শিখনের প্রকৃতি আলোচনা করো ।
যে শিখন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং পরিবর্তনশীল, পরিবেশকেন্দ্রিক ও চিরদিনের উদ্দেশ্যমূলক প্রক্রিয়া, যে শিখন আয়সক্রিয়তামূলক বিকাশের এক অন্যতম প্রক্রিয়া, সেই জটিল প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানতে হবে। তা ছাড়া শিখনের সঙ্গে অন্যান্য সমপর্যায়ের মানসিক প্রক্রিয়ার পার্থক্য নিরূপণ করাও দরকার। শিক্ষাবিদ গ্যাগনে শিখনের প্রকৃতি যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা নিন্মে আলোচনা করা হল-
[1] শিখন ও পরিবেশ:
পরিবর্তনশীল জগতের পরিবর্তনশীল পরিবশের সঙ্গে সংগতিবিধান করতে হলে শিখনের প্রয়োজন হয়। পরিবেশ যদি তার প্রতিধর্ম হারিয়ে ফেলে তাহলে শিখনের ক্ষেত্রেও স্থবিরতা পরিলক্ষিত হবে।
![]() |
শিখনের প্রকৃতি |
[2] শিখন ও আত্মসক্রিয়তা:
আত্মসক্রিয়তার ফলশ্রুতিতে শিখনের ব্যপ্তি ঘটে। অতীত অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে ব্যক্তি আত্মসক্রিয় হয়ে ওঠে, ফলে আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। শিখন প্রক্রিয়াই আত্মসক্রিয়তার বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন সময়ে নানারকম ফল দান করে।
[3] শিখন ও প্রেষণা:
শিখনের অন্যতম প্রকৃতি হল প্রেষণা। মনোবিজ্ঞানী গ্যারেট বলেছেন, Learning is a function of motive incentive condition” । অর্থাৎ শিখন হল, প্রেষণা-উবোধকের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপ । গাণিতিক সমীকরণ দ্বারা এটিকে প্রকাশ করলে হয়, শিখন = প্রেষণ X উদ্বোধক। প্রেষণা হল কোনো ব্যক্তির এমন এক আন্তরিক অবস্থা বা তাগিদ যা তাকে নির্দিষ্ট ধরনের আচরণের জন্য এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করে (A motive is a set or a state of individual which disposes him for certain behaviour and for reaching certain goal.) যে বস্তু সরাসরিভাবে বা পরোক্ষভাবে আমাদের মধ্যে প্রেষণা তৈরি করে, তা-ই হল উদ্রোধক; আর অন্তর্জগতের অকুণ্ঠ তাগিদ জন্ম দেয় প্রেষণার। সুতরাং বলা যায় যে, প্রকৃতিগতভাবে শিখন, প্রেষণার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
[4] শিখন ও ফল:
যে প্রক্রিয়ায় আমরা জ্ঞান (Knowledge) দক্ষতা (Skill) প্রভৃতি অর্জন করে থাকি, তাকে বলে শিখন (Learning)। সুতরাং, শিখন হল এক মানসিক প্রক্রিয়া (Mental Process), জ্ঞান (Knowledge) ও দক্ষতা (Skill) হল শিখনের ফল।
[5] শিখন ও ক্রমবিকাশ:
শিখনের প্রকৃতি হল ক্রমবিকাশ। অনেকক্ষেত্রে অনুশীলনের ফলশ্রুতিতে শিখন হয়। সমস্যাসংকুল মানবজীবনে সমস্যার শেষ নেই। তাই যখন কোনো ব্যক্তি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন সে সেই সমস্যা থেকে মুক্তিলাভের জন্য আত্মপ্রচেষ্টা আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। তার এই প্রচেষ্টাই তাকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। মানবসভ্যতার ধারা ক্রমবিকাশমান। এই ক্রমবিকাশের ধারাকে লেখচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করলে দেখা যাবে, অনুশীলন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই লেখ ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। একে বলা হয় শিখনের লেখ (Learning Curve) সুতরাং, শিখন হল ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়া (Gradual Learning Process)।
[6] শিখন ও চাহিদা:
শিখন ব্যক্তিগত চাহিদা ও সামাজিক চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটায়। চাহিদার তৃপ্তি আনে মূল্যবোধের বিকাশ। সুতরাং, এই দুই ধরনের চাহিদা মেটানোর জন্য, কল্যাণকর জীবনদর্শন গঠনের জন্য, প্রগতিশীল সমাজগঠনের জন্য শিখনের প্রয়োজন আছে। তবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চাহিদা নিবৃত্তি করতে শিখন আচরণের যে পরিবর্তন ঘটায় তা সবসময় বাঞ্ছিত হয় তা যেমন ঠিক নয়, তেমনই ঠিক নয় সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে।
[7] শিখন, বৃদ্ধি ও পরিণমন:
শিখন এক ধরনের বৃদ্ধি বা বিকাশের প্রক্রিয়া (Growth or Developmental Process) । দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে পরিবেশের সঙ্গে সংগতিসাধনের মাধ্যমে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে, তৈরি হতে থাকে মানবসত্তা। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর দৈহিক বিকাশ ঘটে, ফলে অধিকতর ডারী ওজনের জিনিস সে সহজেই বহন বা স্থানান্তরিত করতে পারে। তবে এই আচরণকে শিখন বলা যায়। না, কারণ এর জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। এই ধরনের আচরণ হল পরিণমনের ফসল। সুতরাং, পরিণমন কোনো দৈহিক পরিবর্তনের ফল হলেও শিখনে সবসময় দৈহিক কারণ নাও থাকতে পারে। মনোবিজ্ঞানী বার্নার্ড বলেছেন, “Maturation is biological as contrasted to a psychological or learning phenomenon” । অর্থাৎ, পরিগমন হল একটি জৈবিক ক্রিয়া থাকে মনস্তত্ত্ব বা শিখন সম্বন্ধীয় ঘটনার বৈসাদৃশ্য দেখানোর জন্য তুলনা করা হয়।
[8] আচরণের পরিবর্তন:
শিখন হল এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আচরণের পরিবর্তন ঘটে। আচরণের পরিবর্তন ছাড়া শিখন কখনোই সম্ভব নয়। তাই বলা যায়, শিখন ঘটলেই আচরণের পরিবর্তন ঘটে।
[9] নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন:
শিখনের ফলে একদিকে যেমন আচরণের পরিবর্তন ঘটে অন্যদিকে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। প্রকৃতপক্ষে নতুন ধরনের আচরণ সম্পাদনের পিছনে থাকে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অবদান।
[10] প্রেষণা নির্ভর প্রক্রিয়া:
শিখন হল একটি প্রেষণানির্ভর প্রক্রিয়া। শিখনের ফলে আচরণের যে পরিবর্তন ঘটে তার একটি বিশেষ গতিপথ থাকে। শিখনের পূর্বে কোনো ব্যক্তির মধ্যে যে প্রেষণার সৃষ্টি হয়, ওই বিশেষ পথ ধরে চললে ব্যক্তির মধ্যে পরিতৃপ্তি আসে।