রোমান ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এই প্রসঙ্গে রোমান ঐতিহাসিকগণের পদ্ধতিগত দিকগুলি আলোচনা করো
ইতিহাস প্রবহমান। আবহমানকাল ধরে সে বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী। ইতিহাস তথ্যনির্ভর। কিন্তু তথ্যের নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলিকে ভাষা প্রদান করা ঐতিহাসিকের প্রধান কর্তব্য। সেই যুক্তি অনুসারে ইতিহাস ও ঐতিহাসিক একে অপরের পরিপূরক। ঐতিহাসিক মূলত ইতিহাসের ব্যাখ্যাকার (Interpreter of History) এবং তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিকে মূর্ত রূপ দেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা করেন।
![]() |
রোম |
তথ্যনির্ভর এবং ঐতিহাসিক ঘটনার সঠিক ও কালদর্শী যুক্তিসংগত বিন্যাস (Logical Chronological Sequence) পশ্চিমের ইতিহাস বীক্ষণের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস বীক্ষণের একটি গুণগত পার্থক্য অবশ্যই লক্ষণীয়। প্রাচীন ভারতে যেখানে ইতিহাস ছিল বৃত্তাকারধর্মী (Cyclic), সেখানে পশ্চিমের ইতিহাস ছিল সরলরেখাঙ্কিত (In Linear Sequence) এবং অধিক সাবলীল। পশ্চিমের ইতিহাসচর্চায় ঘটনার প্রবহমানতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমের ইতিহাস বীক্ষণের ক্রমবিকাশের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয় ।
হেরোডোটাস ও থুকিডিডিস ব্যতিরেকে আরেকজন ঐতিহাসিক হলেন পলিবিয়াস (Polibius, খ্রি.পূ. 208-216) তাঁর সারগর্ভ রচনা Histories-এর মাধ্যমে পলিবিয়াস রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ইতিহাস লিপিবন্ধ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে খ্রিস্টপূর্ব 200-এ রোম গ্রিস দেশ অধিকার করে এবং গ্রিস একটি রোমান প্রদেশে পরিণত হয়। পলিবিয়াস পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস (Total History) রচনার ওপর জোর দেন এবং যুদ্ধ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন। উনি ইতিহাসের বাস্তবধর্মিতা বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের দর্পণরূপে ইতিহাসকে ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন। রোমান ঐতিহাসিকদের মধ্যে ক্যাটো (Cato), লিভি (Livy), ট্যাসিটাস (Tacitus), মুটার্ক (Plutorch) প্রমুখর নাম নেওয়া যেতে পারে, পাশ্চাত্য ইতিহাস বীক্ষণের ক্ষেত্রে যারা প্রত্যেকেই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
ক্যাটো দ্য এলডার (Cato the Elder) অথবা ক্যাটো খ্রিস্টপূর্ব 234 140 অব্দে রোমান ইতিহাসের পুরোধা ছিলেন। সাত খণ্ড বিশিষ্ট তাঁর গ্রন্থ অরিজিন্স (Origines) রোমান ইতিহাসের এক অসামান্য কীর্তি। এই গ্রন্থে ক্যাটো ইতিহাসের শিক্ষামূলক দিকটি তুলে ধরার প্রয়াস করেন। তাঁর মতানুসারে ইতিহাস দেশাত্মবোধ, নীতিজ্ঞান এবং যুবকদের চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এইভাবে ক্যাটো ইতিহাসের সদর্থক দিক নির্দেশ করেন। এ ছাড়া তাঁর গ্রন্থে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, ভূগোল, নৃতত্ত্ব ইত্যাদির সমাহার ঘটেছে যা ইতিহাস চর্চাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদান করে।
লিভি (Livy খ্রিস্টপূর্ব 59-17 অব্দ) ছিলেন একাধারে কবি ও ঐতিহাসিক। রোমের ইতিহাস (History of Rome) তাঁর অমর কীর্তি। এই গ্রন্থে রোমের মাহাত্ম্যকে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া রোমের সঙ্গে কার্থেজের যুদ্ধ, রোমের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, রোমান সংবিধান এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। লিভি সম্রাট অগাস্টাসের (Augustus) পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।
ঐতিহাসিক কর্নেলিয়াস ট্যাসিটাস (Cornelius Tacitus, খ্রিস্টপূর্ব 55-120 অব্দে) অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং আইনশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন পারিবারিক ঐতিহ্য, বক্তৃতা, চিঠিপত্র ইত্যাদির ব্যবহারের ওপর জোর দেন। হিস্ট্রিজ (Histories) এবং অ্যানালস (Annals) তাঁর প্রখ্যাত রচনা। এ ছাড়া ডায়ালগস অন ওয়েটরস (Dialogues on Orators), এগ্রিকোলা (Agricola), দ্য জার্মেনিয়া (De Germania) অন্যান্য গ্রন্থ বিশেষ। ট্যাসিটাস ইতিহাসের দ্বারা নীতিবোধ শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপকে ইতিহাসকেন্দ্রিক নীতিশিক্ষার আলোয় পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করার ওপর জোর দেন। তাঁর মতানুসারে ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য হল দুই ব্যক্তির আবরণ উন্মোচন এবং শিষ্টের নীতিনিষ্ঠ কার্যকলাপের যথাযথ সংরক্ষণ।
প্লুটার্ক (খ্রিস্টপূর্ব 46–126) তাঁর গ্রন্থ প্যারালাল লাইভস (Parallel Lives)-এর জন্য বিশেষভাবে স্বীকৃত। তিনি এশিয়া মাইনর, মিশর এবং ইতালি ভ্রমণ করেন এবং অবশেষে রোমে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং আত্মচরিতমূলক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নিজেকে আত্মনিযোগ করেন।
মূল্যায়ন:
সমগ্র আলোচনার ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে রোমের ইতিহাসের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের কার্যকলাপ, তার বিভিন্ন প্রচেষ্টা ও ফলাফল। মানবকেন্দ্রিক এই ঐতিহাসিক ভাষা পাশ্চাত্য ইতিহাসচর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইতালির নবজাগরণের অনুপ্রেরণার ছিল এটি মূল উৎস।