নেপোলিয়নকে বিপ্লবের ধ্বংসকারী বলা হয় কেন।
জর্জ রুডের মতো ঐতিহাসিকরা মনে করেন নেপোলিয়ান বিপ্লবের সন্তান ছিলেন না। নেপোলিয়ান তাঁর আত্মজীবনী ‘Napoleonic legend’-এ ঘোষণা করেন “আমি বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি।” “আমি বিপ্লব আমি বিপ্লবের ধ্বংসকারী” যুক্তি এবং তথ্য দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় তিনি বিপ্লবের বিনাশকই ছিলেন।
নেপোলিয়নকে বিপ্লবের সন্তান বলা হয় কেন
বিপ্লব নেপোলিয়ানকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শীর্ষে তুলেছিল ঠিকই কিন্তু তিনি কি বিপ্লবী আদর্শের মর্যাদা দিয়েছিলেন? রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা থেকেই বিপ্লব হয়। রাজতন্ত্রের অবসান হয়, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সূত্র ধরেই তিনি কনসাল হয়েছিলেন। কিন্তু দেখা যায় তখন থেকেই তিনি সচেষ্ট ছিলেন নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য। কনসাল থেকে আজীবন কনসাল পরে সম্রাট হন। ক্ষমতায় উঠার এই প্রক্রিয়া কখনই বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিপ্লবের আদর্শকে হত্যা করে তিনি রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এটাই বিপ্লবের বিনাশক হিসাবে তার ভূমিকার যথেষ্ট প্রমাণ। বিপ্লবের আদর্শ ছিল মনোনয়ন নয় নির্বাচন। কিন্তু নেপোলিয়ান এই নীতিকে অনুসরণ করেননি। শাসনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে তিনি মনোনয়ন প্রথা চালু করেন। ফলে একনায়কতন্ত্র আরও জোরদার হয়। এটাও বিপ্লব ভাবনার বিরোধী।
বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ ছিল স্বাধীনতা। কিন্তু নেপোলিয়ানের কাজে এর কোন মূল্য ছিল না। ফরাসী বিপ্লবের স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন নিয়ে সব ক্ষমতা নিজে কুক্ষিগত করেন। ফরাসী সেনেট তাঁর আজ্ঞাবাহী যন্ত্রে পরিণত হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, বাক্ স্বাধীনতা হরণ, বিনা বিচারে গ্রেপ্তার এই সব নীতি গ্রহণ অবশ্যই স্বাধীনতার আদর্শের পরিপন্থী। তিনি ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ Liberty বা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষার কোন চেষ্টা করেননি।
তিনি যে পোপের সঙ্গে কনকরড্যাট চুক্তি স্বাক্ষর করেন সেটাও ছিল বিপ্লব আদর্শবিরোধী। ধর্মমীমাংসায় তিনি ক্যাথলিক চার্চের অনেক ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষাসংস্কারেও তিনি সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার আদর্শকে গ্রহণ করেননি। তার শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল একদল অনুগত নাগরিক তৈরি করা। তিনি দরিদ্র জনগণের জন্যে Law of Maximum এবং Law of Minimum কে পুনঃপ্রবর্তন করেননি। সর্বসাধারণের জন্য ভোটাধিকার দেননি। তিনি সাম্যের নীতি অনুসরণ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তিনি সামাজিক সাম্য অপেক্ষা সামাজিক বৈষম্যই সৃষ্টি করেন। তিনি বুর্জোয়া শ্রেণীকেই বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন। তিনি যে গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন তা ছিল মূল্যহীন।
মূল্যায়ন:
ঐতিহাসিক ওলার (Aulard) সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন নেপোলিয়ানকে “বিপ্লবের সন্তান’ বলা যাবে না,”নেপোলিয়ন বিপ্লবের ধ্বংসকারী” তাঁর কনসুলেট বা সম্রাটপদ লাভের ঘটনাকে ফরাসী বিপ্লবের সমাধিকাল বলা উচিৎ। ঐতিহাসিক ওয়েলস উল্লেখ করেছেন ইতিহাস নেপোলিয়ানকে যে সুযোগ এনে দিয়েছিল তিনি যদি তার ঠিকমত ব্যবহার করতেন তাহলে তিনি হতেন ইতিহাসের সূর্য। কিন্তু তিনি ক্ষমতার লোভে মুরগীর বাচ্চার গোবরের খাদ্য খোজার মান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে স্বৈরতন্ত্রের ক্ষমতাকে খুঁজে বেড়ান।