গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী কীভাবে সাতবাহন সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী কীভাবে সাতবাহন সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

রাজবংশের হৃত (হারানো) গৌরবকে পুনরুদ্ধার করার ঘটনা সুদীর্ঘ ভারতবর্ষের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে মাঝে মাঝেই লক্ষ করা যায়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন বংশের ক্ষেত্রেও এই ধরনের ঘটনার নজীর চোখে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে সিমুক-এর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং পরে প্রথম সাতকর্ণির দ্বারা বিস্তৃত ও সুসংগঠিত সাতবাহন সাম্রাজ্যের একটা বড় অংশ যে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কোনো একসময় পশ্চিমী শকদের অধীনে চলে গিয়েছিল।

সাতবাহনদের এই লুপ্ত গৌরব দীর্ঘকাল একই অবস্থায় থাকেনি। যে ক্ষহরাত বংশীয় শক শাসক নহপান সাতবাহনদের গৌরবকে ম্লান করেছিলেন, সেই শক শাসকের আমলেই আবার সাতবাহনরা তা পুনরুদ্ধার করে নেন। সাতবাহন বংশের এই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের সঙ্গে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গৌতমীপুত্রকেই এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসকের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে।

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির সঙ্গে নহপানের যে সংঘাত ঘটেছিল বস্তুত, এই সংঘাত প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কেবল প্রতিহিংসাপরায়ণ দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংঘাতকে বিচার করা ঠিক হবে না মালব ও পশ্চিম ভারতের বাণিজ্যিক তথা, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের বিষয়টিও গৌতমীপুত্রকে এই সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে প্রেরণার সঞ্চার করেছিল।

সাতবাহনরা যে এক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন তার অন্যতম প্রধান নজির হল ওপরে উল্লেখিত শিলালেখগুলিতে উদ্ধৃত বিভিন্ন বক্তব্য। প্রথমেই তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসরে রচিত নাসিক লেখটির প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। এই লেখটিতে বলা হয়েছে যে শক শাসক নহপানের জামাতা ঊষবদাত (ঋষভদত্ত)-র অধীনে যে সমস্ত জমি একসময় ছিল তা তিনি অন্যদের দান করেছিলেন। উল্লেখ্য, ঊষবদাত ছিলেন নাসিক ও পুনা জেলায় নহপানের রাষ্ট্রের দক্ষিণাংশের শাসনকর্তা। ঐ লেখটি থেকে আরো বোঝা যায় যে গোবর্ধন (নাসিক) জেলার বেনাকটক নামে একটি জায়গায় সাতবাহন শাসক বিজয়ী হবার পর উপস্থিত থেকে ঐ দানপত্রটি প্রচার করেছিলেন। 

বেনাকটক (দীনেশচন্দ্ৰ সরকারের মতানুযায়ী সম্ভবত বেনট নামে একটি নদীর তীরে অবস্থিত)-এ এই বিজয়ী সমাবেশটি যে তাঁর সামরিক ছাউনি ছিল তাও বর্ণিত হয়েছে। এই লেখতে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে গোবর্ধন এলাকায় গৌতমীপুত্রের ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিতি এবং ঐ দানপত্রটি প্রচার নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে ক্ষহরাতদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। এই তথ্যটি শকদের অধীনতা থেকে কেবল উত্তর দাক্ষিণাত্যের মুক্তিকে সূচিত করে না, পশ্চিম ভারতের কিছু অংশেও সাতবাহনদের অধিকারের তা ইঙ্গিত দেয় বলে দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন।

উত্তর মহারাষ্ট্র শকদের কাছ থেকে গৌতমীপুত্রের নেতৃত্বে সাতবাহনদের কাছে যে হস্তান্তরিত হয়েছিল তার আরো একটি প্রমাণ পাওয়া যায় কার্লে লেখতে উদ্ধৃত একটি বক্তব্য থেকে। এর এক জায়গায় বলা হয়েছে যে মামাল আহারের অন্তর্ভুক্ত করজিক গ্রাম (বর্তমান পুনা জেলা)-টি একসময় দান করেছিলেন ঐ অঞ্চলের শাসক ঊষবদাত, আবার ঐ গ্রামটিই পরে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি কর্তৃক দান করা হয়েছিল। এক বংশের শাসকের থেকে আর এক বংশের শাসকের কাছে জমির এই হাত বদলের বিষয়টি নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক আধিপত্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। 

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সাতবাহন বংশের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সাফল্য অনুধাবন করতে প্রাপ্ত শক শাসক নহপানের প্রচুর পরিমাণ মুদ্রা এবং সেগুলির সঙ্গে গৌতমীপুত্রের সংযোগের কথা প্রসঙ্গত বলা যায় যে নাসিকের নিকটবর্তী জোগালথেম্বিতে নহপানের তের হাজার দুশো সত্তরটি মুদ্রা পাওয়া গেছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, ঐ মুদ্রাগুলির মধ্যে ই নয় হাজার সাতশো কুড়িটি গৌতমীপুত্র কর্তৃক পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছিল।

মূল্যায়নঃ

নহপানের মুদ্রা ভাণ্ডারের এক বিরাট অংশ গৌতমীপুত্র কর্তৃক অনুকরণীয় হওয়ায় প্রমাণিত হয় যে তিনি ক্ষহরাত রাজকোষ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। এইভাবে বিভিন্ন তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে গৌতমীপুত্র শকদের ক্ষহরাত বংশের কাছ থেকে সাতবাহন বংশের হারানো অঞ্চলগুলি উদ্ধার করেছিলেন এবং গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সাতবাহন সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সাফল্য অর্জন করেছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *