ত্রিপাক্ষিক সংগ্রামের কারণ ও ফলাফল এবং তাৎপর্য।
ত্রিপাক্ষিক সংগ্রাম কাকে বলে
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের শেষার্ধে আর্যাবর্তের প্রাধান্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে, পাল, গুর্জর প্রতিহার, এবং রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে এক ত্রিপক্ষীয় দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম শুরু হয় যার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল কনৌজ অধিকার। এটি ত্রিপাক্ষিক সংগ্রাম বা ত্রিশক্তি সংগ্রাম (ত্রিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব) নামে পরিচিত । খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের শেষার্ধে পাল, গুর্জর প্রতিহার, এবং রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে ত্রিশক্তি সংগ্রাম হয়েছিল। ত্রিশক্তি সংগ্রাম দুশো বছর (750-950) ধরে চলেছিল।ত্রিশক্তি সংগ্রাম 750 সালে হয়েছিল ।ত্রিশক্তি সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী তিনটি শক্তি ছিল পাল, গুর্জর প্রতিহার, এবং রাষ্ট্রকূট।
![]() |
ত্রিপাক্ষিক সংগ্রাম |
কারণ বা প্রেক্ষাপটঃ
ত্রিপাক্ষিক সংগ্রামের কারণ ছিল কনৌজ অধিকার।পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধনের সময় থেকেই কনৌজ (কনৌজের গুরুত্ব) উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আধিপত্য কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। মালব রাজ দেবগুপ্ত এবং বাংলার শাসক শশাঙ্ক কনৌজ অধিকারের প্রয়াসে ব্যর্থ হন। সমৃদ্ধ গাঙ্গেও উপত্যাকা অবস্থানের জন্য কনৌজ ভারতীয় নিপতিকুলের আছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল । মানুষের মৃত্যুর পর ১০০ বছর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্যিক ঐক্য ছিল না। কনৌজ তার পূর্ব মর্যাদা হারালেও ভারতীয় রাজাদের মধ্যে এই ধারণা বহুমূল ছিল যে কনৌজি ছিল সার্বভৌম সাম্রাজ্যের প্রতীক।
ত্রিশক্তি সংগ্রামের প্রধান তিনটি শক্তি ছিল পাল,গুর্জর প্রতিহার, ও রাষ্ট্রকূট। ত্রিপাক্ষিক এই দ্বন্দ্বের প্রথম পক্ষ ছিল বাংলার পাল রাজারা, দ্বিতীয় শক্তি ছিল দাক্ষিণাত্যের পরাক্রান্ত রাষ্ট্রকূটরা এবং তৃতীয় পক্ষ ছিল রাজপুতানার, গুর্জর প্রতিহার। প্রতিদ্বন্ধী রাষ্ট্রকূটরা শেষত্তদের “দ্বাররক্ষক” নিম্নবর্গের মানুষ বলে গণ্য করতেন।
ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে , ভারতের মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থানের জন্য রাষ্ট্রকূটরা দুই অঞ্চলের ওপর আধিপত্য স্থাপন করে সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রকূট আমলে অভয় অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়ে এসেছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের চালুক্য শক্তির স্থলটি সিক্ত হয় রাষ্ট্রকূটরা আর মালব রাজপুতানায় প্রবল হয়ে ওঠে গুর্জর প্রতিহাররা। বাংলার শক্তিশালী ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ পাল রাজারা পরাক্রান্ত এই দুই রাজ্যের সঙ্গে শক্তির পরীক্ষার অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
গুরুত্ব বা তাৎপর্যঃ
এই ত্রিপাক্ষিক দ্বন্ধে কোন পক্ষই চূড়ান্ত জয় লাভ করেনি। প্রথম দিকে প্রতিহাররা জয়লাভ হলেও আরব পাল ও রাষ্ট্রকুদ্ধের সঙ্গে দ্বন্ধে তাদের শক্তি ক্ষয় হয়েছিল। দাক্ষিণাত্য জয়ের চেষ্টা কখনো করেননি। প্রকৃতপক্ষে এই দ্বন্দ্বে জড়িত তিন পক্ষই ছিল পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুলি থেকে। কেউই মধ্যদেশের রাজশক্তি ছিল না। ভারতীয় সাম্রাজ্যের হ্যাপিন্ড কনৌজ অধিকারের লক্ষ্যেই তাদের নিজেদের মধ্যে শক্তির অপচয় শুরু হয়েছিল। বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার কোন ক্ষমতায় তাদের ছিল না।
ত্রিপাক্ষিক এই দীর্ঘ সংগ্রামকে ড: দীনেশচন্দ্র সরকার চতুপক্ষীয় সংগ্রাম বলার পক্ষপাতী। তিনি এই ত্রিশক্তি সংগ্রামে আয়ুধ রাজাদের ভূমিকা, প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই সংঘর্ষ ছিল পাল আয়ুধ সংগ্রাম অর্থাৎ গৌড় কান্ধ্যকুঞ্জের সংঘাতের একটা নতুন পর্যায় যাতে আয়ুধ-পক্ষে প্রথমে গুর্জর প্রতিহার এবং পরে গুর্জর প্রতিহার বিজয়ী রাষ্ট্রকূটরা যোগ দিয়েছিলেন সুতরাং, এই দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম ছিল চারটি রাজ্যের সংগ্রাম।
বাংলার পাল রাজাদের খালিমপুর, মুঙ্গের তাম্রশাসন, বদল স্তম্ভলেখ, প্রতিহার রাজাদের দৌলতপুর ও বরাহ লেখ এবং রাষ্ট্রকূটদের সংজান ও সিরপুর লেখ , গুজরাতি কবি সোদধালা এবং বাঙালি কবি সন্ধ্যাকর নন্দী লেখা থেকে এই ত্রিপক্ষীর সংগ্রামের কথা জানা যায়। ,বাংলার পাল রাজা ধর্মপাল কনৌজ দখলের উদ্দেশ্যে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলে প্রতিহার রাজ বৎস রাজ তাকে দোয়াবের কাছে যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং কোন যে বৎস্যরাজ তার প্রতিনিধি ইন্দ্রায়ুধকে বসান। অমতি বিলম্বে রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুব শক্তি সাম্য বজায় রাখার জন্য হস্তক্ষেপ করে বৎস্যরাজকে পরাজিত করেন এবং বৎস্যরাজ প্রাণ রক্ষার জন্য রাজপুতানার মরু অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। গুর্জর প্রতিহারদের সঙ্গে রাষ্ট্রকুদ্ধের মানব ও গুজরাটকে নিয়ে বিরোধ ছিল। ধ্রুব শুধু বৎস্যরাজকে পরাজিত করেই ক্ষান্ত হননি, ধর্মপাল কে ও পরাজিত করেন।
ধ্রুব দাক্ষিণাত্যে ফিরে যাওয়ায় উত্তর ভারতে তার সামরিক জয় স্থায়ী হয়নি। ধর্মপাল আর্যাবতের রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে কনৌজ অধিকার করেন। ভাগলপুর তাম্র শাসনে বলা হয়েছে যে , ধর্মপাল বৎস্যরাজের প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করে স্বপ্রতিনিধি চক্রায়ুধকে কনৌজে স্থাপন করেন। কিন্তু কালের মধ্যে ধ্রবর মৃত্যু এবং তিনি যেভাবে প্রতিহার শক্তিকে ধ্বংস করেছিলেন পালদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না। মঙ্গের লেখ অনুযায়ী অসময় ধর্মপাল উত্তর ভারতের অনেক স্থান অধিকার করে হিমালয়ের গাড়োয়াল ও কুমায়ুন পর্যন্ত অগ্রসর হন।
কিন্তু ধর্মপালের এই সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজ আক্রমণ করে তা অধিকার করে নেন। যোধপুর লেখতে বলা হয়েছে দ্বিতীয় নাগভট্টের সঙ্গে তার সামন্ত রাজারা চোখ দিয়েছিল। চক্রায়ুধকে পরাস্ত করে কনৌজ অধিকার করেছিলেন এবং সম্ভবত তিনি পাল রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। পাল প্রতিহার দ্বন্দ্ব চলাকালীন রাষ্ট্রকূট রাজা, তৃতীয় গোবিন্দ দুটি কারণে হস্তক্ষেপ করেন।
প্রথমত, ধর্মপালের রানী ছিলেন রাষ্ট্রকূট রাজকন্যা।দ্বিতীয়ত, প্রতিহার বিজয়ের ফলে আর্যাবাতের রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা ছিল। তৃতীয় গোবিন্দ বুন্দেলখন্ডের যুদ্ধে দ্বিতীয় নাগভট্ট কে পরাস্ত করেন। এবং ধর্মপাল ও তার প্রতিনিধি চক্রায়ুধকে পরাস্ত করে অপসৃত করেন।
তৃতীয় গোবিন্দ এরপর দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে ধর্মপাল পুনরায় কনৌজ অধিকার করেন। ড: রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে,800 খ্রিষ্টাব্দ ধর্মপালের মৃত্যুর আগে পাল সাম্রাজ্য যে পূর্ব গৌরব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিল তা দেব পালের রাজ্যসীমা থেকেই বোঝা যায়। ধর্মপালের পুত্র দেবপাল এই ত্রিপক্ষীয় সংগ্রাম চালিয়ে যান। নাগভট্টের উত্তরাধিকারী রামভদ্র তার কাছে পরাস্ত হন। রাষ্ট্রকূট রাজ অযোঘবর্ষের একটি লেখতে বলা হয়েছে যে, তিনি বঙ্গ জয় করেছিলেন, কিন্তু দেবপাল কোন রাষ্ট্রকূট রাজার কাছে পরাস্ত হননি বরং তিনি প্রতিহার রাজ ভোজকে পরাস্ত করেছিলেন। ভোজ রাষ্ট্রকূটদের কাছেও পরাজিত হন।
কিন্তু দেবপালের পর 850-977 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্যের ইতিহাস ছিল অবক্ষয়ের কাহিনী এবং এই পর্বেই ত্রিশক্তি সংগ্রাম আবার পাল রাজাদের প্রতিকূলে যেতে থাকে। এই সুযোগ ভোজ কনৌজ অধিকার করে মগধে গিয়ে হাজির হন । সম্ভবত তিনি বঙ্গ জয় করেন, রাষ্ট্রকূটদের পরাস্ত করে মানব ও গুজরাট অধিকার করেছিলেন। এভাবেই ভোজ যথার্থভাবেই “উত্তরা পথ স্বামী” হয়েছিলেন । ভোজের পুত্র মহিপাল বাংলা জয় করেন, তবে তিনি রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় ইন্দ্রের কাছে পরাস্ত হন। খ্রিস্টীয় দশম শতকের গোড়ায় প্রতিহার শক্তি হীনবল হয়ে পড়েছিল।
তবে, পাল , রাষ্ট্রকূট, ও গুর্জর প্রতিহার, ভারতের এই তিন শক্তির উত্থান পতনের কাহিনী শেষ লগ্নে দেখা যায় যে গুর্জর প্রতিহাররাই হিমালয় থেকে বিন্ধ এবং বঙ্গোপসাগর থেকে আরব সাগর পর্যন্ত ভুখন্ডে অবিসংবাদিক কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছিল। এই হিন্দু রাজ্যেই দীর্ঘকাল সুসংহতভাবে মুসলমান আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রভাব বা ফলাফলঃ
দুশো বছর স্থায়ী (750-950) ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের প্রভাব বা ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ভারতে এই তিন শক্তির পারস্পারিক দ্বন্ধে, লিপ্ত থাকায় শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল এবং তা একই সময় হয়েছিল। এই ত্রিশক্তি ছিল প্রায় সমশক্তি সম্পন্ন। এদের বিশাল সৈন্য বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। সামরিক ব্যয় নিবাহের জন্য রাজস্ব বাড়াতে হয়েছিল যা সাধারণ মানুষের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। সম্ভবত এই কারণেই সংগঠিত হয়েছিল কৃষক বিদ্রোহ।
পাল আমলে কৈবর্ত বিদ্রোহ ছিল কৃষক বিদ্রোহ। ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের সুযোগে প্রাদেশিক শাসক ও সামন্ত রাজারা বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়ে যায়। এই তিন শক্তির সীমান্তে নেপাল, কার্যরুপ, কাশ্মীর উৎকল প্রভৃতি স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়। পূর্ব উপকূলে চালুক্য ও গঙ্গারা এবং গুজরাটের সোলাঙ্কিরা রাজস্থ স্থাপন করেছিল। ত্রিশক্তির কেউই সাম্রাজ্য স্থাপিত করতে পারেনি। দশম শতকে ভারতে তুর্কি আক্রমণ শুরু হলে তাদের প্রতিহত করার ক্ষমতা এই ত্রিশক্তির উত্তরাধিকারী রাজ্যগুলির ছিলনা। নিজেদের মধ্যে এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ তাদের ক্ষমতাকেই সংকুচিত করে অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল।
ত্রিপক্ষিয় দ্বন্দ্বের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ছিল অত্যাবশ্যক শক্তি ক্ষয়। আরব পরিব্রাজক আলমাসুদি প্রতিহার রাজ্যের শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রশংসা করলেও জানিয়েছেন যে, এ সময় উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য যেমন নষ্ট হয়েছিল তেমনি সমগ্র দেশে অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব আঞ্চলিক সাংস্কৃতিকে উৎসাহ যুগিয়েছিল।
মূল্যায়ন:
ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের ফলে, ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্য নষ্ট হয়ে যায়। ধর্ম সাহিত্য শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রের স্থানীয় রীতিনীতি আচার-আচরণ গড়ে উঠেছিল। ত্রিপক্ষীয় সংগ্রামের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য হলো ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। সামরিক শক্তি ক্ষয় এবং আঞ্চলিক স্বতন্ত্রের বিকাশ।
Table
গুর্জর প্রতিহার | রাষ্ট্রকূট | পাল |
---|---|---|
বৎস্যরাজ(783খ্রি:) | ধ্রুব (779-93খ্রি) | ধর্মপাল (770-810খ্রি) |
দ্বিতীয় নাগভট্ট(815খ্রি) | তৃতীয় গোবিন্দ(793-814) | দেবপাল (810-50) |
রামভদ্র | অমোঘবষ | বিগ্ৰহপাল |
ভোজ | দ্বিতীয় কৃষ্ণ | নারায়ণ পাল |
মহীপাল/মহেন্দ্রপাল | – | – |
Nice notes sir thanks
Thanking you. Welcome to studymamu.in