StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো

গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকাঃ

যে-কোনো দেশ বা যুগের সভ্যতা সংক্রান্ত আলোচনায় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। গুপ্তযুগের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক আছে। এখানে অর্থনীতির অন্যতম উৎস কৃষি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা।

গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা আকর উপাদান হল এ-যুগের বেশ কিছু শিলালেখ, বিশেষ করে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রাপ্ত গুপ্ত শাসকদের শিলালেখ। এই শিলালেখগুলি প্রায় সবই তাম্রশাসন। বস্তুত, জমিসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় বাংলায় প্রাপ্ত তাম্রশাসনগুলি থেকে। এগুলি হল প্রথম কুমারগুপ্তের ৪৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দের ধনাইদহ তাম্রশাসন এবং প্রথম কুমারগুপ্তের দামোদরপুরে প্রাপ্ত দু’খানি তাম্রশাসন। এগুলির তারিখ যথাক্রমে ৪৪৪ খ্রিস্টাব্দ ও ৪৪৮ খ্রিস্টাব্দ।

গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থা

গুপ্ত যুগে জমির ওপর রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব যে ছিল তার প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কাত্যায়ন স্মৃতিতে। এই গ্রন্থে (শ্লোক নং ১৬ ও ১৭) উল্লেখ করা হয়েছে যে রাজা ভূস্বামী এবং উৎপন্ন ফসলের ১/৪ অংশের তিনি অধিকারী। কাত্যায়ন অবশ্য স্বীকার করেছেন, যেহেতু মানুষ ভূমির ওপর বাস করে সেহেতু তারেও ভূমির মালিক বলা চলে। সুতরাং কাত্যায়ন ভূমির ওপর রাজার অধিকারকে স্বীকার করা সত্ত্বেও ব্যক্তির অধিকারকে অস্বীকার করেননি।

গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থা

মধ্যরাজ্যের বিবরণ দিতে গিয়ে ফা- হিয়েন এক জায়গায় লিখেছেন, ‘শুধু যারা রাজার জমি চাষ করে কেবল তারাই জমি থেকে যা লাভ হয় তার অতি সামান্য অংশ রাজকোষে জমা দেয়।’ এর কিছুটা পরবর্তীকালে সপ্তম শতকে চীন দেশ থেকে আগত পর্যটক হিউয়েন সাঙ ভার বিবরণে লিখেছেন যে ভূমি হল রাজার সম্পত্তি।

বস্তুতপক্ষে গুপ্তযুগে রাষ্ট্রীয় মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাও ছিল। জমির ব্যক্তি মালিকানা যে ছিল তার অত্যন্ত স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় কাত্যায়ণ স্মৃতিতে।

গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থায় জমি ইজারা দেওয়া এবং জমি ক্রয় বিক্রয়ের প্রমাণ মেলে সমকালীন স্মৃতিশাস্ত্রে, যা গুপ্তযুগে ব্যক্তি মালিকানার তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। বৃহস্পতি ইজারা সংক্রান্ত এই নির্দেশ দিয়েছেন যে একজন সাধারণ মানুষ কোনো জমি ইজারা নেবার পর তাতে বীজ বপন, তার তদারকি করা এবং উপযুক্ত ঋতুতে ফসল কাটতে পারবে, তবে যদি সে তা ঠিকমতো পালন করতে না পারে তাহলে জমির মালিককে ফসলের গড় মূল্য প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।

স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে জমি বিক্রয় সংক্রান্ত যে সমস্ত বিধিবিধান দেওয়া হয়েছে তা থেকেও জমির ব্যক্তিমালিকানার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, বৃহস্পতি ও কাত্যায়ন তাঁদের স্মৃতিগ্রন্থে জমি বিক্রয় সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধান দিয়েছেন। কাত্যায়ন বিধান দিয়েছেন যে-কোনো করযোগ্য জমির কর প্রদানের ব্যাপারে প্রয়োজন হলে জমি বিক্রয় করা যেতে পারে।

জমি ক্রয় করার আগে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত—এই নির্দেশও দিয়েছেন কাত্যায়ন। জমি বিক্রয় করার আনুষঙ্গিক বিভিন্ন শর্তের কথা বলতে গিয়ে বৃহস্পতি বলেছেন যে জমিতে অবস্থিত বৃক্ষ, জলাশয়, পাকা ফসল ইত্যাদির উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। এই সমস্ত তথ্যাদি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে গুপ্তযুগে ব্যক্তি মালিকানা ছিল। জমি ক্রয় বিক্রয় ছাড়াও গুপ্ত যুগে ভূমিদান ব্যবস্থা ছিল। ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করার রেওয়াজ ছিল। বৌদ্ধ সঙ্ঘকেও ভূমিদান করা হত। উল্লেখ্য, এইসব দান ছিল নিষ্কর। একে সাধারণভাবে বলা হয় ‘অগ্রহার’

রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত জমি ছিল অবশ্য দু’ধরনের। একটা ছিল অনুর্বর জমি, যা সাধারণত দান করা হত। আর এক ধরনের ছিল উর্বর, চাষযোগ্য জমি, যেগুলি সাধারণত দান করা হত না। গুপ্তযুগে বেতনের বিনিময়ে নগদ অর্থের পরিবর্তে অনেক সময় জমি দেওয়া হত। এক্ষেত্রে জমি গ্রহীতা কিন্তু জমির সম্পূর্ণ মালিক হতেন না। 

গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থায় জমির দলিল দস্তাবেজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে একটি পৃথক বিভাগ ছিল। ঐ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন ‘পুস্তপাল‘ নামে একজন কর্মচারী। প্রসঙ্গত বলা যায়, প্রতিটি গ্রামের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকত ঐ বিভাগে। জমি ক্রয় করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে জমি ক্রয় করার জন্য আবেদন করতে হত পুস্তপালের কাছে। এ ব্যাপারে তিনিই ছিলেন প্রধান। বলাবাহুল্য, জমি ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তাঁর অনুমোদন ছিল অপরিহার্য। তবে পুস্তপাল এ-বিষয়ে গ্রামিক, মহত্তর, অষ্টকুলাধিকরণ প্রমুখদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট জমিটির খুঁটিনাটি বিবরণ জেনে তবেই তা হস্তান্তরের নির্দেশ দিতেন। সাধারণত জমি ক্রয়ে ইচ্ছুক ব্যক্তির আবেদনপত্র গ্রাহ্য হত।

জমি যেহেতু হস্তান্তরযোগ্য ছিল সেহেতু জমির পরিমাপের বিষয়টিও তখন প্রচলিত ছিল। জমি মাপের একক হিসাবে সাধারণত চারটি শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় বিশেষত বাংলায় প্রাপ্ত তাম্রশাসনগুলি থেকে। এই এককগুলি হল যথাক্রমে—আঢ়বাপ, দ্রোণবাপ, কূল্যবাপ এবং পাটক। সর্বনিম্ন একক ছিল আঢ়বাপ এবং সর্বোচ্চ একক ছিল পাটক। প্রথম তিনটি এককের সঙ্গে ‘বাপ’ শব্দটির উল্লেখ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘বাপ’ শব্দটির সঙ্গে বীজ বপনের বিষয়টি জড়িত। সাধারণত চার আঢ়বাপে এক দ্রোণবাপ, আট দ্রোণবাপে এক কুল্যবাপ এবং পাঁচ কুল্যবাপে এক পাটককে বোঝাত।

তাম্রশাসনগুলিতে জমির দাম প্রসঙ্গে দীনার-এর উল্লেখ রয়েছে। তবে আঞ্চলিক গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে দামের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। গুপ্ত শাসনের অবলুপ্তির পরে পরেই বাংলায় ফরিদপুরে প্রাপ্ত ধর্মাদিত্যের দুটি তাম্রশাসন এবং গোপচন্দ্রের মল্লসারুল তাম্রশাসন থেকে জানা সম্ভব হয় যে সেই সময় ঐ এলাকায় (দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে) জমির দাম ছিল প্রতি কুল্যবাপ পিছু ৪ দীনার। সুতরাং দেখা যাচ্ছে স্থান, কাল এবং সর্বোপরি জমির উৎকর্যের ভিত্তিতে গুপ্তযুগে জমির দামের ওঠা-নামা হত।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *