উনিশ শতকে বাংলা গানের উদ্ভব ও বিকাশ।
দুশো বছরের ও আগে প্রথম বাংলা নাটকের লেখক লেবেদেফ বাঙ্গালীদের চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছিলেন যে, বাঙালিরা ভালোবাসে গান আর ভাঁড়ামি। কিন্তু গানের প্রতি তাদের ভালোবাসা থাকা সত্বেও প্রাচীনকালের বাংলা গানের উদ্ভব এবং ক্রম – বিকাশের ইতিহাস বাঙালিরা লিখে রাখেননি। কিন্তু গান এ দেশে আগা গোড়াই ছিল। তবে সুর তাল এবং সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্য দিয়ে গান তৈরি হয় আরো পরে। আগে যেমন মানুষের মুখের ভাষার সৃষ্টি হয়েছে ঠিক তেমনি লিখিত ভাষা এবং তার ব্যাকরণ ও গানেরও সৃষ্টি হয়েছে।
![]() |
উনিশ শতকে বাংলা গানের উদ্ভব ও বিকাশ |
বঙ্গের আদিবাসীরা যে গান গাইতেন তার সুর-তাল এবং তাদের বাদ্যযন্ত্র পরবর্তীকালে কতটা রক্ষা পেয়েছে তা সম্বন্ধে যথাযথ কোন তথ্য প্রমাণ নেই। গোড়ায় আর্যরা কি ধরনের গান এবং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছিলাম তারও কোন সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর্যদের ধর্ম যেমন স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচার-আচরণের সঙ্গে মিশে একটা নতুন রূপ নিয়েছিল ঠিক একইভাবে সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও সেই বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছিল। আর্যদের সংগীতের সঙ্গে স্থানীয় আদিবাসীদের সংগীতের সংযোগ ও সমন্বয় ঘটেছিল, এর ফলে বিভিন্ন রাগরাগিনীর জন্ম হয়েছিল।
আধুনিক কালের মতো প্রাচীন বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলেও বিভিন্ন লোক সংগীত প্রচলিত ছিল। এমনকি সেই লোক সঙ্গীতের ভিত্তির উপর পরবর্তী কালের লোকসংগীত রচিত হওয়া সম্ভব। আর্যরা ভারতে যে শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে এসেছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এর যথাযথ প্রমাণ আমরা চর্যাপদ থেকে পেয়ে থাকি, চর্যাপদে এই রাগরাগিনীর সংখ্যাগুলি মোট 19টি। পটমঞ্জরী চর্যায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পদের ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও চর্যার অন্যান্য রাগ রাগিনী গুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- গৌড়, মালসী, মল্লারী, কামোদ ইত্যাদি। এই রাগ রাগিনী গুলি কয়েকটি এখন লোপ পেয়েছে।
চর্যাপদ যেমন বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন তেমনি তা বাংলা গানেরও আদি নিদর্শন। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা এই পথগুলি সুর করে গাইতেন। বেশিরভাগ লোকই সুর করে ওই পথগুলি আবৃত্তি করতেন। ধর্মের সঙ্গে মানুষের গভীর আবেগের যোগ আছে বলেই ধর্মীয় শ্লোক সুর করে গাইবার রীতি সব ধর্মেই কমবেশি লক্ষ্য করা যায়। এবং বাংলা গানেরও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি সেজন্যেই দেখা যায় যে বাংলা গানের সঙ্গে বঙ্গদেশে বিভিন্ন ধর্মের উত্থান পতনের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত আছে।
সেন রাজাদের দরবারে বঙ্গের সেকালের সবচেয়ে বড় কবি জয়দেব রচনা করেছিলেন গীতগোবিন্দ। নামটি থেকেই বোঝা যায় কাব্য নয় এটি ছিল গাওয়ার মতো একটি পালা। গীতগোবিন্দের ভাষা ছিল সংস্কৃতি এবং এই গান কেবল বঙ্গেই গাওয়া হত। চর্যার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় গীতগোবিন্দে সর্বভারতীয় রাগ রাগিনীর ব্যবহার অনেক বেশি। তবে গীতগোবিন্দের মোট রাগরাগিনীর সংখ্যা মাত্র 12 টি। প্রতিটি পদে তালের নাম লেখা আছে তার সংখ্যা মাত্র পাঁচটি। যেমন – একতাল,অষ্টতাল,যতি,রুপক ও নি:সার। এছাড়া চর্যাপদের সাথে চারটি রাগিনীর মিল আছে- গুঞ্জরী,দেশভাগ,বরাড়ী এবং ভৈরবী, তার মধ্যে একটি হলো ‘মালবগৌড়’ যার নাম থেকে বোঝা যায় এটি ছিল উত্তর ভারত থেকে আসা মালব রাগিনীর বঙ্গীয় সংস্করণ।
গীতগোবিন্দের 250-300 বছর পরে রচিত বাংলা গানের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ হল বড়ু চন্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। যা ছিল এ যুগের ভাষায় রচিত। রাধা কৃষ্ণ আর বাড়ায়ির সংলাপ পালা গানের আকারে লেখা। এতে ও রাগ রাগিনি উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থের রাগ রাগিনী গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গুর্জরী, বরাড়ী, দেশাখ, ভৈরবী, ভাটিয়ালি ইত্যাদি। এই রাগ রাগিনী গুলির কয়েকটি আবার গীতগোবিন্দের সঙ্গে অভিন্ন। এছাড়া এই গ্রন্থে পাহাড়ি এবং বেলাবলী, সহ কিছু সংযোজন ও দেখা যায়।
সতেরো শতকের আগে বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়নি। লালন ফকিরের আবির্ভাবের পর আঠারো শতকে বাউল গানের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে ও বাউল গান জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ সময় হঠাৎ করে নতুন সুর বা গাইবার ভঙ্গি তৈরি হল তা নয় বরং মনে করা হয় এটি হলো এক বিশেষ ধরনের লোকগীতি যাকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ভাষায় বলা হয় ভাটিয়ালি সুর বাউলের কোন ধর্মগ্রন্থ বা স্বাস্থ্য নেই এমনকি কোন অনুষ্ঠানিক ধর্ম নেই। তারা একজন ভক্তিবাদী গুরুতে বিশ্বাসী।
তবে পার্থক্য এই যে তাদের কর্তা হলেন পীর, যাকে তারা বলেন মুরশিদ, সেই মুরশিদের নামে যে গান তা পরিচিত হয়েছে মুরশিদী গান হিসেবে। বাউল গান কে একটা বিশেষ অঞ্চলেরই গান মনে করা হয় – কুষ্টিয়া এবং বীরভূমের। উত্তর পূর্ববঙ্গেরও এক ধরনের সুরের দিক দিয়ে কুষ্টিয়া, বীরভূমের বাউল গানের ঘনিষ্ঠ মিল চোখের পড়ে।
বাংলা গানের ধারায় আমরা প্রথম যে গানকে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ গান হিসেবে পাই তা হলো নিধু বাবুর গান বা নিধু বাবুর টপ্পা। আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে তিনি চাকরি সূত্রে লখনৌ তে গোলাম নবী নামে এক ওস্তাদের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চা করেন। এই ধারাই তাকে যে ধারার সংগীত সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে তা হলো টপ্পা। এই টপ রচিত হয়েছিল পাঞ্জাবি লোকগীতির ওপর ভিত্তি করে। নিধুবাবু কলকাতায় ফিরে তার টপ্পা গান চালু করেন 1800 সালের বছর ছয়েক আগে।
গানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গীতিকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মে সুন্দর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন , নিজেই নিজের গান পরিবেশন করতে পারেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রথম 10 বছর গ্রাম্যফোন রেকর্ডে তার চেয়ে বেশি গান কেউ গান নেই। সেকালে রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া অন্য যেসব গান গাওয়া হয়েছিল যার মধ্যে কয়েকটি রেকর্ড রক্ষা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আমলে চড়া গলা বা টেনর ভয়েস কে আদর্শ বলে মনে করা হতো। 1930 এ দশকে পঙ্কজ মল্লিক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং দেবব্রত বিশ্বাস সবাই মিলেই ভারী গলায় রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করে রবীন্দ্র সংগীতের নতুন মান ও আদর্শ স্থাপন করেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রাও বাংলা গানের অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি এসেছিলেন ভিন্ন একটা পরিবেশ থেকে। এবং সে কারণে তার গান রবীন্দ্র সংগীতের থেকে স্বাদে ও রুচিতে অনেকাংশে আলাদা। দ্বিজেন্দ্রলাল জন্মেছিলাম কৃষ্ণনগরের একটি ঐতিহ্যিক হিন্দু পরিবারে। তিনি তার পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের থেকে সংগীতের তালিম পেয়েছিলাম। 1890 এর দশকে তিনি যখন বাংলার বাইরে কাজ করতেন তখন তার বন্ধু বিশিষ্ট গায়ক সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার এবং অন্য একাধিক ওস্তাদের কাছে তিনি খেয়াল এবং টপ্পা গান শেখেন। তার গানে অনেকগুলি স্তবক থাকে বটে, কিন্তু সেসব স্তবক বারবার ঘুরে ঘুরে একই সুরে গায়ক হয়। হাসির গানে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নিঃসন্দেহে সবার উপরে জায়গা পেতে পারেন।
1970 এর দশকে বাংলা গান আরো একবার নতুন বাক নাই। এর জন্য দায়ী ছিল বিশেষ করে প্রযুক্তির উন্নতি। এ সময়ে ক্যাসেট রেকর্ডার চালু হবার পর ঘরে ঘরে গানের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং সেই চাহিদার যোগান দেওয়ার চেষ্টায় অসংখ্য গায়ক গায়িকা সুরকার গীতিকার এগিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রলাল অতুলপ্রসাদ রজনীকান্ত অথবা নজরুল ইসলামের মতো প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন না ছিলেন নিত্যান্ত মাঝারি মেধার কারিগর।
![]() |
ক্যাসেট রেকর্ডার |
বাঙ্গালীদের শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চার যেটুকু ইতিহাস জানা যায় তা হল উনিশ ও কুড়ি শতকের। আমরা লক্ষ্য করেছি উনিশ শতকের কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে দুই দূরান্ত থেকে বহু লোক এসে জুটেছিলেন ভাগ্যের অন্বেষণে। এদের মধ্যে অবাঙালি সংগীতজ্ঞ ও কিছু মুসলমান সংগীতজ্ঞ ও ছিলেন। এদের কেউ ছিলেন কন্ঠ শিল্পী ও কেউ যন্ত্র শিল্পী। এই শিল্পীদের নিয়ে উনিশ শতকে বাংলা গানের উদ্ভব ও বিকাশ গোড়া থেকেই শাস্ত্রীয় সংগীত বিকাশের একটি প্রয়াস শুরু হয়।
মূল্যায়ন
এ পর্যন্ত আমরা নিত্যান্ত মোটা দাগে উনিশ শতকে বাংলা গানের উদ্ভব ও বিকাশ বর্ণনা করেছি। বাঙালি সংগীতের ইতিহাসে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বলাবাহুল্য বঙ্গদেশের সংগীতের ইতিহাস কেবল বাংলা গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারাও প্রবাহমান ছিল।