প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব আলোচনা করো

ইতিহাস রচনার উপাদান রূপে মুদ্রার গুরুত্ব

Q- প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব অথবা, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব আলোচনা করো।

ভূমিকা :

বিনিময়ের মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হলেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব বা মুদ্রা উপযোগী ভূমিকা গ্রহণ করে। মুদ্রা থেকে কোন বিশেষ কাল ও স্থান বা সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রচুর তথ্য লাভ করা যায়।

মুদ্রা ও রাজনৈতিক ইতিহাসের তথ্য:

মুদ্রা থেকে সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের ছবি পাওয়া যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের অবসানের পর ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম দিকে ইউথাইডিমাস, ডেমেট্রিয়াস, অ্যাপোলোডোটাস, প্যান্টালিওন, অ্যাগাখোক্লেস, ইউক্রেটাইডাস, অ্যান্টিয়ালকিডাস, মিনান্দার প্রমুখ ইন্দো গ্রিক রাজা যে মুদ্রার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন তা থেকেই ঐ রাজাদের নাম, উপাধি এবং শাসনকাল সম্পর্কে জানা যায় এই ইতিহাস জানার অন্য কোন উপাদান বিশেষ নেই।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব
খ্রিস্টীয় প্রথম দুই শতকে গুজরাট ও পশ্চিম দাক্ষিণাত্যকে কেন্দ্র করে শক ও সাতবাহনদের যে প্রবল রাজনৈতিক সংঘর্ষ চলেছিল সে সম্পর্কে লেখমালা প্রদত্ত ইতিহাসের তথ্যকে নানাভাবে সমর্থন করে মুদ্রার তথ্য। নাসিক প্রশস্তি অনুসারে সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ক্ষহরাত বংশকে উৎখাত করেছিলেন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের নাসিকের কাছে যোগালখেছি বা জোগলধেম্বি নামক স্থানের উৎখননে শক ক্ষত্রপর নহপানের ১৩২৫০টি রুপোর মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় যার মধ্যে ১২৭০টি মুদ্রা গৌতমীপুত্র পুর্নমুদ্রন বা ‘Overstruck’ করেছিলেন।
নহপানের মুদ্রাগুলি ইন্দো-গ্রীক দ্রাখমের ওজনবিশিষ্ট ছিল, তাতে নহপানের প্রতিকৃতি, বংশের প্রতীক বস্তু ও তীর, গ্রীক, ব্রাহ্মী ও খরোষ্টী লিপিতে উৎকীর্ণ বাণী ছিল। এই মুদ্রাগুলিকে গৌতমীপুত্র নিজের নাম ও বংশের প্রতীক বাকা পর্বত ও উজ্জয়িনী চিহ্ন (চারটি বৃত্ত, ক্রুশ ও অর্ধচন্দ্র) দিয়ে পুর্নমুদ্রন ঘটিয়েছিলেন। জোগলঘম্বীর মুদ্রাভান্ডারে প্রাপ্ত এই পুর্নমুদ্রিত মুদ্রা আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্টীত করে যে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ক্ষহরাত বংশীয় নহপানকে পরাজিত করেছিলেন। অন্যদিকে মুদ্রা থেকেইজানা যায় যে পাঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত অঞ্চলে শেষে ‘মিত্র’ অভিধাযুক্ত অন্তত ২৫ জন রাজা রাজত্ব করতেন; মধ্য ভারতে বিদিশা, এরাণ, মথুরা অঞ্চলে ‘নাগ’ নামধারী শাসকগণ রাজত্ব করতেন, ইত্যাদি রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ইতিহাস। যৌধেয়, মালব, অর্জুনায়ন প্রভৃতি উপজাতি গোষ্ঠীর মুদ্রা থেকেও ঐ উপজাতীর রাজ্যগুলির এলাকা ও শাসনকাল সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
মুদ্রা থেকে রাজার জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথাও জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত-কুমারদেবী প্রতিকৃতিযুক্ত স্মারক মুদ্রা থেকেই গুপ্ত সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কাহিনী প্রত্যক্ষগোচর হয়।
গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকদের অনুকরণে রুপোর মুদ্রার প্রচলন করেন এবং সিংহনিধনকারী (সিংহ পাওয়া যায় গুজরাটে এবং শকরা ঐ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন) প্রতিকৃতিযুক্ত সোনার মুদ্রা জারি করেন -এর দুই প্রকারের মুদ্রা দেখে ঐতিহাসিকগণ নিশ্চিত হন যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকদের পরাজিত করেছিলেন। তবে মুদ্রার প্রাপ্তিস্থানের ভিত্তিতে কোন সম্রাট ও তাঁর সাম্রাজ্য বা রাজা ও তাঁর রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা অসুবিধাজনক কারণ মুদ্রা বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে আরও দূর দূরান্তে যেতে পারে।

কাল নির্নয়ে মুদ্রার ভূমিকা :

পশ্চিমী ক্ষত্রপদের কিছু মুদ্রায় উৎকীর্ণ লেখতে শক অব্দে এবং গুপ্ত শাসকদের জারি করা কতিপয় রুপোর মুদ্রায় গুপ্ত অব্দকে অনুসরণ করে শাসকদের রাজত্ববর্ষ উল্লেখিত আছে যা থেকে সংশ্লিষ্ট শাসক ও সেইসাথে মুদ্রাটির তারিখ নির্ণয় করা যায়। মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপিকে বিশ্লেষণ করে পুরালিপিবিদগণ মুদ্রার কাল নির্ধারণের চেষ্টা করেন। সর্বোপরি কোন একটি প্রত্নস্থলের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্তর বা পর্যায়গুলি ঐ স্তরে প্রাপ্ত মুদ্রার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। মথুরার নিকটে শঙ্খ নামক প্রত্নক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে প্রাপ্ত মুদ্রার উপর নির্ভর করে শৃঙ্খর প্রতক্ষেত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের সময়কাল নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। একইভাবে হস্তিনাপুরের চতুর্থ প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যায়ে প্রাপ্ত কুষাণ রাজা বাসুদেবের মুদ্রা ঐ পর্যায়ের আনুমানিক সময়কাল নির্ধারণে সাহায্য করে।

মুদ্রা ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের তথ্য:

মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যম, ফলে মুদ্রা থেকে বাণিজ্যিক তথা অর্থনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক প্রতিভাত হবে এই স্বাভাবিক। খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রভৃত পরিমাণে পাঞ্চ মার্কড মুদ্রার প্রচলন প্রমাণ করে যে ঐ কালপর্বে বাণিজ্যিক লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছিল; সন্ধান পাওয়া কুষাণদের মুদ্রার প্রসার ও ব্যাপ্তিকে বিশ্লেষণ করলে ঐ সময়কালে বাণিজ্যের প্রসারের চিত্রটি পরিষ্কার বোঝা যায়, প্লিনি খেদের সঙ্গে বলেছিলেন যে ভারত থেকে রোমে বিলাসদ্রব্য আমদানির ফলে প্রচুর রোমান মুদ্রার নিষ্ফমণ ঘটছে খ্রিস্টীয় প্রথম দুই শতকে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে প্লিনির ঐ বক্তব্যের চাক্ষুষ সমর্থন মেলে; স্কন্দগুপ্তের পর গুপ্ত শাসক কর্তৃক প্রচলিত মুদ্রার সংখ্যা বা পরিমাণ হ্রাস পায়, পাশাপাশি সোনার মুদ্রাগুলিতে খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যার ভিত্তিতে ঐতিহাসিকগণ স্তন্দগুপ্তের পরবর্তী সময়ে গুপ্ত রাজকোষের দুর্বলতার তত্ত্ব খাড়া করেন।
প্রাচীন মুদ্রার প্রাতিষ্ঠানিক সংরক্ষক ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সংগ্রহশালায় প্রদর্শিত মুদ্রার তালিকা প্রকাশ করে প্রখ্যাত মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রামশরণ শৰ্মা দেখান যে আদিমধ্যকালীন ভারতে বা ৬০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে প্রচলিত ও সংরক্ষিত মুদ্রার সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম এই তথ্যের ভিত্তিতে তিনি মুদ্রাল্পতা বা Monetary Anaemia এর তত্ত্বটি খাড়া করেন।

মুদ্রা ও ধর্ম তথা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের তথ্য :

প্রাচীন মুদ্রা থেকে কোন একজন শাসক বা রাষ্ট্র তথা সময়কালের ধর্মীয় অনুরাগ ও শিল্প ও সংস্কৃতির ভাবনাও প্রকাশিত হয়। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় বীণাবাদনরত মূর্তি তাঁর সঙ্গীতানুরাগকে প্রকাশিত করে, বর্তমান আফগানিস্তানের আইখানোমের উৎখননে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের ইন্দো-গ্রীক রাজা অ্যাগাখোক্লেসের মুদ্রায় বলরাম ও কৃষ্ণেরপ্রতিকৃতি প্রমাণ করে যে ঐ সময় ঐ অঞ্চলে কৃষ্ণ-বলরাম মানুষের ধর্মবিশ্বাসে সম্পৃক্ত ছিল বা রাজার ব্যক্তিগত অনুরাগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল।
একইভাবে কুষাণ সম্রাট বীম কদফিসেসের মুদ্রায় উৎকীর্ণ শিবের প্রতিকৃতি, কণিষ্কের মুদ্রায় শিব ও বুদ্ধের প্রতিকৃতি, গুপ্ত শাসকদের মুদ্রায় বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি সম্রাটদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুরাগকে প্রতিফলিত করে। পাশাপাশি মুদ্ৰায় উৎকীর্ণ চিত্র, প্রতিকৃতি থেকে সমসাময়িক কালের শিল্পভাবনারও পরিচয় পাওয়া যায়। মুদ্রায় ব্যবহৃত লিপি, ধাতু ও তার বিশুদ্ধতা, নির্মানপ্রযুক্তি সবই ঐতিহাসিকের কাছে প্রয়োজনীয় উপাদান হয়ে দাঁড়ায়।

মূল্যায়ন :

মুদ্রা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রাচীনকালে কাগজের প্রচলন ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান যুগের ন্যায় কাগুজে মুদ্রার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই তখন বাণিজ্য ও জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান মাধ্যম ছিল মুদ্রা। প্রাচীন ভারত ইতিহাসের যে-কোনো দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে মুদ্রার গুরুত্ব বা সামগ্রিক বিশ্লেষণ একান্তই জরুরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *