গ্রিক ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলি কি ছিল?
গ্রিক ধর্মকে সাধারণত সৌন্দর্যের ধর্ম বলেই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। প্রধানত হোমারের কাব্য, বিভিন্ন দেবতার মন্দির এবং মূর্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ধর্ম সম্পর্কে চরম সংকীর্ণ জ্ঞানই অবশ্য এই ভাবনার ভিত্তি। হোমারের মহাকাব্য নিঃসন্দেহে একটি উচ্চস্তরের শিল্পসৃষ্টি। কিন্তু এই মহাকাব্য শুধুমাত্র গ্রীক(গ্রিক) ধর্মের সমসাময়িক যুগের একটা অস্পষ্ট এবং আংশিক চিত্র উপস্থাপিত করে।
হোমারের দেবতাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রায় সম্পূর্ণ অশ্রদ্ধাপূর্ণ ছিল, তা প্রাচীন গ্রীকদের মনে সন্দেহবাদের সৃষ্টি করেছিল। ক্ল্যাসিকাল গ্রীসের ভাস্কর্য এবং স্থাপত্য, দেবদেবীর মূর্তি এবং মন্দিরগুলি নিশ্চিতভাবে সৌন্দর্য এবং শিল্পসুষমার অপূর্ব উদাহরণ। কিন্তু এগুলি বরং ক্ল্যাসিকাল গ্রীসের সুমহান শিল্পবিকাশকেই চিহ্নিত করে, গ্রীকদের ধর্মবিশ্বাসগুলিকে নয়।
![]() |
গ্রিক ধর্মের বৈশিষ্ট্য |
মাইকেল এঞ্জেলো, র্যাফেল এবং টিশিয়ানের মহান সৃষ্টিগুলি থেকে যেমন আমরা খ্রিস্টান ধর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারি না, তেমনি ফিডিয়াস (Phidias), স্বোপাস (Scopas), প্রক্সিটেলেস (Proxiteles)-এর প্রতিমূর্তিগুলি, ইকটিনাস (Ictinus), ক্যালিক্রেটিস (Callicarates)-এর মন্দিরগুলি এবং অন্যান্য সৃষ্টি থেকেও গ্রীক(গ্রিক) ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। গ্রিক ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হলো –
গ্রিক ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলিঃ
1) গ্রিক(গ্রীক) ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পূজা-পদ্ধতি।নিঃসন্দেহে এখানকার পূজা-পদ্ধতিতে পণ্ডপুজার প্রচলন ছিল। বৃষ সর্বোচ্চ উপাস্যরূপে ব্যবহৃত হত। বৃষের অসংখ্য ছবি, বৃষযুদ্ধের দৃশ্যাবলী এটা প্রমাণ করে। মানুষের মতো দেহ (ধড়) এবং পদদ্বয় কিন্তু গোবৎসের মতো খুর, লেজ ও মস্তক সম্বলিত একটি দৈত্যের চিত্তাকর্ষক চিত্র অঙ্কিত একটি শীলমোহর পাওয়া গেছে। এই দৃশ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মিনোটার (Minotaur) সম্পর্কে গ্রীক উপকথা। এই মিনোটার অর্ধেক মানব এবং অর্ধেক বৃষদেহবিশিষ্ট এবং ফ্রীটের গোলকধাঁধায় বাস করত। রমণীরা সর্প ধরে রয়েছে এমন অসংখ্য চিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাঁরা পবিত্র সর্পদেবতার স্ত্রীপুরোহিত। এটা প্রমাণ করে যে, এখানে সঙ্গপূজা প্রচলিত ছিল। সম্ভবত ক্রীটের অধিবাসীরা (বনকপোত) পক্ষী পূজাও করত।
2) গ্রিক ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো জনগণ নরদেহবিশিষ্ট এবং প্রধানত নারীদেহবিশিষ্ট দেবদেবীদের উপাসনা করত। নারীমূর্তিগুলি ধর্মীয় ছবিতে বারবার দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, একজন ঊর্ধ্ববাহু নারীমূর্তি একটি কুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং কুকুরটির থাবাগুলিও ঊর্ধ্বে উত্তোলিত এধরনের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। অধুনা খোদিত করা কয়েকটি নামের পাঠোদ্ধার করা হয়েছে; সেই নামগুলির সঙ্গে প্রাচীন গ্রীক দেবতাদের নামের সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন, আর্টেমিস (Artemis), পোসিডন (Poseidon), হার্মেস (Hermes), হেরা (Hera), জিউস (Zeus), হেস্টিয়া (Hestia) ইত্যাদি)।
3) চক্রশোভিত চিত্রগুলি থেকে বোঝা যায় যে, সূর্য এবং চন্দ্র দেবতার পূজা প্রচলিত ছিল। প্রস্তর পূজা ও পবিত্র বৃক্ষ পূজারও প্রচলন ছিল। গুহাগুলি সম্পর্কে জনগণের ধর্মীয় ধারণা বিদ্যমান ছিল। এই গুহাগুলিতে মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হত। কোন কোন গুহায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদিত হত। কোন বিশেষ মন্দির আবিষ্কৃত হয়নি। ধর্মানুষ্ঠানগুলি সম্ভবত বাইরে বা গুহার মধ্যে হত। সম্ভবত পুরোহিতের বা স্ত্রীপুরোহিতেরও অস্তিত্ব ছিল। ক্রীটো মাইসেনিয়ান সংস্কৃতির ধর্ম সম্পর্কে এর বেশি আমাদের জানা নেই। এ থেকে এই ধর্মের প্রকৃতি ও রূপ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন।
4) প্রাচীন শিকার পদ্ধতিও প্রাচীন গ্রীসের ধর্মীয় পদ্ধতিতে টিকে ছিল। আবহাওয়া জাদুবিদ্যার জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিও প্রাচীন মৃগয়া পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আত্মায় বিশ্বাস- জলপরী, জঙ্গলপরী, পর্বতপরীগুলিতে বিশ্বাস গ্রীক ধর্মের আদিমতম সোপানের অংশ ছিল। রোগারোগ্যের জন্য ধর্মীয় ইন্দ্রজালিক বিশ্বাসগুলি প্রাচীন গ্রীসে বহুদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত।
5) গ্রিক ধর্মের আর এক বৈশিষ্ট্য ছিল মৃতদেহকে কবর দেওয়া। প্রাচীন গ্রীকরা সাধারণত মৃতদেহকে কবর দিত। এই প্রথা কিছুদিনের জন্য তিরোহিত হয়েছিল যখন আইওনীয়ানরা মৃতদেহ দাহ করবার প্রথার প্রবর্তন করেছিল। হোমারের কাব্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু এই নতুন প্রথা কিছুকাল পরেই অন্তর্হিত হল এবং জনগণ মৃতদেহ কবরস্থ করবার স্থানীয় প্রথার পুনঃপ্রবর্তন করল।
6) গ্রীসের অনেক স্থানের অধিবাসীরা নদী, প্রস্তর, প্রস্রবণ ও পর্বতে আত্মার অধিষ্ঠান আছে, এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এদের উপাসনা করত। ডেলফিতে একটি বিশেষ শিলাখণ্ডের উপর সেখানকার অধিবাসীরা প্রতিদিন তেল ঢেলে দিত এবং ছুটির দিনে নতুন পশম দিয়ে ঐ শিলাখণ্ডটিকে ঢেকে দিত। ফ্লিয়াস (Philius) নগরীর মধ্যস্থলে একটি তাম্র নির্মিত ছাগ ছিল স্থানীয় অধিবাসীরা এর পূজা করত। স্থানীয় ধর্মানুষ্ঠানে মসৃণ প্রস্তরগুলির উপাসনা একটি ব্যাপক প্রথারূপে প্রচলিত ছিল।
7) গ্রীসে প্রাচীন সাম্প্রদায়িক ধর্মোপাসনা পদ্ধতিতে কৃষিকার্য এবং তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তর রক্ষাকারী উর্বরতা দেবতাদের পূজার একটি বৃহৎ ভূমিকা ছিল। কৃষিদেবী ডিমিটারের (Demeter) উপাসনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁকে নানা ধরনের ফল, আঙুর, মধু এবং মেষচর্ম প্রভৃতি নৈবেদ্যরূপে নিবেদন করা হত। নৈবেদ্যগুলি একটি বেদীর উপর রেখে অলিভ তেলে ঢেকে দেওয়া হত। সমগ্র সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এগুলি নিবেদিত হত ।
8) গ্রিক দেবতারা গ্রিক জাতিকে বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় রক্ষা করতেন এবং স্থানীয় নগর দেবতারা এবং বীররা গ্রীক জাতির আত্ম-কলহের সময় বিভিন্ন সম্প্রদায়কে রক্ষা করতেন। গ্রীসে নগরীর পৃষ্ঠপোষক দেবপূজা এবং বীরপূজার মধ্যে গ্রীসের রাজনৈতিক ভাঙনের চিন্তাধারার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। যখন মহান গ্রীক দেবতারা এই সমস্ত স্থানীয় পৃষ্ঠপোষককে উৎখাত করে দিয়েছিলেন, তখন গ্রীক নগরীগুলির রাজনৈতিক ঐক্যের না হলেও, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ঐক্যের বর্ধমান প্রবণতা প্রতিফলিত হয়েছিল।
9) কোন কোন গ্রীক(গ্রিক) দেবতা মানুষের বিমূর্ত ভাবধারাগুলির প্রতিমূর্তি ছিলেন। নেমেসিস (Nemesis) ছিলেন প্রতিসিংহসার দেবী, ভাগ্যদেবী ছিলেন মোইরা (Moira), বিজয়ের দেবী ছিলেন নাইক (Nike) এবং থেমিস (Themis) ছিলেন ন্যায়বিচারের দেবী। গ্রীকধর্মে ভাগ্যের ধারণা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কেবলমাত্র মানুষের উপর নয়, দেবতার উপরও ভাগ্যের শক্তি ছিল অপ্রতিহত। এই ধারণা হোমারের কাব্যে এবং গ্রীক ট্র্যাজেডিতে বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
10) গ্রীক (গ্রিক) পুরাণের অনুশীলন এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রকৃত পুরাণ কাহিনীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় প্রধানত গভীর সুপ্রাচীন টোটেমিক স্তর (টোটেম বলতে বোঝায়— প্রাকৃতিক বস্তু, বিশেষ করে কোনো জন্তু পারিবারিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিকট সম্পর্কিত বলে বিবেচিত হয়)। এই টোটেমিক ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে মানুষের জন্তু, বৃক্ষ এবং অচেতন পদার্থে রূপান্তরিত হবার অসংখ্য কাহিনী।
11) পূজাপদ্ধতির অন্যান্য উপাদান ছিল বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, দেবতাদের প্রতিমূর্তিগুলি ধৌত করে সাজানো উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা, পবিত্র স্তোত্র এবং প্রার্থনা সঙ্গীত এবং ধর্মীয় নৃত্যানুষ্ঠান। প্রতিটি অঞ্চলের প্রচলিত কঠোর নিয়ম অনুযায়ী অনুষ্ঠানগুলি সর্বদা অনুষ্ঠিত হত।
12) গ্রীসের দেবমন্দিরগুলির নিজস্ব জমিজমা ছিল এবং ক্রীতদাসও ছিল। সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় মন্দিরগুলিতে মূল্যবান জিনিসপত্র সংরক্ষিত থাকত। ব্যক্তিগত সম্পদ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পনও সেখানে সংরক্ষিত থাকত। মন্দিরগুলি সর্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থান ছিল। মন্দিরগুলির নিজস্ব কোষাগারও ছিল—জনসাধারণের প্রদত্ত অর্থদানে তা উঠত। খ্রিঃ পূঃ চতুর্থ শতাব্দীতে ডেলফির মন্দিরে একটি বিরাট কোষাগার ছিল। সেখানে প্রায় দশ হাজার ‘গ্রীকমুরা ট্যালেন্ট (Talant) সঞ্চিত ছিল। পুরোহিতরা প্রায়ই অর্থ ধার দিতেন, সুদসহ ঐ অর্থ পরিশোধ করতে হত। দেখা যায় খ্রিঃ পূঃ ৩৭৭ অব্দে ডেলসের মন্দির থেকে বিভিন্ন।
মূল্যায়নঃ
প্রথানুসরণই গ্রিক ধর্ম। সামর্থ্য বা ভদ্রতা, আচার-সংরক্ষণ, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা গ্রীক- ধর্মের লক্ষণ। নৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে মধ্যপথ গ্রীকদের অবদান। সুখ বা শক্তি, ঐশ্বর্য বা জ্ঞান সর্বব্যাপারেই আতিশয্য নিন্দিত। ভীরুতার মতই হঠকারিতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতার মতোই কৃচ্ছ্রতা অধর্ম। গ্রীকদের কাছে ধর্মপরায়ণতা বলতে পরিণামদার্শিতা বোঝাত। গ্রীক ধর্মের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল দুর্গের অনুটের মহিমা কীর্তন। গ্রীক ধর্ম মানুষের ব্যক্তিত্বকে প্রাধান্য দিলেও স্বীকার করেছে যে, মানুষের অভ্রভেদী বীর্য আকস্মিকতার আঘাতে মুহূর্তে ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়। জেগার একে প্যাডিয়া (Paideia) বলেছেন।