তুমি কি মনে করো যে, ১৯১১ সালের চিনা বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে আপোষপন্থী চরিত্র প্রকাশ করেছিল?
Q- তুমি কি মনে করো যে, 1911/১৯১১ সালের চিনা বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে আপোষপন্থী চরিত্র প্রকাশ করেছিল।
ফেয়ারব্যাঙ্ক লিখেছেন যে চিনের সংস্কারকরা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেন। চিনের জীবনধারায় পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। নতুন নতুন সামাজিক শ্রেণীর উত্তর হয়, নতুন প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে উঠেছিল। এদের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক গোষ্ঠীর লোকেরা চিনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। চিনে বহুকাল ধরে রক্ষণশীল ও প্রগতিবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলেছিল, এরই পরিণতি হল প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব। দেশে চিং রাজবংশ বিরোধী বিকেন্দ্রীকরণ শক্তির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
এরাই চিং রাজবংশকে ধ্বংস করে পরিবর্তনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক গোষ্ঠীগুলি হল দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং বিদেশে পাঠরত ছাত্ররা। এরা বিপ্লবী ভাবধারার প্রসারে সহায়ক হয়। মাঞ্চু সরকার বিদেশি আক্রমণ মোকাবিলার জন্য আধুনিক সৈন্যবাহিনী ও নৌবহর গঠনের দিকে নজর দিয়েছিল। অনেকগুলি সামরিক ও নৌশিক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত সৈনিকরা প্রগতিবাদী, পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিল। এদের নেতা য়ুয়ান শিকাই কার্যত রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিলেন।
![]() |
বুর্জোয়া শ্রেণী |
image source:gettyimages
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের সময় দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনেকগুলি শিল্প স্থাপিত হয়। এসব শিল্পোদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত কম্প্রাদর-বুর্জোয়া শ্রেণী চিনের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল। এরা হল চিনের উদীয়মান পরিবর্তনকামী শক্তি। আরও দুটি সামাজিক শক্তি চিনে পরিবর্তন চেয়েছিল। এদের একটি হল জেন্ট্রি শ্রেণী, অপরটি হল সংবাদপত্রের প্রকাশক ও সম্পাদক। জেন্ট্রি শ্রেণীর একাংশ শহরে বাস করত, শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থা গড়ে তুলেছিল, রেলপথে মূলধন লগ্নি করেছিল, এরা ছিল প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে। হুপে, হুনান, কোয়াংটুং ও সেচওয়ানে রেলপথ সংক্রান্ত আন্দোলন শুরু হলে এরা প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হিসেবে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সাংবাদিকরা।
চিনে পশ্চিমি ভাবধারা প্রচার করেছিল, বিপ্লবের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিল। সুন পাও সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা ছিল পনেরো হাজার। এরকম আরও ষাটটি সংবাদপত্র চিনারা প্রকাশ করেছিল। এদের সঙ্গে ছিল বিদেশি সংবাদপত্রগুলি। অনেকগুলি ছিল মিশনারিদের পরিচালিত সংবাদপত্র চিনের আধুনিকীকরণের কাজ শুরু হলে জাতীয়তাবাদ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে গঠন করেন। এই বাহিনীর অধীনে ছটি সামরিক বিদ্যায়তন ছিল, এদের অন্ত ১৫ জন সেনানায়ক বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
তুং চি সংস্কার ও আত্মশক্তিবৃদ্ধি আন্দোলনের সময় অর্থনৈতিক উন্নতির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। চিনের জেন্ট্রি, কম্প্রাদর ও রাজকর্মচারীরা অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কোয়াংসু প্রদেশের চ্যাং চিয়েন হলেন অন্যতম পথিকৃৎ। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্থাপন করেন ফা-শুন কটা স্পিনিং মিল। চিনে অনেকগুলি আধুনিক শিল্প গড়ে উঠেছিল। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল খনি, রেলপথ, জাহাজ নির্মাণ, অস্ত্র কারখানা, বাষ্পীয় পোতে পরিবহন, ময়দা, তেল, লবণ ইত্যাদি। ভূস্বামী, বণিক,কম্প্রাদর ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মানুষজন চিনের পরিবর্তনকামী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ভূস্বামী, বণিক, জেন্ট্রি ও অন্যান্য বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের লোকজন চিনে প্রাদেশিক আইনসভাগুলি স্থাপিত হলে তাদের সদস্য হয়েছিল। এরা ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে চিনে কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠনের দাবি জানিয়েছিল। প্রদেশ ও জেলাগুলিতে এরা প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদের দাবি অগ্রাহ্য করে প্রশাসন চালানো খুব সহজ কাজ ছিল না। হুনান, হুপে, কোয়াট্রুং ও সেচওয়ান অঞ্চলে এরা ছিল জনগণের স্বাভাবিক নেতা। এদের কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠনের দাবি সরকার মানেননি।
১৯১১ খ্রিস্টাব্দে যে ক্যাবিনেট গঠন করা হয় তাতে তেরো জন সদস্যের মধ্যে মাত্র চার জন ছিল চিনা, আট জন মাঞ্চু ও একজন মঙ্গোলীয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে চিনে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, রেলপথ কেন্দ্রীকরণের প্রশ্নে জনবিক্ষোভ বিপ্লবে পরিণত হয়। যারা প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা সকলে উদার, প্রগতিবাদী বা দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ ছিল তা বলা যায় না। রেলপথ নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত ছিল।
শহরের শ্রমিকশ্রেণী এদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল কারণ তারাও প্রচলিত ব্যবস্থার পতন কামনা করেছিল। তারাও ছিল শোষণের শিকার। দেশের জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ ছিল কৃষক, আন্দোলনের সঙ্গে তারা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়নি তবে তারা 1911 সালের চিনা প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলনকে পরোক্ষভাবে জানিয়েছিল। দরবারি অভিজাতরা ছাড়া দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রজাতন্ত্রীরা ঐক্যবদ্ধ ছিল না, তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে অমিল ছিল। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল, ব্যক্তিস্বার্থ ছিল, এসব প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হতে পারেনি উঠতে থাকে। জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রসার চিং রাজবংশের অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
চিনের বেশিরভাগ মানুষ হান জাতির লোক, মাঞ্চুরা ছিল সংখ্যালঘু বিদেশি, মাঞ্চুরিয়ার লোক। এই বিভাজন ও স্বাতন্ত্র্যবোধ একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। চিনা জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল হান জাতীয়তাবাদ। বিধবা রানি জু-সি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিদেশি জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করে দেশকে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন তিনি চিনের পুরোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কারের কথা তুলেছিলেন।
শেষপর্বের সংস্কারকরা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর জোর দেন। রাজধানী, প্রদেশ, জেলা ও প্রিফেকচার স্তরে নতুন ধরনের স্কুল ও কলেজ স্থাপন করা হয়, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। পুরোনো শিক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষাব্যবস্থা সব বাতিল হয়ে যায়। আধুনিক ও ক্ল্যাসিক্যাল সব বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা হয়। মিশনারিরা দেশে অনেকগুলি বিদ্যায়তন স্থাপন করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিল। বহু ছাত্র বিদেশে, বিশেষ করে জাপানে, শিক্ষালাভের জন্য গিয়েছিল। জনগণ আধুনিক শিক্ষার দাবি জানালে সরকার ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পুরোনো পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছিল।
১৯০১-১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চিনের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। জাপানি শিক্ষক এবং জাপানে শিক্ষাপ্রাপ্ত চিনা শিক্ষকরা আধুনিক শিক্ষার প্রসারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। সরকারি উদ্যোগে বহু ছাত্রকে বিদেশে শিক্ষালাভের জন্য পাঠানো হয়। দুজন চিনা পণ্ডিত লিন-সু ও ইয়েন ফু পশ্চিমি শিক্ষা ও ভাবধারার প্রসারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এরা পশ্চিমি সাহিত্য, ভাবধারা ও পশ্চিমি উদারনৈতিক মতবাদ প্রচার করেন।
বিদেশি শক্তির কাছে পরাজয় চিনের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছিল, চিং রাজবংশ অসম্মানিত হয়েছিল। এই অবস্থার জন্য দায়ী ছিল চিনের প্রথাগত সামরিক সংগঠন। এই ব্যবস্থা আধুনিক যুগোপযোগী ছিল না। এখানকার পরীক্ষা, শিক্ষাদান, নেতৃত্ব ও অস্ত্র-শস্ত্র চিনকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। সরকার ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে পুরোনো সামরিক পরীক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে নতুন সামরিক কলেজ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিল। তাইপিং বিদ্রোহ দমনকালে প্রাদেশিক শাসক সেং কুয়ো ফ্যান, লি হুং চ্যাং ও সো-সুংটাং প্রাদেশিক সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন। আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের সময় চ্যাং চি তুং নানকিং শহরে এধরনের সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন। এসব সৈন্যবাহিনী যথেষ্ট আধুনিক ছিল না, জাপানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় এদের দুর্বলতা ধরা পড়ে। জাপানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইউয়ান-সি-কাই জার্মান মডেলে জার্মান প্রশিক্ষক রেখে নতুন সৈন্যবাহিনী।