StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

মেহেরগড় সংস্কৃতি বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ

মেহেরগড় সংস্কৃতি বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ ?

ভূমিকাঃ

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হল এই মেহেরগড়। । পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত বালুচিস্তানের কাচ্চি সমতলভূমিতে ইতিহাস প্রসিদ্ধ বোলান গিরিপথের কিছুটা দূরে দুশো হেক্টর অর্থাৎ প্রায় পাঁচশ একর ব্যাপ্ত মেহেরগড় (কাচ্চি জেলার কোয়েটার নিকট) । দুটি পর্যায়ে মেহেরগড়ে খননকার্য চলেছিল – (১) ১৯৭৪- ৮৬ খ্রিস্টাব্দ এবং (২) ১৯৯৭-২০০০ খ্রিস্টাব্দ। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজের নেতৃত্বে একটি পুরাতাত্ত্বিক দল মেহেরগড়ে খননকার্য চালিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের এক সুপ্রাচীন সভ্যতার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ এই কাজে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ।

মেহেরগড় সংস্কৃতিঃ

গ্রামের মানুষ রোদে শুকনো সমান মাপের কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরি করা বাড়িতে বাস করত। বাড়িগুলি বিভক্ত ছিল ছোট ছোট কক্ষ বা কামরায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাটির দেওয়ালও ছিল। আবার কখনো কখনো একটার পর একটা পাথর চাপিয়েও দেওয়াল তৈরি হত।

মেহেরগড় সভ্যতা

গম ও যবের ফলন হত পর্যাপ্ত পরিমাণে। মেহেরগড়ে খাদ্যোৎপাদনের প্রাচুর্য ঘটেছিল বলেই শস্য সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ইমারত তৈরি করতে হয়েছিল। 

মেহেরগড়ের দ্বিতীয় পর্যায় (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০-৪০০০ অব্দ)-এ কার্পাস চাষ হত। এই পর্যায়ে বিপুল পরিমাণে তুলো বীজ পাওয়ায় চাষ সম্পর্কে কোনো সংশয় নেই। পণ্ডিতদের অনুমান কার্পাস বস্ত্রের উৎস সম্পর্কে এটি এখনও পর্যন্ত জানা আমাদের জ্ঞাত প্রাচীনতম নিদর্শন।

খ্রিস্টপূর্ব সেই সুদূর অষ্টম অথবা সপ্তম সহস্রাব্দের এমন কয়েকটি ইমারতের সন্ধান মিলেছে যেগুলির আয়তন সাধারণ বাসগৃহের তুলনায় বড়। অনুমান করা অসঙ্গত নয়, প্রাচীনকালেই উদ্বৃত্ত কৃষিজ পণ্যের সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট ইমারত তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।

কৃষিজ উৎপাদনের কারণেই সম্ভবত পশুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করে তোলার বিষয়টি ত্বরান্বিত হয় ।গৃহপালিত জন্তুর মধ্যে গোরু, ভেড়া ও ছাগলের পরিচয় পাওয়া যায়। হাড় থেকে এদের শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে। মেহেরগড়ের প্রথম পর্যায়েই এই চিত্র ধরা পড়ে।

নব্যপ্রস্তর যুগে বিচিত্র সব পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলি অদ্ভুত রকমের মসৃণ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হামানদিস্তা, গুঁড়ো করার পাথর ও জাঁতা, টুকরো টুকরো ফলক প্রভৃতি। নলখাগড়ায় তৈরি ঝুড়ি এবং তার সঙ্গে উল অথবা পশুলোমের তৈরি কাপড় অর্থাৎ বয়ন শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়। এরপর মেহেরগড়ের দ্বিতীয় পর্যায়ে শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু নতুনত্ব চোখে পড়ে। ব্যাপকভাবে মৃৎশিল্পের সূচনা ঘটল।

মেহেরগড় সংস্কৃতি  একেবারে শেষ দিকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ নাগাদ কুমোরের ঘুরন্ত চাকের প্রচলন ঘটে। এই ঘটনা নিশ্চিতভাবে তৎকালীন যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এই পর্যায়েই তথাকথিত ‘কারুশিল্পীর সমাধি’ আমাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেননা এই শিল্পী মানুষটির সমাধির সঙ্গে এমন কিছু জিনিস মাটিতে পোঁতা হয়েছিল, যেগুলির মাধ্যমে কারিগরি শিল্পের কিছু নতুন দিক আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এগুলি হল একটি নব্যপ্রস্তর যুগের পালিশ করা কুঠার, তিনটি চকমকি পাথরের ভেতরের অংশ, চকমকি পাথরেরই নটি জ্যামিতিক ছোট ছোট অংশ বা মাইক্রোলিথ এবং ষোলোটি ছোট ছোট ফলক।

কৃষির পাশাপাশি মানুষের কারিগরি শিল্প নৈপুণ্যের ধারা অব্যাহত থাকে। কুমোরের ভাটার নিদর্শন, চাকে বানানো কালো জ্যামিতিক নকশা বিশিষ্ট মৃৎপাত্রের বহুল প্রচলন এই পর্যায়ে দেখা যায়। এই বিষয়গুলি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে মৃৎপাত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে মেহেরগড়ের শিল্পীরা অভূতপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের তুলনায় গম ও যব চাষের আরো বিস্তৃতি ঘটে এই তৃতীয় পর্যায়ে। চতুর্থ পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে ঐ সহস্রাব্দের শেষ দিক)-এ কৃষি ও কারিগরি শিল্পের বিকাশের ধারা বহমান। কৃষির বিকাশ পরিলক্ষিত হয় বাড়ির আঙিনায় শস্য রাখার বৃহৎ মৃৎপাত্রের ব্যবহার থেকে। মৃৎপাত্রগুলি রঙিন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কালো জ্যামিতিক নকশা আঁকা। 

মধ্যপ্রস্তর যুগের ন্যায় এই যুগেও মৃত্যুর পর মানুষকে সমাধি দেওয়ার প্রথা ছিল অর্থাৎ মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে দেওয়া হত। তবে সমাধি দেওয়ার পদ্ধতিতে যথেষ্ট নতুনত্ব ছিল। মেহেরগড়ের প্রথম পর্যায় থেকেই সমাধিতে গেরুমাটির টুকরো পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাই অনুমান করেছেন যে, মৃত ব্যক্তিকে লাল রং মাখিয়ে সমাধি দেওয়া হত।

সমাধি পদ্ধতি এবং সমাধিগুলিতে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে বিভিন্ন অলংকার, হাতিয়ার, হত্যা করা পশু প্রভৃতির উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে লোকাতীত জীবনের প্রতি আল ও বিশ্বাস এবং সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের প্রতিচ্ছবিকে প্রতিফলিত করে। বস্তুতপক্ষে মৃতকে সমাধিস্থ করার আগে গেরুমাটি মাখানো, মাথাগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিকে শায়িত করা, মুতের সঙ্গে বিভিন্ন অলংকার ও সামগ্রী মাটিতে পুঁতে দেওয়ার মধ্যে লোকাতীত জীবনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস পরিস্ফুট হয়।

মেহেরগড় সংস্কৃতি নব্যপ্রস্তর যুগের হলেও এই পর্বে একটি তামার পুঁতি পাওয়া গেছে। তবে তখন তামা গলানো হত কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা। সম্ভব নয়। এর দ্বিতীয় পর্যায়ে তামার একটি আংটি ও ছোট ১৬ পুঁতি পাওয়া গেছে। সুতরাং তামার ব্যবহার ব্যাপক না হলেও তখন প্রায় নিয়মিতভাবেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তামার পুঁতি ও আংটির প্রাপ্তি থেকে অনুমান হয় যে, দ্বিতীয় পর্যায়ে তামা গলানোর কাজ শুরু হয়েছিল।

মেহেরগড় সংস্কৃতি  তৃতীয় পর্যায়ে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০-৩৫০০ অব্দ) তামা গলানোর বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় নিশ্চিতভাবে। উল্লেখ্য, এই পর্যায়ে পোড়ামাটির তামা গলানোর পাত্র ( মুচি) পাওয়া গেছে অন্ততপক্ষে চোদ্দোটি। এই মুচিগুলিতে তামার অবশেষও পাওয়া গেছে। এই পর্যায়েই তামার সীলমোহর বা নামমুদ্রার প্রচলন ঘটে। এর থেকে অনুমান করা সঙ্গত হবে যে সেই সময় বহির্বাণিজ্য চলত। বস্তুত, নিজেদের বাণিজ্য পণ্যকে যে তারা চিহ্নিত করেছিল। তামার সীলমোহরের প্রচলন সেই সাক্ষ্য বহন করে। শুধু বাণিজ্য নয়, নামমুদ্রা বা সীলমোহরের ব্যবহার থেকে অনুমান করা সম্ভব হয় যে মেহেরগড়ে ধীরে ধীরে হয়তো একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল।

মূল্যায়নঃ

এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে নব্যপ্রস্তর যুগে অন্ততপক্ষে এর শেষ দিকে মানুষ তাম্রধাতু ব্যবহার করতে শেখে। মেহেরগড় সভ্যতার তৃতীয় পর্যায়ে তাম্রাশ্মীয় যুগের আবির্ভাব ঘটে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের গোড়া পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। গ্রাম গড়ে ওঠার এই ইতিহাস কেবল মেহেরগড় গ্রামকেন্দ্রিক।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *