ইতিহাস দর্শন বলতে কী বোঝায়
Q- ইতিহাসদর্শন কী । ইতিহাস দর্শন কি। ইতিহাস দর্শন বলতে কি বুঝ। ইতিহাস দর্শন বলতে কী বোঝায়।
ইতিহাস দর্শন বা Philosophy of History কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানদীপ্তির যুগের ফরাসী লেখক Francois- Marie Arouet যিনি ভলতেয়ার নামেই অধিক খ্যাত। তিনি অনুযোগ করেন যে অধিকাংশ লেখকই ইতিহাসকে অতীতের কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রূপে লিপিবদ্ধ করেন যা অর্থহীন কারণ তা মনকে আবিষ্ট করলেও আলোকিত করতে পারেনা। বস্তুত তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকের একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকবে অর্থাৎ ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনার মধ্যে দিয়ে তার বিরবরণের একটি অর্থবহ রূপ তুলে ধরবেন।
ইতিহাস হল মানবসভ্যতার অতীতের তথ্যনির্ভর ও যুক্তিনিষ্ঠ চর্চা। অন্যদিকে ইতিহাসের মতো দর্শনও একটি স্বতন্ত্র বিষয় যা মূলত জ্ঞানের প্রকৃতি, বাস্তবতা, অস্তিত্ব, নৈতিকতা ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করে থাকে। দর্শনচর্চার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসা। বৈজ্ঞানিক চর্চা ও গবেষনার মাধ্যমে যা কিছু প্রত্যক্ষ করা যায় না বা ব্যাখ্যা করা যায়না সেই সকল বিষয়ের উপরেই দর্শনচর্চা আলোকপাত করতে থাকে, অন্যভাবে বললে সাধারণভাবে অজ্ঞাত বিষয়ে জ্ঞান আরোহন করাই দর্শনের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই যুক্তি সাজিয়ে দার্শনিক প্রকল্প রচনা করে জ্ঞাত থেকে অন্তত তথ্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চালান।
বিজ্ঞান যখন একদিকে প্রকৃতি, উদ্ভিদ, মানুষ, জীবজগত, যন্ত্র, প্রযুক্তি ইত্যাদি প্রত্যক্ষগোচর বিষয় নিয়ে চর্চা চালায়,তেমনই দর্শন মানব আত্মা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, চড়ান্ত সত্য, সৌন্দর্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর নয় এমন বিষয়ের উপর আলোকপাত করে থাকে। এই কারণে দর্শনকে সকল জ্ঞানের মাতা বলে মনে করা হয় যা উপরোক্ত অপ্রত্যক্ষগোচর বিষয়ে সমন্বয়মূলক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আবার অন্য অর্থে বা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দর্শন একটি তত্ত্বও বটে যা যে কোন বিষয়ের পথনির্দেশমূলক নীতি (Guiding Principles) রূপে চিহ্নিত হয়।
বস্তুত মানবজীবনের ও চেতনার অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলি নিয়ে দর্শন আলোচনা করে এবং এই হিসাবে দেখলে দর্শনের সঙ্গে ইতিহাসের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকা উচিৎ নয়। কিন্তু দর্শনের দ্বিতীয় অর্থটিকে যদি নেওয়া হয় তাহলে দর্শনের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক টিকে স্থাপন করা সম্ভব। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দর্শন হল ইতিহাসচর্চার অন্তর্নিহিত অর্থ উন্মোচন বা অন্যভাবে বললে ইতিহাসচর্চার জন্য পথনির্দেশমূলক নীতি যা সাধারণভাবে একজন ঐতিহাসিক অনুসরণ করবেন বা করে থাকেন।
ঊনবিংশ-বিংশ শতকের প্রখ্যাত ইতালীয় লেখক বেনেদেত্তো ক্রোসে মনে করতেন যে ইতিহাস রচনার কাজ দার্শনিকগণই ভালো করতে পারবেন। তাঁর দেড়শো বছর পূর্বেই রাষ্ট্রনৈতিক দর্শনের রূপকার হিসাবে ভলতেয়ার তাঁর ইতিহাস রচনার দর্শনকে প্রকাশতি করেন দুটি অপরূপ সুন্দর গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে The Age of Louis XIV এবং The Essay on the Manners and Customs of Nations from Charlemagne to Loius XIII”। এই দুটি গ্রন্থে তিনি ইতিহাসকে দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মূল্যায়ন করেন এবং বিশ্বজনীন ইতিহাস’র অনুসন্ধান করেন। ভলতেয়ার মনে করতেন ঐতিহাসিক তাঁর পূর্ববর্তীকালের রচনা থেকে প্রাপ্ত তথ্যর পুনরাবৃত্তি করবেন না, বরং ইতিহাস রচনার সময় তিনি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঘটনার বিচার বিশ্লেষভণ করে তাকে অর্থবহভাবে প্রকাশ করবেন যা শিক্ষণীয় হয়ে উঠবে।
ভলতেয়ারের পর ইতিহাসের দর্শনকে বা ইতিহাস রচনার দর্শনকে বহু খ্যাতনামা লেখকই নিজের মত ও করে ব্যাখ্যা করেন, ফলে ইতিহাস দর্শন নামক অভিধাটিও ক্রমশ জটিল হয়ে উঠতে থাকে। বস্তুত ইতিহাস দর্শনকে দেখার চেষ্টা হয় ইতিহাস তথা ঐতিহাসিকের ইতিহাসের অর্থ অনুসন্ধান রূপে এবং স্বাভাবিকভাবেই এক একজন লেখক তাঁর নিজ ধ্যান ধারণা অনুসারে এই অর্থ অনধান করেন। যেমন হেগেল এর ইতিহাস দর্শনের সার কথা ছিল বিশ্বজনিত ইতিহাস রচনা, এমন এক ইতিহাস যা চিরন্তন।
কোমটে ( Comte) ইতিহাসের ঘটনাক্রমকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকটি সাধারণ নিয়ম বা নীতির অবতারণা করেন। আবার বেশ কিছু লেখকের কাছে ইতিহাস রচনার অর্থ বা উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে অতীতের ইতিহাসরচনার মধ্যে থেকে কল্পনাশ্রয়ী বিষয়গুলিকে পরিহার করে সেগুলিকে কেবল তথ্যনিষ্ট বা যুক্তিনিষ্ঠ রূপে পনর্নির্মাণ করা। আবার কারও কারও কাছে ইতিহাস দর্শনের মূল কথা হয়ে ওঠে সভ্যতার বিবর্তনের পথে মানুষের ভূমিকার অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা। অন্যদিকে কেউ কেউ আবার তাদের ইতিহাসদর্শনে অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার পেছনে যৌক্তির পরিকল্পনার অনুসন্ধান করেন।
ইতিহাস দর্শনের মূল বিষয় রূপে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণকেও দেখা হতে থাকে, যেমন দেখা হতে থাকে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে। ইতিহাসের ঘটনাক্রমের মদ্যে কার্যকরণের সূত্রকে অনুসন্ধান করা, সেগুলির মধ্যে প্যাটার্ন বা নিয়মকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে দিয়ে সামগ্রিকভাবে ইতিহাসের একটি সর্বজনগ্রাহ্য অর্থকে প্রকাশ করার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসকে একটি চেতনা বা বুদ্ধি ও চিন্তার প্রকাশ রূপে দেখার চেষ্টা করা হতে থাকে। কলিংউড যেমন বলেন যে ইতিহাস দর্শন হল অতীতের ঘটনা এবং ঐতিহাসিকের চিন্তা ও চেতনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি বৌদ্ধিক প্রকাশনা।
হার্বাট বাটারফিল্ডের কাছে ইতিহাসদর্শন হল ইতিহাসের নিজ কক্ষপথে অগ্রসর হওয়ার বিবরণী, অন্যদিকে মার্কসের কাছে ইতিহাসদর্শন হলে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত ঘাত প্রতিঘাত।
বিউরি, ব্ল্যাক বেকার প্রমুখ ইতিহাসবিদের কাছে ইতিহাসদর্শন আবর্তিত হয় যুগের প্রয়োজনিয়তা অনুসারে, টয়েনবির কাছে তা সামাজিক বিবর্তন আবার বিংশ শতকের অনেক ঐতিহাসিকের কাছেই ইতিহাসদর্শনের অর্থ হল ঐতিহাসিক আপেক্ষিকতা ও সম্বন্ধবাদ সম্পর্কিত ধারণা। বস্তুত ভলতেয়ারের সময় থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে তাদের ইতিহাসদর্শনকে ব্যাখ্যা ও প্রকাশ করেছেন।