আক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পাবে। কারণ, রাশিয়া ফ্রান্সের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হওয়ার পর যদি জার্মানি ফ্রান্সকে আক্রমণ করে তাহলে তাকে এক সাথে পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। তাই ফ্রান্স সব সময়েই রাশিয়ার মিত্রতা কামনা করেছিল। কিন্তু বিসমার্কের বিচক্ষণতার জন্য তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। এছাড়া রাশিয়ার স্বৈরাচারী জার প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্সকে সন্দেহ করত। রুশজারের প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে প্রচণ্ড অনীহা রুশ-ফরাসী মৈত্রীর পক্ষে প্রতিবন্ধকতা করেছিল তা বলাই বাহুল্য।
১৮৭৫ সালে রুশ-ফরাসী সম্পর্ক কিছুটা ভাল হয়। ফ্রান্সের অগ্রগতিকে জার্মানরা মেনে নিতে পারেনি। তারা যুদ্ধের হুমকি দিয়ে ফ্রান্সের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করার পরিকল্পনা নেয়। ১৮৭৫ সালের এই যুদ্ধের পরিবেশ ইংল্যান্ড এবং রাশিয়াকে জার্মান-বিরোধী করে দেয়। তাদের ভয় ছিল যুদ্ধ শুরু হলে ফ্রান্স। পুনরায় পরাজিত হবে এবং পরিণতিতে ইউরোপের শক্তিসাম্য নষ্ট হবে। সমগ্র ইউরোপের উপর জার্মান প্রভুত্ব কায়েম হবে। তাই ইংল্যান্ড ও রাশিয়া জার্মানকে সতর্ক করে দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল জার্মানি ফ্রান্সকে আক্রমণ করলে তারা চুপচাপ থাকবে না। রাশিয়ার বিরোধিতা ফ্রান্সের মনে তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রয়াসকে তীব্র করেছিল। অন্যদিকে, জার্মানির প্রতি রাশিয়ার সতর্কীকরণ এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলেছিল।
রাজনৈতিক ঝটিকা কেন্দ্ররূপে অভিহিত বলকান সমস্যাকে কেন্দ্র করে জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। বলকান সমস্যাকে মেটাবার জন্য ১৮৭৮ সালে বার্লিন সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন বিসমার্ক। সম্মেলনের পূর্বে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ‘সৎদালালের’ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়। তিনি অগ্নিয়ার স্বার্থকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বার্লিন সম্মেলনে তিনি অস্ট্রিয়ার পক্ষ সমর্থন করে স্যানস্টিফানো সন্ধির পরিবর্তন ঘটান। রাশিয়া বিরক্ত হয়ে তিন সম্রাটের সন্ধি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। সুতরাং বিসমার্কের অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অস্ট্রিয়া ও জার্মানির মধ্যে গোপন আলোচনা শুরু হয়।
অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী এইরেস্থালের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে ফ্রান্স কোন দিনই অস্ট্রিয়াকে আক্রমণ করবে না। তাই অস্ট্রিয়ার ফ্রান্স সম্পর্কে ভয়ের কোন কারণ নেই। তাদের একমাত্র ভয় রাশিয়াকে। স্বভাবতই রুশ আক্রমণের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য বা আত্মরক্ষার জন্য জার্মানির সাথে মিত্রতার প্রয়োজন আছে। সুতরাং অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ককে জানান যে জার্মান যদি সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে সব রকমের সাহায্য দিতে রাজী হয় তাহলে অস্ট্রিয়া জার্মানির সঙ্গে আত্মরক্ষা মূলক চুক্তিতে স্বাক্ষরে রাজী আছে এবং সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে জার্মানিকে সাহায্য করতে প্রস্তুত হবে। কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিসমার্কের কাছে এইরূপ চুক্তি জার্মানির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খুব প্রয়োজন বলে মনে হয়নি। কিন্তু অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী তার দাবী থেকে সরে আসতে রাজী ছিলেন না। তাই বিসমার্ক কিছুটা বাধ্য হয়ে অস্ট্রিয়ার সাথে আলোচনা শুরু করেন। এই প্রথম তিনি একজন ইউরোপীয় রাষ্ট্রনেতার কাছে নতী স্বীকার করেন।১৮৭৯ সালে অস্ট্রিয়া ও জার্মানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় দ্বৈতচুক্তি বা দ্বি শক্তি মৈত্রী (Dual Alliance)।
দ্বিশক্তি মৈত্রীর শর্তগুলি
দ্বিশক্তি মৈত্রীর শর্তগুলি ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত গোপন ছিল। এই সন্ধি দ্বারা স্থির হয় যে –
- দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যে-কোন একটি তৃতীয় রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হলে অপর রাষ্ট্র তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। অর্থাৎ রাশিয়া ও ফ্রান্সের আক্রমণ প্রতিহত করাই ছিল দ্বিশক্তি মৈত্রীর মূল উদ্দেশ্য।
- দ্বিশক্তি মৈত্রী ছিল জার্মান বিদেশনীতির ভিত্তি। বিসমার্ক যতদিন ক্ষমতাসীন ছিলেন ততদিন এই চুক্তির প্রকৃতি ছিল রক্ষণাত্মক। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের সময় এই চুক্তি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত এই চুক্তি টিকে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি কেন পরাজিত হয়েছিল?