উনিশ শতকের বাংলায় অবাঙালি সমাজ সম্পর্কে একটি টীকা লেখ।
Q- উনিশ শতকের বাংলায় অবাঙালি সমাজ সম্পর্কে একটি টীকা লেখ। উনিশ শতকের বাংলায় অবাঙালি সমাজ।
ভূমিকা:
ভারতের মতো বহু ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বলিত দেশে উনিশ শতকের বাংলা সাংস্কৃতিক বহুত্বতা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মীয় শক্তির হাত ধরে বহু জাতি ভাষা বা ধর্ম এখানে এসেছে। এখানকার সংস্কৃতিতে রয়েছে সমৃদ্ধ জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন ধারণার, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর এমনকি নতুন সামাজিক সত্তার। উনিশ শতকের বাংলায় অবাঙালি সমাজ বা সামাজিক সত্তার মধ্যে Anglo-Indians মারওয়ারি, পারসীক, আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা গোষ্ঠীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উনিশ শতকের বাংলায় অবাঙালি সমাজ:
সামাজিক সত্তা হিসেবে Anglo-Indians দের উৎপত্তির ইতিহাস বহু পুরনো। এর মূল সূত্রপাত জড়িয়ে আছে পর্তুগিজ ও ভারতীয় রক্তের মিশ্রিত সত্তা mix-indian মধ্যে সূচনা হিসেবে বলা যায় যে গোয়া দমন ও দিউ এর পর্তুগিজ গভর্নর আলবুকার্ক পর্তুগিজদের ভারতীয়দের সঙ্গে বিয়ের যে সুযোগ দিয়েছিলাম তার ফলশ্রুতিতে যে নতুন প্রজন্মের বিকাশ ঘটে তাদের mix-indian বলা হয়।
সপ্তদশ শতকের মধ্যে ইংরেজগণ বোম্বে সুরাট মাদ্রাজ ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বহু কর্মচারী mix-indian দের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। 1687 খ্রিস্টাব্দে East India company মাদ্রাজের গভর্নর কে কোম্পানির কর্মচারীদের ভারতীয়দের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিল। এই বিয়ের দ্বারা সৃষ্ট Anglo Indian দের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে Anglo Indian দের নিয়োগ ইংল্যান্ড বা ভারতের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষা লাভ ও কোম্পানির উচ্চপদে নিয়োগ তাদের সমৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু 1786 খ্রিষ্টাব্দ থেকে Anglo Indian দের ভাগ্য কাছে দুর্যোগের সংকেত পাওয়া যায়। 1786 খ্রিষ্টাব্দ কোম্পানির আদেশ অনুযায়ী কোম্পানির সেনাবাহিনীর অনাথ শিশুদের ইংল্যান্ডে পঠন পাঠনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়।
1791 ও 1795 খ্রিষ্টাব্দ নির্দেশ বলে Anglo Indian দের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ পাওয়ার সুযোগ ও বন্ধ হয়ে যায়। এই ধরনের নির্দেশ দানের প্রধান কারণ ছিল Anglo Indian সেনাদের কোন ধরনের ষড়যন্ত্র করার সম্ভাবনাকে রোধ করা। 1786-1795 এই দশ বছরের মধ্যে Anglo Indian দের অবস্থা অতিশয় দুর্দশা গ্রস্থ হয়ে পড়ে। ফলে Anglo Indian গন কোম্পানির কাজ থেকে ছেড়ে দেশীয় রাজাদের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে।
1798 খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি চালু হওয়ার ফলে কোম্পানির অধীনে Anglo Indian দের কাজ পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। কিন্তু 1808 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় Anglo Indian দের সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত করা হয় ।
সেনাবাহিনীতে কাজের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে Anglo Indian গণ তাদের সন্তানদের সুশিক্ষিত করার উপর যদি সমৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টায় ব্রতী হন। 1833 খ্রিস্টাব্দে চ্যাটার অ্যাক্ট ভারতীয় সহ Anglo Indian দের কাজে নিয়োজিত হবার অধিকার ঘোষণা করে। এর ফলে Anglo Indian গণ East India company -র বিভিন্ন নিম্ন পদে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ পায়। পাশাপাশি ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি সরকারি ভাষা হিসেবে গৃহীত হবার পর Anglo Indian গণ কোম্পানিতে করনিক হিসাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে Anglo Indian দের অবস্থা, সমৃদ্ধি শালী হয়ে উঠেছিল।
Anglo-Indians ছাড়াও উনিশ শতকের বাংলায় অবাঙালিদের মধ্যে পারসিক ও মারওয়ারীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মারোয়াড়ী সমাজ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক বর্গের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। যেমন – আগরওয়াল, মহেশ্বরী, ওসওয়াল, খান্দেশওয়াল, পোরওয়াল, ইত্যাদি। মূলত নবাবী আমল থেকে বাংলায় মারোয়াড়ী বণিক গোষ্ঠীর সমৃদ্ধি ঘটতে থাকে। বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মারোয়াড়ী মহাজনদেরও সমান্তরাল বিকাশ ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতকে বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র মুদ্রা ব্যাংক ও ব্যবসায়ী মারোয়াড়ীদের একচেটিয়া কারবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতকে বাংলায় অবাঙালি সমাজে মারোয়াড়ীদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, নগাঁও, ময়মনসিং, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার সহ, বাংলার বিভিন্ন ছোট-বড় শহরে মারোয়াড়ীদের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার বিকাশ ঘটে। কলকাতার বড়বাজারের বিখ্যাত মারোয়াড়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তারাচাঁদ খনশ্যাম দাস, বংশী লাল, আবির চাঁদ, সদাসুখ গম্ভীর চাঁদ, হরসুক দাস, বালকিষেন দাস, নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত আফিং ব্যবসাতেও মারোয়াড়ী বিনিয়োগকারীদের প্রাধান্য ছিল।
ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মারোয়াড়ী ব্যবসায়ীগণ বাংলার পাটশিল্প ও তার বাজারজাতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতেন। পাটকলের মালিকানা ছাড়াও পাটের রপ্তানির ক্ষেত্রে মারোয়াড়ীদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে রামকৃষ্ণ দাস সদ শিবজী, গুলাব চান্দজি, লোহিয়া নাগ, সেথিয়া, তুলারাম ও ডুবার পরিবারের নাম উল্লেখযোগ্য।
মূল্যায়ন:
মারোয়াড়ীরা ছাড়া উনিশ শতকের বাংলায় অবাঙালি সমাজে শিল্প – বাণিজ্যে পাখি সম্প্রদায়ের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় । জাহাজ পাট, নৌহ, ও ইস্পাত সহ বিভিন্ন ছোট বড় শিল্পে পারসীদের অবদান অবিস্মরণীয়।