StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

আর্য সমস্যা বিশ্লেষণ করো

আর্য সমস্যা বিশ্লেষণ করো

Q- আর্য সমস্যা বিশ্লেষণ করো

মূলত দুটি বিষয় আর্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে—১. ‘আর্য’ শব্দ বিষয়ক। অর্থাৎ আৰ্য এই শব্দটি কোনো জাতি অর্থে ব্যবহৃত হওয়া যুক্তিযুক্ত কিনা এবং ২. আর্যদের আদি বাসস্থান সংক্রান্ত। অর্থাৎ যে আর্য সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা সচরাচর গর্ববোধ করে থাকি, সেই আর্যদের আদি বাসভূমি কি ভারত, না ভারতের বাইরের কোনো অঞ্চল থেকে তারা এখানে এসেছিল? 

বলাবাহুল্য, এই দুটি আর্য সমস্যাই অত্যন্ত জটিল এবং একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক খুব নিবিড়। আর্য সমস্যা সংক্রান্ত উপরিউক্ত দুটি বিষয়েই পণ্ডিতমহলে বিতর্ক রয়েছে এবং তাঁরা স্পষ্টত পরস্পরবিরোধী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এর প্রধান কারণ হল, উভয় তরফেই তথ্যের অপ্রতুলতা। ফলে বাদবিতণ্ডা বেড়েছে এবং তা প্রবহমান।

আর্য সমস্যা 

‘আর্য’ শব্দটি নির্দিষ্টভাবে প্রাচীনকালে কোনো জাতি অর্থে ব্যবহৃত হত, না একটি নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে ‘আর্য’ বলে চিহ্নিত করা হত, আজকের দিনে তা এক কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কিংবা তারও কিছুকাল আগে। আর্যদের জাতিতত্ত্বের ধারণাটি আজও সাধারণভাবে আমাদের মনে বদ্ধমূল। এই তত্ত্বের সমর্থনে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ঐতিহাসিকেরা ভারতবাসীর আদি সূত্র সন্ধানের মাধ্যমে তাদের বর্তমান অস্তিত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমে এই ধরনের পথ বেছে ছিলেন। এছাড়া, ঋগ্বেদে উল্লেখিত কিছু শব্দকে তুলে ধরে জাতি হিসাবে আর্যদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা বিদ্যমান রয়েছে। বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঋগ্বেদে উল্লেখিত ‘আর্য’ ও ‘দাস’ শব্দ দুটির মাধ্যমে জাতিগত পার্থক্যকে তুলে ধরে আর্যদের জাতিগত পরিচয় প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট রয়েছেন। কিন্তু জেনে রাখা দরকার, এই পার্থক্য জাতিগত নয়; এখানে সাংস্কৃতিক পার্থক্য প্রাধান্য পেয়েছে। বিষয়টি হল এই যে, ঋগ্বেদে আর্যদের দস্যু (বা দাস)-দের থেকে পৃথক এবং দস্যুদের বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধী বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে বৈদিক ভাষাভাষীদের থেকে অবৈদিক লোকদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর থেকে মনে হয় যে, বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহকদেরই প্রথমে আর্য নামে ডাকা হত। সুতরাং ‘আর্য’ শব্দটি এখানে একটা ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচায়ক।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ইওরোপে ‘আর্য’ শব্দটিকে নরগোষ্ঠী অর্থে ব্যবহার করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে জে. সি. পিচার্ড সংস্কৃত, জার্মান, গথিক প্রভৃতি ভাষাভাষী জাতিগুলির আদিম পূর্বপুরুষ হিসাবে এক নরগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, এই গোষ্ঠীর সদস্যরা কালক্রমে স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে গঙ্গা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ঐ সময়েই সি. ল্যাসেন জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলেন যে, আর্যরা হল সবচেয়ে সংগঠিত, উদ্যমী ও সৃজনশীল একটি জাতি। এছাড়াও তিনি বললেন, ভারতে আর্যগোষ্ঠীভুক্ত উচ্চবর্ণের লোকেরা ছিল। গৌরবর্ণের। এইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে ও বাইরে আর্যদের জাতিতত্ত্বের ধারণাটি প্রকাশ্য রূপ পায়।

অপর এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক মনে করেন যে ‘আর্য’ শব্দটি প্রথমে জাতিগত অর্থে ব্যবহৃত হত না। ভাষাগত অর্থেই প্রারম্ভিক পর্বে এটি ব্যবহৃত হত। এই তত্ত্বই এখন সমধিক প্রসিদ্ধ। এই তত্ত্বে যারা বিশ্বাসী তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জেমস পারসনস, স্যার উইলিয়াম জোন্স, ম্যাক্সমুলার এবং এঁদের অনুগামী আধুনিক বহু পণ্ডিত। এই গোষ্ঠীর মূল বক্তব্য হল উপরিউক্ত তত্ত্বের সমর্থকরা ভাষার সঙ্গে জাতিকে অভিন্ন চোখে দেখেছেন। এর ফলে বিভ্রান্তি ঘটেছে। এঁরা মনে করেন, ‘আর্য’ হল একটি ভাষার নাম। এই ভাষায় যারা কথা বলত তারা সকলেই আর্যগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কোনো একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠী এর আওতায় পড়ে না। এ বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেছিলেন ফ্লোরেন্সের বণিক ফিলিপ্পো সাসেত্তি।

গোয়াতে ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য উপলক্ষ্যে এসে ফিলিপ্পো সাসেত্তি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি যে ভাষায় কথা বলছেন সেই ইতালীয় (লাতিন) ভাষার সঙ্গে ভারতের ভাষা- সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মিল রয়েছে। এ সম্পর্কে সাসসেত্তি আর কিছু না বললেও ভারতীয় ভাষার সঙ্গে ইওরোপীয় ভাষার যোগাযোগের বিষয়টি তিনি মানবসমাজের কাছে উপস্থাপন করে গিয়েছিলেন। এর প্রায় দুই শতাব্দী পর ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস পারসনস এ বিষয়ে আর এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ‘দ্য রিমেনস অব জাফেত বিয়িং হিস্টরিক্যাল এনক্যুয়ারিজ ইনটু দ্য এফিনিটি এ্যান্ড অরিজিনস অব দ্য ইউরোপীয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ’স-এ বাইবেলে উদ্ধৃত একটি গল্পের সঙ্গে বাস্তবের সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি যে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তার সারমর্ম হল এই যে, তৎকালীন ইওরোপ ও এশিয়ার অনেকগুলি ভাষার মূলসূত্র নিহিত রয়েছে একটি আদিম ভাষার মধ্যে।

১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে (দ্য থার্ড এ্যানিভার্সারি ডাইকোর্স) ভাষণ দিতে গিয়ে উইলিয়াম জোনস সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ইওরোপের অন্যান্য ভাষাগুলির উৎপত্তিগত সাদৃশ্যের ওপর জোর দেন। ক্রিয়াপদ ও ব্যাকরণের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারতীয় ও ইওরোপীয় কয়েকটি ভাষার মধ্যে গভীর মিল তাদের উৎপত্তির একই উৎসের ইঙ্গিত দেয় বলে তিনি মনে করেন। এই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃত ছাড়াও গ্রিক, লাতিন, গথিক, জার্মান, কেল্টিক, পারসিক এবং পরবর্তীকালে ঐ ভাষাগুলি থেকে উদ্ভুত অন্যান্য ভাষাকে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন।

ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে টমাস ইয়ং ইওরোপ ও এশিয়ায় ঐ সমস্ত ভাষাগুলির মূল উৎস বা আদিম ভাষার নাম দিলেন ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষা। এরপর থেকে ভাষাতত্ত্বের ওপর গবেষণা শুরু হয়। অগাস্ট স্কাইখার সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন ও গথিক ভাষার মধ্যে একটা সাদৃশ্যের সন্ধান দেন। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার আর্য কথাটির বহুল প্রয়োগ ঘটালেন। “আর্যদের বাসস্থান” নামে একটি প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টতই বলেন যে আর্য নিঃসন্দেহে একটি ভাষার নাম।

আরো পড়ুন –আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে যা জানো লেখ

উপরে উল্লেখিত ভাষাগুলিতে যারা কথা বলত তারা সকলেই আর্য বলে পরিগণিত হত। এদিক থেকে বিচার করলে পারসিক, জার্মান, গ্রিক সকলেই আর্য ভাষাগোষ্ঠীর  দাবিদার। এ প্রসঙ্গে পারস্যের আকিমেনিড বংশের শাসক প্রথম দারিয়াস (খ্রিঃপূঃ ৫২২ খ্রিঃ পূঃ ৪৮৬ অব্দ)-এর বেহিস্তান লেখর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই লেখতে দাবি করা হয়েছে যে এটি আর্য ভাষায় লেখা। আসলে বহুকাল ধরে ‘আর্য’ শব্দটি এক শ্রেণীর মানবগোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বলেই আজও কেউ কেউ ঐ শব্দটিকে একটি জাতির সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করে থাকেন। কারণ একটি ভাষা কোনো জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করলে উভয়ের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠতে বাধ্য। এখানে ভাষার সঙ্গে জনগোষ্ঠীর যোগ নৃতাত্ত্বিক নয়, সাংস্কৃতিক।

আরো পড়ুন –আর্যদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে বিতর্ক আলোচনা করো 

উল্লেখ্য, প্রাচীনকালে যে সমস্ত মানুষ পবিত্র গ্রন্থ বেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল এবং সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে অবগত ছিল তারাই নিজেদের ‘আর্য’ বলে চিহ্নিত করত। এছাড়া প্রাচীন ভারতে আর্য বলতে সাধারণভাবে “অভিজাত”, “সম্মানীয়”, “শ্রদ্ধেয়” ইত্যাদিকে বোঝাত।

মূল্যায়ন 

সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে ভারতীয় উপমহাদেশে আদিপর্বে ‘আর্য’ শব্দটি একটি ভাষা ও সংস্কৃতি এবং এর অনুরাগীদের বোঝাত।

1 thought on “আর্য সমস্যা বিশ্লেষণ করো”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top