হরপ্পা সভ্যতার পতনকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে।
দীর্ঘ ছ’শো বছর উজ্জ্বল অস্তিত্বের পর আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ কিছুটা অকস্মাৎই হরপ্পা সভ্যতার পতন হয়েছিল তা প্রায় সর্বজনস্বীকৃত। হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে পুরাতত্ত্ববিদ, ভূতত্ত্ববিদ, আবহাওয়াতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন মতামত দিয়ে থাকেন। এঁদের সকলেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হরপ্পা সভ্যতার পতনকে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা নিজ নিজ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
হরপ্পা মত বিশালকায় সভ্যতা যা সিন্ধু উপত্যকার বাইরে ভারতের অন্যান্য বহু অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল তা হঠাৎ করে সমস্ত এলাকায় একই সঙ্গে অবলুপ্ত হয়ে যায়নি। বহুকাল ধরে ক্রমিক অবক্ষয় হতে হতে শেষপর্যন্ত তা একেবারে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া হরপ্পা, মহেপ্পোদারো, কালিবঙ্গান, লোখাল, চানদারো প্রভৃতি শহরের ধ্বংসের পিছনে একই প্রেক্ষাপট কাজ করেছিল মনে করলে ভুল হবে। দু’একটি শহর বা নগরের ধ্বংসের প্রকৃতি এক হলেও সর্বত্র তা সমান ছিল না।
দীর্ঘদিন ধরে হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে এক ক্রমিক অবক্ষয় চলে আসছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সহ অন্যান্য প্রত্নকেন্দ্রের সর্বোচ্চ স্তরে তার চিহ্ন বর্তমান। হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবন-যাত্রার সমস্ত স্তরে ভগ্নদশা অত্যন্ত সুপরিস্ফুট। মহেঞ্জোদারোয় এক সময় ঘরের আয়তন যা ছিল শেষের দিকে তা অনেক ক্ষুদ্রতর রূপ নেয়।
আধুনিক বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ এই ধারণা পোষণ করে থাকেন যে প্রথম থেকেই গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতি প্রসারিত না হওয়ায় অর্থনৈতিক জীবনে জড়ত্ব প্রকট রূপ নিয়েছিল। এই পশ্চাৎপদতার পিছনে সম্ভবত প্রধান কারণ ছিল লৌহ ও লৌহজাত উপকরণের সঙ্গে হরপ্পীয়দের সংযোগের অভাব। ফলে লৌহ-নির্মিত লাঙলের ব্যবহার বা লৌহজাত কুঠার বা অন্যান্য অস্ত্রাদির মাধ্যমে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বৃহত্তর এলাকায় ব্যাপক পরিমাণে কৃষি উৎপাদন ঘটানো সম্ভব হয়নি।
বৈদেশিক আক্রমণ অথবা প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় হরপ্পা সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত ও সম্পন্ন করেছিল। প্রথমে এই সভ্যতার ধ্বংসের পিছনে বহিঃশত্রুর আক্রমণের তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। গর্ডন চাইল্ড, মর্টিমার হুইলার সহ বহু খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ এই ধারণা পোষণ করে থাকেন যে, এখানে আক্রমণকারী শক্তি হল বৈদিক আর্যরা। অর্থাৎ বক্তব্যের সারমর্ম হল, বহিরাগত আর্যজাতির আক্রমণের দাপটে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল।
![]() |
হরপ্পা সভ্যতা |
হরপ্পা সভ্যতার পতনকে বিধ্বংসী বন্যা এক বড় ভূমিকা পালন করেছিল বলে মনে করেন বেশ কিছু পণ্ডিত। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন এম. আর. সাহানী, আর্নেস্ট ম্যাকে, এস. আর. রাও, রাইকস প্রমুখ। চানদারো ধ্বংসের পিছনে বন্যা প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল বলে মনে করেন ম্যাকে। সিন্ধুনদের উপত্যকায় গড়ে ওঠা দুটি নগরী যথা— হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসের ক্ষেত্রে বন্যাকে বিশেষ- ভাবে দায়ী করা হয়।
সিন্ধু সভ্যতার (হরপ্পা সভ্যতা) ধ্বংসের পিছনে আর একটি অন্যচিত্র এঁকেছেন গুরদীপ সিং। তিনি ঐ সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমশ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাসের সূত্র ধরে আবহাওয়া শুষ্কতর হয়ে ওঠার ওপর জোর দিয়েছেন। রাজস্থানের উত্তরাংশের কয়েকটি লবণাক্ত হ্রদ থেকে প্রাপ্ত পরাগরেণুর ওপর গবেষণা চালিয়ে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে আনুমানিক ২২৩০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পায়।
হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলিতে যে সমস্ত বড় বড় ইমারত, নগর দুর্গ, স্নানাগার, ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছিল সেগুলি সবই ছিল পোড়া ইটে তৈরি। বলাবাহুল্য, ইট পোড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে হরপ্পীয়রা অরণ্যাঞ্চলকে ধ্বংস করেছিল। এর ফলস্বরূপ বিভিন্ন শহর, বিশেষ করে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ধীরে ধীরে শুষ্ক ও মরু অঞ্চলে পরিণত হয়।
আবহাওয়াতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব ও প্রাণীতত্ত্ববিদরা গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন যে, ঐ একই এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং এর ফলে মহেঞ্জোদারো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
মূল্যায়নঃ
হরপ্পা সভ্যতার পতনের পিছনে যে কোনো বিষয়কেই দায়ী করা হোক না কেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় এর পতনের গতিকে ত্বরান্বিত করেছিল।