ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ কি ছিল। ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ।
ভূমিকা:
লেন্ডের, মনিয়ের, মর্গ স্টিফেন্স প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন ফরাসী বিপ্লবের পিছনে ছিল অর্থনৈতিক কারণ। ফ্রান্সের আর্থিক সংকট এই বিপ্লবের জন্য দায়ী। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে আর্থিক দিক দিয়ে ফ্রান্স ছিল এমন এক দেশ যার রাজকোষ ছিল। শূন্য রাজস্বব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিমূলক। অবশ্য সব ঐতিহাসিকই এই বক্তব্যকে মানেন না।
ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ।
আর্থিক অবস্থা:
লাদুরি (Ladurie) মনে করেন বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা বেশ ভাল ছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, সামুদ্রিক রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছিল। লাদুরি মতে ১৭৩০ থেকে ১৭৭০ পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমনকি লেফেভরও স্বীকার করেছেন ফ্রান্সের কয়েকটি শহরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল। বাণিজ্যজাত মূলধন বেড়েছিল বলে ধনী বণিকরা রাজাকে প্রয়োজনে ঋণ দিত। তবে লেভের মনে করেন মধ্যযুগীয় মানসিকতায় আচ্ছন্ন ফ্রান্সের আর্থসামাজিক কাঠামোতে কোন পরিবর্তন হয়নি। ফ্রান্সের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। কিন্তু কৃষির আধুনিকীকরণ হয়নি। কৃষি ও কৃষকদের উন্নতির দিকে রাজতন্ত্রের কোন লক্ষ ছিল না। ফরাসী সরকারের শিল্পবিকাশ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। মূলতঃ ১৭৭০ সালের পর থেকে ফ্রান্সে অর্থনৈতিক সংকটের ছায়া নেমে আসে।
ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা:
ফ্রান্সের আর্থিক সংকটের মূল কারণ হল বুর্বো রাজাদের গৃহীত অর্থনীতি। যাদের কর দেওয়ার সামর্থ্য ছিল অর্থাৎ যাজক ও অভিজাত তারা কর দেওয়া থেকে মুক্ত ছিল। ফলে রাষ্ট্রের ব্যয় সংকুলানের জন্য অতিরিক্ত অর্থসংগ্রহের কোন পথ ছিল না। বাৎসরিক ঘাটতি ক্রমশই বাড়তে থাকে। ত্রুটিপূর্ণ করব্যবস্থার জন্য তৃতীয় শ্রেণীকে বিশেষ করে কৃষকশ্রেণীকে করভার বহন করতে হত। মোট আদায়কৃত করের ৯৫ ভাগ সাধারণ মানুষকে বহন করতে হত। কৃষকরা রাজ্যকে দিও টেইল, গ্যাবেলা, ক্যাপিটেশন, ডিটিংয়েছে। তারা গীর্জাকে নিত টাইদ। এছাড়াও সামন্ত প্রভুকে কর দিতে হত, তাদেরকে বেগার শ্রম দিতে হত। করভারে জর্জরিত কৃষকদের পক্ষে কৃষির উন্নতির দিকে নজর দেওয়া সম্ভব ছিল না।
খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি:
লা ব্রুস্-এর মতে, অষ্টাদশ শতকের ফরাসী কৃষকেরা ছিল সবচেয়ে শোষিত শ্রেণী। কালাইল উল্লেখ করেছেন ফরাসী কৃষকদের এক তৃতীয়াংশ বছরের অধিকাংশ সময় আলু খেয়ে থাকত। কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় সরকারের সংকট বৃদ্ধি পায়। কৃষি ব্যবস্থা থেকে সংকট ছড়িয়ে পড়ে শিল্পক্ষেত্রে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। দিন আনা খেটে খাওয়া মানুষদের আয়ের পরিমাণ কমে যায় এবং তারা যে আয় করত তার সিংহভাগ খরচ হত খাদ্য কেনার জন্য। কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে উঠে। তাই সঙ্গত কারণে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় ফরাসী বিপ্লবের প্রকৃত নায়ক ছিল দরিদ্র হতভাগ্য ক্ষুধার্ত জনতা ।
কর আদায়ের কঠোরতা:
কর আদায়ের পদ্ধতিও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। রাজস্ব আদায়কারীদের আচরণ ছিল নেকড়ের মত। অনেক সময় সরকার কর আদায়ের অধিকার অভিজাতদের হাতে ছেড়ে দিত। একদিকে ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা অন্যদিকে কর আদায়ের কঠোরতা কৃষকদের অবস্থানকে জীবন মৃত করেছিল। এ্যাডাম স্মিথ তৎকালের ফ্রান্সকে অর্থনৈতিক প্রাপ্তির যাদুঘর’ বলেছেন।
প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি:
অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টিতে বুর্বোরাজাদের অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধনীতি বিশেষভাবে দায়ী ছিল। চতুর্দশ লুই-এর সময় যুদ্ধের জন্য প্রচুর অর্থব্যয় হয়। পঞ্চদশ লুই-এর রাজত্বকালে ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ ও সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এই দুই যুদ্ধে ফ্রান্স জয়লাভ করতে পারেনি। ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে উঠে। ষোড়শ লুইও আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধে ফ্রান্সের ব্যয় হয় ১,৮০০,০০০,০০ থেকে ২,০০০,০০০,০০০ লিত্র। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের বিনিময়ে ফ্রান্স কিছুই পায়নি। ফ্রান্সের অর্থনীতি দেউলে হয়ে যায়।
রাজতন্ত্রের বিলাসপ্রিয়তা:
রাজাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ফ্রান্সের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। প্রজাপতি রাজা পঞ্চদশ লুই ছিলেন বিলাসের প্রতীক। শিকার ও নারীদেহলোভী এই রাজার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হত। তার রানীও স্বামীর মতো অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। ষোড়শ লুই ও তার রানী মেরি আঁতোয়ানেত ছিলেন আড়ম্বরপ্রিয়তার শীর্ষে। গুডউইন দেখিয়েছেন ভার্সাই রাজপ্রাসাদে ১৮ হাজার কর্মচারি নিযুক্ত ছিল। রানীর চাকরের সংখ্যা ছিল ৫০০ জন। নিত্যনতুন পোশাকে বহু অর্থ ব্যয় হত। এজন্য গুডউইন বলেছেন ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক সমস্যায় মূল কথা হল বিশাল পরিমাণ ব্যয়ের বোঝা লাঘবে সরকারের অক্ষমতা।
মুদ্রাস্ফীতি:
মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দেয়। ডেভিড টমসনের মতে ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং দ্রব্যমূল্য ৬৫% বৃদ্ধি পায় কিন্তু সেই হারে আয় বৃদ্ধি হয়নি। রুটির দাম ৫০% বৃদ্ধি পায়। রুটির জন্য দাঙ্গা আরম্ভ হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় শস্যহানি ঘটায়। কৃষকরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে। ডেভিড টমসনের মতে এই পরিস্থিতিতে দাঙ্গা আরম্ভ হয় এবং গ্রামাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের সূচনা হয়। বুর্বো সরকার এই সংকটের সমাধান করতে পারে নি। যদিও ষোড়শ লুই এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চারজনকে পরপর অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন—কিন্তু অভিজাত ও যাজক শ্রেণী কোন কর দিতে রাজী হয়নি। অর্থসংগ্রহের আর কোন উপায় না পেয়ে তিনি জাতীয় সভায় অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন এবং এর পরই শুরু হয় বিপ্লব।
মূল্যায়ন:
ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি, রাজতন্ত্রের বিলাসপ্রিয়তা, ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা, কর আদায়ের কঠোরতা ফ্রান্সের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। ১৭৩৩ থেকে ১৭৮৩’র মধ্যে ফ্রান্স চারটি যুদ্ধে অংশ নিয়ে খরচ করেছিল ৪,০০০,০০০,০০০ লিভ। ঋণগ্রস্ত ফ্রান্সকে সুদ হিসাবে প্রচুর টাকা দিতে হয়েছিল। ১৭৮৮ খ্রিঃ রাষ্ট্রের মোট আয়ের ৭৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ও ঋণশোধে ব্যয় হয়েছিল। আর্থিক সংকটকে দূর করার কোন পরিকল্পনা সরকারের ছিল না। ফলে দরিদ্র জনগণের অবস্থা ক্রমশই খারাপ হয়ে যায়। অর্থনৈতিক কারণ যে ফরাসী বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল এতে কোন সন্দেহ নেই, অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
Thank you