পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর । পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ । বৌদ্ধ ধর্মের বৈশিষ্ট্য।
ভূমিকা :
মৌর্য যুগ থেকেই বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত ছিল। ফাহিয়েন,হিউয়েন সাঙ এর রচনা এবং লেখসূত্র থেকে জানা যায় যে, তাম্রলিপ্ত, কুমিল্লা,কাজঙ্গল প্রভৃতি স্থানের বৌদ্ধ বিহার গড়ে ওঠে। ই-সিং এবং সেংটির রচনা থেকেও বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। সমতটের রাজবংশের সন্তান শীলভদ্র পরবর্তীকালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন যার বৌদ্ধ জগতে বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। অর্থাৎ অষ্টম শতকের বাংলায় পালদের উন্থানের আগে থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।
পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য :
[1] পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল পাল রাজারা প্রায় সকলেই বৌদ্ধ ধর্মাবলী ছিলেন। তাদের হীরে ধর্মচক্র দেখতে পাওয়া যায়। তাদের লেখমালার প্রারম্ভিক বর্ণনা শ্লোকটিও ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। পাল রাজারা নিজেদের বুদ্ধের পরম ভক্ত বা পরমসৌগত বলে পরিচিত দিয়েছেন। আনুমানিক 750 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে যখন বাংলায় পাল বংশের শাসন শুরু হয় সমকালীন ভারতের অন্যান্য অংশে বৌদ্ধ ধর্ম সহিষ্ণু হলেও পাল রাজাদের সৌদির ঘর ৪০০ বছরের রাজত্বকালে বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এ সময়ই বৌদ্ধ ধর্ম উত্তরে তিব্বত ও দক্ষিণে জম্বু দ্বীপ, সুমাত্রা, মালয়, প্রভৃতি দেশে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে, ধর্মপাল প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীল মহাবিহার ছাড়াও সোমপুর,ওদন্তপুর মহাবিহার, বরেন্দ্রের দেবী কোট, ও জগদ্দল, চট্টগ্রামের পন্ডিত বিহার, বিক্রমপুর ও পন্ডিতকেরা, প্রভৃতি বিহার গুলি বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল।
[2] শুধু বৌদ্ধ নয় কোন কোন পাল রাজা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও গ্রহণ করেন ফলে পাল যুগের ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্ম পরস্পরে সন্নিকটবর্তী হয়। উভয় ধর্মই মূর্তিপূজা, মন্ত্র পাঠ, তান্ত্রিক তার প্রভাব দেখা যায়। ইতিপূর্বেই বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। সর্বাস্তিবাদী, বৈভাষিক, সৌত্রান্তিক, যোগাচার, মাধ্যমিকবাদ, প্রভৃতি কূট তান্ত্রিক তার জালে সংকীর্ণ ছিল। কিন্তু পাল যুগীয় বাংলায় প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্ম তা থেকেও আলাদা ছিল এমনকি আধুনিক মহাযান মতবাদ, ও বজ্রযান, তন্ত্রযান, প্রভৃতি পরিণত হয়ে সম্পূর্ণ নবকালের ধারণ করে।
[3]পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কালচক্রযান, মন্ত্রযান। পাল যুগীয় বাংলা, বিহার তথা উত্তর ভারতে কালচক্রযান, মন্ত্রযান, ইত্যাদি যে বৌদ্ধ ধর্ম সম্প্রদায়গুলির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল তাদের মধ্যে ছোটখাটো প্রভেদ থাকলেও মতাদর্শন দিক থেকে যথেষ্ট ঐক্য ছিল। একে সহজযান বা সহজিয়াধর্ম বলা যেতে পারে। সহজযনী বৌধোগন মনে করেন সত্য উপলব্ধি অন্তদর্শন এবং এর জন্য সহজ বা স্বাভাবিক পন্থা গ্রহণ করা দরকার। এই সহজ পথ হলো বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির অনুবতি হওয়া দেহই সকল সাধনার উৎস, লক্ষ্য ও মাধ্যম। যৌগিক পদ্ধতিতে কায় সাধনা নাভি মূলে অবস্থিত নির্মাণ চক্রের নারী শক্তিকে জাগিয়ে তোলা ইত্যাদি হল সহজযানী মার্গ।
[4]মহাযানবাদের পুরনো পরমাথিক তত্ত্ব ও সাধন মার্গ। সাধারণের দুবোধ্য ছিল। উপরোক্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলীদের এক বিরাট অংশ আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত হওয়ায় আদিবাসী ধর্মবিশ্বাস,যাদুশক্তি প্রভৃতি বৌদ্ধ ধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়। তাছাড়া তিব্বত নেপাল ভুটান ইত্যাদি পার্বত্য অঞ্চলের সংস্কৃতিক প্রভাব ও মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে বিপ্লবত্মক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। এই রূপান্তর যজ্ঞে হে তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তান্ত্রিক ভাবনাই সমৃদ্ধ কিছু বৌদ্ধচার এবং যোগ সাধনায় সিদ্ধ একদল আচার্য যারা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত। সমকালীন বৈধ সূত্রে ৪৮ জন সিদ্ধাচার্যের উল্লেখ আছে। ক্রিস্টিয়ান নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী কালে সিদ্ধাচার্যগণ বেশ কিছু গ্রন্থা দিও রচনা করেছিলেন। তাদের মূল গ্রন্থ গুলি বিলুপ্ত হলেও তাদের তিব্বত সংস্করণ পাওয়া যায়। এদের রচিত কিছু দোহা ও চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয়েছে। সেদ্ধাচার্যের মধ্যে লুইপাদ, সরহপাদ, নাড়োপাদ, নাগার্জুন, তুল্লেপাদ, শবরপাদ,কাহুপাদ,ভুসুক ও কুক্বুরি পাদের নাম উল্লেখ দাবী রাখে।
[5] বৌধাচার ও সিদ্ধাচার্যরা সাধনায় চিরাচরিত পূজা আচারাদি অস্বীকার করে গূঢ়াত্বক মন্ত্র, সন্ত্র, ধারণী, বীজ, মন্ডল, প্রভৃতি ধ্যান ধারণার প্রবর্তন করেন এবং গৃহ্যযোগের মাহাত্ম্য প্রচার করেন। এর ফলে মহাযান ধর্ম বজ্রযান, সহজযান,ও কালচক্রযান এই তিনটি স্ত্রোত ধারায় প্রভাহিত হতে থাকে।
[6]পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের আর এক বৈশিষ্ট্য ছিল গুরুর স্থান। সহজযান ধর্মে গুরুর স্থান সর্বাগ্রে। একমাত্র গুরই পারেন এই রহস্য উন্মোচন করতে। বৈদিক ধর্ম পৌরাণিক পূজা পদ্ধতি জৈন এমনকি বৌধ ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি তীব্র শ্লেষ ও কটাক্ষ সহজযনী গ্রন্থগুলিতে স্থান পেয়েছে। বৌদ্ধ সহজযান মতাদর্শে জাতিভেদ ব্যবস্থারও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। এইভাবে সহজযানী সিদ্ধচাযরা প্রাচীন সংস্কার ও ধর্ম মতের তীব্র সমালোচনা করে যে স্বাধীন চিন্তা ও বিচার বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তা অভাবনীয়। একদিকে সূক্ষ্ম স্বাধীনচিন্তা এবং অন্যদিকে নির্বিচারে গরুর প্রতি আস্থা এই পরস্পর বিরুদ্ধ প্রবৃত্তির ওপর সহজযান ধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
[7] বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযানের মধ্যে কিছু কিছু সাধনগত পার্থক্য আছে। যোগ সাধনার বলে শরীরস্থ নাড়ি, নাড়িকেন্দ ও পঞ্চবায়ু আয়ত্ত করতে হতো। এ সকল গৃহ্য সাধন মার্গ সকলের পক্ষে প্রশস্ত ছিল না। শিষ্যের স্বাভাবিক প্রবণতা মাপকাঠিতে প্রথমে কুল নির্ণয় হতো এবং পরে গরুর নির্দেশে সাধন মার্গ নির্দিষ্ট হত। ক্রমে সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম ও তান্ত্রিক সাধনা একাকারে হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সহজিয়া ধর্ম সম্প্রদায়ের উপর বৈষ্ণব প্রভাব পড়লেও নাড়ি, চক্র প্রভৃতি প্রাচীন বৌদ্ধ যোগাসন রীতি কখনোই পরিত্যাক্ত হয়নি।
[8]সহজিয়া ধর্মের বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে সমাজের নিম্নস্তরের (ডোম,মুচি,চন্ডাল ইত্যাদি) মধ্যেই এই ধর্মের বিশেষ প্রসার ঘটেছিল সম্ভবত জাতিভেদ প্রথা কে অস্বীকার করার জন্যই। বলা বাহুল্য অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের রূপান্তরের উপর বাঙালির প্রভাবই বেশি। এই রূপান্তর আবার বাংলার অন্যান্য ধর্মের উপরে প্রভাব বিস্তার করে বাংলা ধর্ম ও সমাজে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, ফলে বাংলা থেকে তথাকথিত বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হলেও বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের চিহ্ন বা লক্ষণ গুলি রয়েগেছে।