StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ইউয়ান শি-কাইয়ের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ আলোচনা করো

ইউয়ান শি-কাইয়ের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ আলোচনা করো। 

Q – ইউয়ান শি-কাইয়ের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ

ভূমিকাঃ

প্রজাতান্ত্রিক সরকারের অস্থায়ী সভাপতি মনোনীত হয়েই তাকে প্রহসনে পরিণত করেন ইউয়ান শিকাই (১৮৫৯-১৯১৬)। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর সানের তুং মেং হুই-এর নতুন নামকরণ করা হয়েছিল কুয়োমিন টাং। ইউয়ান শিকাইয়ের ক্ষমতা দখলের পর চীনা পার্লামেন্টে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছিল কুয়োমিন টাং। ইউয়ান শিকাই সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ব করে প্রজাতন্ত্রের কার্যকারিতা বিনষ্ট করেন। ঐতিহাসিক এইচ. এম. ভিনাক (H. M. Vinacke) তাই এর নাম দিয়েছিলেন “Phantom Republic” বা অলীক প্রজাতন্ত্র

প্রথম থেকেই  ইউয়ান শি-কাই সামরিক বৃত্তি গ্রহণ করে নিজ যোগ্যতাবলে উচ্চপদে আসীন হন। মাঞ্চু রাজতন্ত্র বা চীনা প্রজাতন্ত্র কোনটির বিষয়েই তাঁর অবিচল আস্থা ছিল না; ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করাই তার আসল লক্ষ্য ছিল।

মাঞ্চুরাজতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধনের পর তাঁর লক্ষ্য ছিল ১৯১২-১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রজাতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এর কার্যকারিতা বিনষ্ট করা এবং নিজেকে সম্রাট পদে উন্নীত করা। প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় যে অস্থায়ী সংবিধান তৈরী হয়েছিল তাতে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট গঠনের পূর্ব পর্যন্ত আইন বিষয়ক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল প্রদেশগুলির প্রতিনিধিত্বকারী সিনেটের কাছে। রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রধান সেনাপতি বা মুখ্য নির্দেশক। তিনি সমস্ত উচ্চবিভাগীয় প্রশাসনিক পদাধিকারীদের নিয়োগের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তিনি কেবিনেট সদস্যদের নিয়োগ করতে পারতেন না। কেবিনেট রাষ্ট্রপতির কাছে দায়িত্বশীল থাকলেও তার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিল না। আসলে এই অস্থায়ী সংবিধান ইউয়ান এবং বিপ্লবীদের মধ্যে আপোসের ফলশ্রুতি ছিল। অতি অল্প দিনের মধ্যেই সংবিধানের অস্পষ্টতা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত বাধে যা গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছিল এবং ১৯১৩ থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চীনকে বিভক্ত রেখেছিল।

ইউয়ান শি-কাই

প্রজাতন্ত্রের সমর্থকগণ এই সময় দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পূর্বের সংবিধানপন্থীরা প্রগতিবাদী দল বা Progressive Party গঠন করে। সান ইয়াৎ সেনের তুং মে হুই, যা এতদিন গুপ্তসমিতি ছিল, তা জাতীয়তাবাদী দলে রূপান্তরিত হয় এবং নাম হয় কুয়োমিন টাং, একথা আগেই বলা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যায় যে চীনে একটি স্থায়ী ও কার্যকর দ্বিদলীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল বিশেষত যখন কুয়োমিনটাং দল তাদের কৃষকদের ভূমি পুনর্বণ্টনের মত চরম দাবী দাওয়াগুলি । সাময়িকভাবে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। বাস্তবে অবশ্য এই চিন্তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অতি দ্রুত এই দুটি বৃহৎ দল ব্যক্তিগত আনুগত্য ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে অনেকগুলি উপদল বা চক্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার কোনটিরও কোন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। একাধিক দলের সদস্যপদ নেওয়া একটি সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত হয়।

চীনের নির্বাচক মণ্ডলী (clectorates) ছিল অতি নগণ্য, বলতে গেলে পার্লামেন্টের সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের নির্বাচন করতেন। বস্তুত চীন সংসদীয় ঐতিহ্যের দিক থেকে এতই নবীন ছিল যে সামাজিক গোষ্ঠীগুলির স্বার্থ রাজনীতিতে প্রতিফলনের স্তরে উন্নীত হয়নি। ব্যক্তিগত আনুগত্য, পৃষ্ঠপোষণা ও উৎকোচ প্রদান প্রভৃতি সংসদের সদস্যদের রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করত। এই পর্যায়ে চীনে সংসদীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা বিশেষ সুখকর হয়নি।

ইউয়ান শি-কাইয়ের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপঃ

জ্যাক গ্রে মনে করেন যে সাংবিধানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খায়নি। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে এখানে ঘৃণার চোখে দেখা হত। সর্বসম্মতির বিকল্প হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠর মতকে চীনারা গ্রহণ করতে চায়নি। চীনে শক্তিশালী সরকার বলতে স্বৈরতন্ত্রকে বোঝাত। নীতিগতভাবে পার্লামেন্টের সদস্যরা ইউয়ানের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপকে সংবিধানের প্রতি চ্যালেঞ্জ বা অবমাননা মনে করেনি। বরং কুয়োমিন টাং-এর সংখ্যালঘিষ্ট সদস্যগণ ইউয়ান শি-কাইয়ের স্বৈরতান্ত্রিক  কার্যকলাপের বিরোধিতা করলে তাঁদেরই বিপদজনক চরমপন্থীরূপে আখ্যা দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। এমনকি তারা নিজেদের দলীয় সহকর্মীদের কাছ থেকেও সেরকম সমর্থন পাননি। দলের অনেক সদস্যর মত সান নিজেও কুয়োমিনটাং-কে দেখেছিলেন সকল সদিচ্ছা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের ইউনিয়ন বা মিলনক্ষেত্ররূপে ক্ষমতা বা পদ দখলের জন্য সংগঠিত একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়।

চীনের দুর্বল সংসদীয় ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক দলগুলির অনৈকা এবং অসংগঠিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে ইউয়ান শিকাই স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রথম মন্ত্রীসভায় বৈদেশিক, অভ্যন্তরীণ, যুদ্ধ ও নৌ এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচরদের প্রদান করেন। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ চারটি দপ্তর (শিক্ষা, বিচার, কৃষি ও বন) তিনি তুং মেং হুই সদস্যদের বন্টন করেন। যুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে বিপ্লবীদের পছন্দ। হুয়াং সিং (Huang Hsing)-কে নানকিং-এর রেসিডেন্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এছাড়া হুয়াং সিং তার ৫০,০০০ সৈন্যকে (ইউয়ান সরকার বেতন দিতে অস্বীকার করলে) ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হন।

ইউয়ান শি-কাই যাবতীয় সাংবিধানিক রীতি নীতি লঙ্ঘন করে নিজস্ব কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেন। ইউয়ানের আশ্রিত ট্যাং শাও-ইকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করা হলেও তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। কেননা তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন যা ইউয়ানের গোপন স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।

১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন ট্যাং পদত্যাগ করলে তুং মেং হুই এর চার মন্ত্রীও পদত্যাগ করেন। বস্তুত ট্যাং-এর পদত্যাগ না করে উপায় ছিল না। কারণ তার দলীয় সংগঠন, পৃষ্ঠপোষক, বাজেট এবং মন্ত্রীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুই ছিল না। এরপর প্রধানমন্ত্রীরূপে নিযুক্ত হন লু চেং-সিয়াং (Lu Cheng hsiang) নামক অকর্মণ্য কূটনীতিবিদ। তাঁর নীতি নির্ধারণ ও কর্মপরিচালনার অক্ষমতার দরুন তাকে পার্লামেন্ট অভিযুক্ত করে এবং লু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তাঁর দপ্তরে যাওয়া বন্ধ করেন। এরপর প্রধানমীর পদে নিযুক্ত হন ইউয়ানের বিশ্বস্ত অনুচর চাও পিং চুন (Chao Ping Chun) ।

তাঁর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা রাষ্ট্রপতির পুতুল মন্ত্রিসভায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে সংসদীয় প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে একনায়কতন্ত্রের রূপদান করেন রাষ্ট্রপতি ইউয়ান শি-কাই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ইউয়ান প্রদেশের সামরিক গভর্নরদের ওপরে ক্ষমতা বিস্তার করতে শুরু করেন।

এ পর্যন্ত সান ও ইউয়ান শিকাই কেউ কারও বিরুদ্ধে সরাসরি বিরোধে অবতীর্ণ হন। নি। এই সময় সানের নিজেরও পার্লামেন্টের বিষয়ে খুব আগ্রহ ছিল না; কেননা তাঁর মতে পার্লামেন্টের সৃষ্টি ছিল তখন অপরিণত। চীনের জনগণ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠার মত রাজনীতি সচেতন তখনও হয়ে ওঠেনি। তিনি গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার মত কাঠামো রচনা করেছিলেন যা তৃণমূল স্তরে গণতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাসনের মাধ্যমে বিকশিত হওয়া সম্ভব ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জাতীয় সংসদীয় সরকার ছিল এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ।

তিনি ইউয়ানকে সমালোচনা করলেও সমর্থন জানিয়ে এসেছিলেন। অন্যদিকে ইউয়ানও বিপ্লবীদের সঙ্গে সরাসরি বিচ্ছেদ ঘটাতে চাননি। তবে সানকে রাজনৈতিক দিক থেকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার জন্য তাঁকে ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রেলওয়ের ডাইরেক্টর নিয়োগ করা হয় জাতীয় রেলপথ পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য। সানের তখন এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে ইউয়ানের মত একজন যোগ্য ও নিষ্ঠাবান মানুষের বিশেষ প্রয়োজন যিনি পরবর্তী দশ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট পদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বিবেচিত হবেন। চীনা বিপ্লবের নেপোলিয়ন নামে খ্যাত হুয়াং সিং (Huang Hsing)-এর প্রতিও ইউয়ান আন্তরিক ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে তাঁকে ক্যান্টন হ্যানকাও জেচওয়ান রেলপথের ডিরেক্টর জেনারেল পদে নিয়োগ করেন। এইভাবে প্রধান দুই বিপ্লবী নেতাকে তুষ্ট করে ইউয়ান শি-কাই তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে তৎপর হন। 

১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকারের মাধ্যমে এই নির্বাচনে কুয়োমিনটাং ফল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কুয়োমিং টাং দলের এই নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল সুং চিয়াও জেনের (Sung Chiao Jen)। সংসদীয় রীতি সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা এবং তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা তাঁকে এই সাফল্য এনে দিয়েছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পূর্বেই চারটি উপদলকে একত্রিত করে তিনি জাতীয়তাবাদী দল বা কুয়োমিনটাং গঠন করেন যা তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা প্রমাণিত করে। এই নির্বাচনে নিম্নকক্ষের ৫৯৬টি আসনের মধ্যে ২৬৯টিতে জাতীয়তাবাদীরা জয়লাভ করে এবং উচ্চকক্ষের ২৭৪টি আসনের মধ্যে -১২৩টিতে তারা জয়ী হয়।

বস্তুত জাতীয়তাবাদী দল আরো তিনটি দল নিয়ে গড়ে ওঠা প্রগতিবাদী দল (Progressive Party) এর চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছিল। এর ফলে সুং মধ্যচীনে ব্যাপক প্রচার চালান। তিনি চীনা প্রশাসনের সমালোচনা করে কুয়োমিন টাং দলের মন্ত্রীসভা গঠনের কথা বলেন, যদিও ইউয়ান শি-কাইকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে তাঁর কোন আপত্তি ছিল না। ফেয়ারব্যাঙ্ক এই সময়কে চীনা সংসদীয় গণতন্ত্রের উচ্চসীমা আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু সুং-এর সাংগঠনিক ক্ষমতা, সংসদের প্রতি দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভা গঠন এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমতা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রচার ইউয়ানকে রুষ্ট করেছিল। তাই ইউয়ান কৌশলে সুংকে আততায়ী দ্বারা হত্যা করেন। ফেয়ারব্যাঙ্ক লিখেছেন যে সুং-এর এই হত্যাকাণ্ড এই নীতি জাহির করেছিল যে ক্ষমতাধারী ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে এবং বিরোধী আন্দোলনের নেতাকে নিধন করে সেই আন্দোলন দমন করা যায়।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কুয়োমিন টাং দল নেতৃবিহীন হয়ে পড়ে। মধ্যপন্থীরা তখনও পার্লামেন্টে আইনগত উপায়ে প্রেসিডেন্ট ইউয়ান শি-কাইকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই সময় ইউয়ান সান ইয়াং সেন ও হুয়াং সিং-এর প্রতিরোধ উপেক্ষা করে পঞ্চশক্তি সম্পন্ন ব্যাঙ্ক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। কঠিন শর্তসাপেক্ষে বিদেশী শক্তিবর্গের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন সান ও হুয়াং সিং, কারণ তারা বুঝেছিলেন এর পরিণাম স্বরূপ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চীনকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলবে। স্বদেশপ্রেমী চীনারা পাশ্চাত্য শক্তির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের বিরোধী ছিল, কারণ ঋণের বিনিময়ে তারা চীনের লবণ কর আদায়ের অধিকার দাবি করেছিল। তাই তাঁরা পার্লামেন্টের সদস্যদের এই অবৈধ বেআইনী ঋণ বর্জন করতে আহ্বান জানান। 

অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ইউয়ান শি-কাইয়ের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছিল। কারণ তারা বুঝেছিল চীনে প্রজাতান্ত্রিক সরকার শক্তিশালী হলে তা সাম্রাজ্যবাদের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়াবে। যাইহোক এই বিদেশী ঋণ গ্রহণকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীদের সঙ্গে ইউয়ানের বিরোধ তীব্র হলে এবং জাতীয়তাবাদীরা ইউয়ানের দুনীর্তিপূর্ণ কার্যকলাপের বিচারের দাবি তুললে ইউয়ান তড়িৎ গতিতে কিয়াংসি, কোয়াংটুং এবং আনহুই প্রদেশের সামরিক গভর্নরদের পদচ্যুত করেন এবং দক্ষিণ চীন আক্রমণের প্রস্তুতি নেন।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জুলাই কিয়াংসি প্রদেশের সামরিক গভর্নর স্বাধীনতা ঘোষণা করলে একমাসের মধ্যে আরও ছয়টি প্রদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। চীনের ইতিহাসে এই উল্লেখযোগ্য ঘটনা দ্বিতীয় বিপ্লব (2nd Revolution) নামে খ্যাত। তবে ইউয়ানের দক্ষিণের এই অসংগঠিত বাহিনীকে পরাস্ত করতে বেগ পেতে হয়নি। দু-মাসের মধ্যেই ইউয়ানের সামরিক নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহ দমন করে গোটা ইয়াংসির বিস্তৃত অঞ্চলের ওপরে নেতৃত্ব কায়েম করেন।

বিদেশী ঋণ গ্রহণের বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে রূদ্ধ করতে ইউয়ান সফল হয়েছিলেন। কারণ তাঁর প্রতি সাধারণ জনগণের এই ধারণা জন্মেছিল যে একমাত্র তিনি-ই চীনকে ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিতে রাখতে সক্ষম। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিনি প্রগতিবাদী দলের (Progressive Party)-এর সমর্থন পেয়েছিলেন, কুয়োমিনটাং সদস্যরাও তাঁকে সহ্য করে এসেছিলেন এবং উত্তর চীনের সামরিক প্রদেশপালদের পূর্ণ সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। যাইহোক “দ্বিতীয় বিপ্লব” সময়ের পরে ইউয়ানের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। তিনি অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের পদে সন্তুষ্ট না থেকে সারা জীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি হবার উদ্যোগ নেন। এরপর তিনি নিজেকে সম্রাটপদে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেন।

সংবিধান রচনার পূর্বেই তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্ব শেষ করতে চান এবং ৬ই অক্টোবর তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এই সময় তিনি সংসদকে নিজের মত চালানোর জন্য উৎকোচ প্রদান করেন এবং সামরিক ভীতি প্রদর্শনের আশ্রয় নেন। চীনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করার জন্য তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক দর কষাকষি করে সফল হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখন থেকে তিনি পার্লামেন্টকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে পূর্ণ স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে তৎপর হন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তিনি পার্লামেন্ট এবং প্রাদেশিক সভাগুলিকে বাতিল করেন। ফেব্রুয়ারী মাসে মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করলে ৫৪ বছর বয়সী ইউয়ান পূর্ণ স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে সক্ষম হন।

স্বদেশপ্রেমী সাংসদরা ইউয়ান শিকাই-এর সংসদীয় গণতন্ত্রের আবরণ ছিন্ন করার প্রয়াসকে বাধা দান করলেও তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য ছিল। সংবিধান বা সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে সাধারণ মানুষের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। বিদেশী শক্তিবর্গ এবং শহরের বণিক শ্রেণীও ইউয়ানের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আপত্তি করেনি অন্য দিকে আমলাগোষ্ঠী, সেনাবাহিনী এবং অধিকাংশ প্রাদেশিক সামরিক গভর্নরগণ সর্বোচ্চ স্তরে স্থায়িত্বের প্রয়োজনে ইউয়ানকে সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছিলেন। জাপানি রাজনীতিতে দায়িত্বের যে প্রসারণ লক্ষ্য করা যায় চীনে তার বিপরীত দিকটি লক্ষ্য করা যায়।

চীনা রাজনীতিতে একজন ব্যক্তির হাতেই সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ লক্ষ্য করা যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারণা শুধুমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাংসদ ও ভাবী সাংসদদের মধ্যে সীমায়িত ছিল। এই আদর্শ তৃণমূল স্তরে পৌঁছায়নি। “দ্বিতীয় বিপ্লব”কে ইউয়ান অতি সহজেই দমন করতে পেরেছিলেন, কারণ সানের আদর্শ সর্বস্তরে জনপ্রিয় ছিল না। এই বিপ্লব চলাকালীন কৃষকরা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। কেননা সান-ইয়াৎ-সেন কৃষি সমস্যা ও কৃষি সংস্কারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেননি।

নিজেকে যাবজ্জীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি থাকার ব্যবস্থা করে নিয়ে ইউয়ান তাঁর উত্তরসূরী মনোনয়নের অধিকার অর্জন করেন। এই সময় তিনি ‘সম্রাট’ উপাধি ছাড়া কার্যত সব ক্ষমতা ও মর্যাদা লাভ করেন। ইউয়ানের জ্যেষ্ঠপুত্র ইউয়ান-কো-টিং (Yuan Ko Ting) যুবরাজ হবার বাসনায় এবং চীনের ভবিষ্যৎ সার্বভৌম শাসকরূপে পিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে তোলেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ইউয়ান শিকাই চীনা প্রজাতন্ত্রের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়নের মত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হন। তিনি সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেন, স্থানীয় জেন্ট্রিদের দ্বারা স্বায়ত্বশাসনকে উৎসাহিত করেন এবং বিবেচনা পর্ষদ (censorate) ও চীনের কনফুসীয় ধর্মবিশ্বাসকে পূর্ণপ্রতিষ্ঠা দান করেন। সেনাবেষ্টিত গাড়ি থেকে অবতরণ করে একজন ধর্মপ্রাণ চীনার মত স্বর্গের মন্দিরে (Temple of Heaven) প্রাচীন রাজকীয় রীতি পালন করেন। 

১৯১৫-এর শেষ নাগাদ ইউয়ান শুধু সম্রাট নাম ছাড়া বাকী সব কিছুই সম্রাটের ক্ষমতা ভোগ করেন। বৈদেশিক বহির্মঙ্গোলিয়ায় যথাক্রমে ব্রিটেন ও রাশিয়ার স্বার্থরক্ষায় বাধা দেননি। ইউয়ানের শক্তিবৃদ্ধি শক্তিবর্গ যাতে ইউয়ানের শক্তিবৃদ্ধির অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য তিনি তিব্বত ও তথা রাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য শুধু স্বৈরতন্ত্রের বিকল্প রূপে অপরিণত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দায়ী ছিল না, চীনাদের বিদেশী আগ্রাসন রোধের উদ্দেশ্যে শক্তিশালী সরকার গঠনের প্রবল ইচ্ছাও অনেকাংশে দায়ী ছিল। যাইহোক ইউয়ান তাঁর নিজস্ব উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য জাপানের কুখ্যাত “একুশ দফা দাবী” ও মেনে নেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর তিনি রাজসিংহাসন গ্রহণে সম্মত হন এবং এর নাম দেন মহান শাসনতান্ত্রিক যুগ (Great Constitutional Era) ।

ইউয়ান কর্তৃক রাজতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় আপামর চীনা জনগণের কোন সমর্থন ছিল না। এক কথায় তাঁর রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল বলপ্রয়োগ, উৎকোচ প্রদান এবং তৈরী করা জনমতের মিলিত পরিণতি। তিনি চীনা জনগণের মনের ভাষা পড়ার কোন চেষ্টাই করেন। নি। ফলে এই নব্যরাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে গণবিক্ষোভ দানা বাঁধতে সময় লাগেনি। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা বশতঃ তিনি ভুলে গিয়েছিলেন কোথায় থামতে হবে। তিনি বুঝতে চাননি যে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের যতই অপূর্ণতা ও অনিশ্চয়তা থাকুক না কেন চীনাবাসীরা পুনরায় রাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবেন না। তাই প্রজাতন্ত্রের প্রতি তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা এবং সম্রাটপদ প্রাপ্তির জন্য তাঁর নির্লজ্জ প্রয়াস জনগণের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছিল। এই গণ অসন্তোষের সুযোগে সান ইয়াৎ সেন তাঁর জাতীয়তাবাদী দলকে সুসংগঠিত করেন এবং ইউয়ানের অবৈধভাবে পার্লামেন্ট ও অস্থায়ী সংবিধান ভেঙ্গে দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান।

ইউনান প্রদেশে গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। ইউনানের জাতীয় সুরক্ষা বাহিনী (National Protection Army) ইউয়ানের কাছে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য চরমপত্র পেশ করে (২৩শে ডিসেম্বর, ১৯১৫) সাড়া না পেলে ২৫শে ডিসেম্বর ইউনান স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

মূল্যায়নঃ

২৭শে ডিসেম্বর কিয়েও চাও (Kwei chow) এবং ১৫ই মার্চ (১৯১৬) কোয়াং সি (Kwangsi) স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সানটুং প্রদেশেও রাজতন্ত্র বিরোধী অভ্যুত্থান দেখা দেয়। বিদ্রোহ বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়লে এবং আপানও ইউয়ানকে চীনের প্রতিনিধিত্বকারীরূপে অস্বীকৃতি জানালে ইউয়ানের চীনের রাজসিংহাসনে বসার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। দুর্দিনে তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁকে পরিত্যাগ করলে উদ্বেগ, লজ্জা এবং দুঃখে ইউয়ান-শি-কাই মৃত্যুমুখে পতিত হন (১৬ই জুন, ১৯১৬ সাল)। এইভাবে ইউয়ানের মৃত্যুর সাথে সাথে চীনে প্রকৃত প্রজাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিক্রিয়ার যুগের অবসান ঘটে। তবে চীনে প্রজাতান্ত্রিক সরকার টিকে থাকলেও সরকারের আদর্শরূপে প্রজাতন্ত্রবাদ তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *