অগ্রহার ব্যবস্থা কি। এই প্রথা ভূমিদান ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন এনেছিল।
অগ্রহার ব্যবস্থা কি
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে পঞ্চম মধ্যভাগ পর্যন্ত সাড়ে 300 বছর ( 300-650 খ্রিষ্টাব্দ ) এক অসামান্য সৃজনশীল যুগ হিসেবে চিহ্নিত। এই সময়ে অর্থনীতির জীবনে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল অগ্রহার ব্যবস্থা। অগ্রহার ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হল ধর্মস্থান বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে নিষ্কর ভূমিদান। প্রথমে এই অগ্রহার দানের রীতি ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও মন্দির, মঠ, বিহার ইত্যাদি ধর্ম প্রতিষ্ঠানে এবং পরে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এটি অগ্রহার ব্যবস্থা নামে পরিচিত ছিল।
অগ্রহার প্রথা ভূমিদান ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন এনেছিল।
ভূমিকাঃ
এই অগ্রহার ব্যবস্থার বিক্ষিপ্ত সূচনা সাতবাহন আমলে 300 খ্রিস্টাব্দের পর এর ব্যাপকতা বাড়ে চতুর্থ পঞ্চম থেকে অগ্রহার প্রথা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এবং বহুল প্রচলিত এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়। ভূমি হস্তান্তরের ঘটনা সাধারণত তাম্র ফলকে রাজকীয় শাসন হিসেবে উৎকীর্ণ হয়েছে। এছাড়া মুদ্রা ও উৎখনন থেকে প্রাপ্ত পুরা বস্তু সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বাংলায় প্রাপ্ত গুপ্ত যুগেও দামোদরপুর, পাহাড়পুর, বই গ্রাম বা জগদীশপুর তাম্র শাসন বাকাটক রাজ্য প্রবর সেনের চমক তাম্র অনুশাসন থেকে অগ্রহার ব্যবস্থার কথা জানা যায়।
ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা, ডি এন ঝাঁ, অধ্যাপক বি এম দাস যাদবের মতে গুপ্ত শাসক বর্গ কর্তৃক শাসন জারি মধ্য দিয়ে এই ধরনের নিষ্কর জমিদানের মাধ্যমে ভারতের সামন্ততন্ত্রের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল।
অগ্রহার প্রথা ভূমিদান ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন এনেছিল।
অগ্রহার বা নিষ্কর জমি চিরস্থায়ী ভিত্তিতে দেওয়া হতো। ব্রাহ্মণ, মন্দির, বৌধবিহার গুলিও প্রচুর ভুল সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে। কখনো কখনো গ্রাম দান করা হলেও গ্রামের সবকিছু মালিকানা দানগ্রহীতা পেত না। গ্রাম থেকে তিনি প্রাপ্ত রাজস্ব ভোগের অধিকারী হন। অধ্যাপক রামশরণ শর্মা দেখেছেন যে “ Fiefs are usually granted as long as the sun and the moon, the earth and the ocean exist.this implies the breakup of the state and creation of smaller Nuclear power”. চিরস্থায়ী ভিত্তিতে জমি বা গ্রামের অধিকার লাভ করায় দানগ্রহীতা কার্যত ভূস্বামী তে পরিণত হয়।
![]() |
অগ্রহার ব্যবস্থা |
লেখোমালাই গ্রাম বা ভূমি দানের সময় ‘অচাটভাট প্রবেশ্য’ বা ‘চাটভাট অপ্রবেশ্য’ শব্দের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ চাটভাট রাজকীয় বাহিনী যারা আইনশৃঙ্খলার রক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের রাজা কে সাহায্য করত তাদের হস্তান্তরিত এলাকায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। শর্মার মতে দানগ্রহীতা শুধু রাজস্বের অধিকারী হতেন না, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিচার কার্যং পরিচালনা করতেন। তার বিচার এটি ছিল রাষ্ট্র কর্তৃক প্রায় স্বেচ্ছায় দানগ্রহীতার সমর্থনে এই ধরনের প্রশাসনিক অধিকার ন্যস্ত করা। ফলে তা দান গ্রহীতার বিশেষ অধিকার ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সূচিত করে।
দানগ্রহী তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমি চাষ করবার জন্য কৃষক নিয়োগ করতেন। অগ্রহার প্রথা ভূমিদান ব্যবস্থায় অবশ্যই পরিবর্তন এনেছিল। রাজা ও কৃষকের মধ্যবর্তী স্থলে মধ্যস্থ ভোগীর আবির্ভাব ঘটে। আদি মধ্যযুগীয় ভারতে জমির উপর অধিকার স্থাপনকারী এই মধ্যস্থত ভোগীদের উপস্থিতির কথা সমসাময়িক স্মৃতিকারদের রচনা থেকেও জানা যায়। নারদ, বৃহস্পতি প্রমুখ স্মৃতিকাররা নিষ্কর ভূমি ব্যবস্থার কথা বলেছেন –
- মহি পতি বই রাজা
- স্বামী বা জমির মালিক এবং
- কর্ষক বা চাষী।
তাম্র শাসনের দাদা অগ্রহার সৃষ্টির প্রধান ফল ভূমি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এক ক্ষমতা বান ভূম্যধিকারী অন্তবর্তী শ্রেণীর উদ্ভব।
অগ্রহার ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মানুষ। দানগ্রহী তারা কৃষকদের কাছ থেকে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায় করত না তার সাথে অনেক রকম অনিয়মিত উপকরণও আদায় করত যেমন প্রথাগত দশটি অপরাধের জন্য জরিমানা বিস্তৃতি বা বেগার শ্রম আদায়। অধ্যাপক শর্মার ধারণা ভূম্যধিকারী অন্তবর্তী শ্রেণীর উত্থান প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা ও অধিকার কে সংকুচিত করে দেয়। শর্মার এই অভিমত অবশ্য সর্বজনগ্ৰাহ্য নয়। কারণ বাঁকা টক রাজ প্রবরসেনের চম্মক তাম্র শাসনে বলা হয়েছে যে রাজদ্রোহের প্রমাণ পাওয়া গেলে রাজা ব্রাহ্মণদের প্রদত্ত জমি কেড়ে নিতে পারেন। এই তথ্য একদিকে যেমন রাজকীয় সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার চেষ্টা তেমনি অন্যদিকে দানগ্রহীতা দের রাজ্য দ্রোহ ঘটবার মতো ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার ইঙ্গিতবাহী।
রামচরণ শর্মা ও তার অনুসরণে রমেন্দ্রনাথ নন্দী ও কৃষ্ণমোহন শ্রীমালী মনে করেন যে অগ্রহার ব্যবস্থা নিয়মিত হবার দরুন রাজা বহু পরিমান কৃষিজ রাজস্ব হারাতেন। তাদের মতে এর ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও রাজ কোষের উপর চাপ পড়েছিল। শর্মা হর্ষচরিতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখেছেন যে হর্ষবর্ধনের সামগ্রিক ব্যয়ভারের এক চতুরাংশ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক তার খাতে যেত। এভাবে যেসব আর্থিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেন তার বিষম আর্থিক প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী।
সাম্প্রতিককালে গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেয়, পতিত,অনুর্বর, অনুৎপাদক জমি হস্তান্তরিত হয়েছিল। তাই অগ্রহার ব্যবস্থার সম্প্রসারণে ফলে কৃষির সম্প্রসারণ ঘটেছিল। এমনকি শর্মা ও মনে করেন যে এর মাধ্যমে শুধু সামন্ত ব্যবস্থার উদ্ভব হয়নি। কৃষির সম্প্রসারণ ঘটেছিল। কৃষিজ উৎপাদন ও জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য রাজার আয় বেড়েছিল মেনে নেওয়া যায়। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দায় স্বরূপ অনাবাদি পতিত জমি বিক্রি করে প্রশাসন নগদ অর্থ পেত। অগ্রহার ব্যবস্থা সমকালীন ভূমি বিন্যাস ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনলেও নতুন পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক সমস্যার চাইতে কৃষি অর্থনীতি প্রসারে সম্ভাবনা বোধ হয় বেশি দেখা দেয়।
অগ্রহার ব্যবস্থায় কৃষি অর্থনীতিতে বিভিন্ন স্তরের উদ্ভব ঘটে। মালিকানাহীন কৃষি, কৃষি শ্রমিকের অস্তিত্ব দেখা যায় ভূস্বামীদের জমির সীমা নির্দিষ্ট হলেও তারা পার্শ্ববর্তী চরণ ভূমিতে চাষ বসিয়ে আয় বাড়াতে পারতেন শর্মা মনে করেন অগ্রহার ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে রাষ্ট্রের ও যৌথ মালিকানার আবিষ্কার ক্রমশ সংকুচিত হয়েছিল। নোবুরু কারা সীমা, চোল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন যে, উর অঞ্চলে গ্রাম সভার গ্রামের যৌথ মালিকানা থাকলেও চোল বংশের শেষ দিকের লেখতে ব্যক্তিগত মালিকানার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামসভার উপস্থিতি চোখে পড়ে না। কৃষকদের সকলে মালিকানাহীন ছিল না। কিন্তু আদি মধ্যযুগে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। কৃষকদের প্রতিশব্দ হিসেবে হালার, “বদ্ধহল” ব্যবহৃত হবার বলা যায়। কৃষক শুধু জমি চাষ করতো। জমি মালিকা না সম্ভবত তার ছিল না। বি.এন.এস যাদব কৃষককের “আশ্রিত হালিক” হিসেবে দেখিয়েছেন। অত্যাচারের যাত্রা ছড়ালে কৃষক সম্ভবত ভূস্বামী বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত। পাল আমলে কৈবত বিদ্রোহকেও কৃষক অভুত্থান হিসেবেই দেখা হয়েছে।
শর্মা কতৃক রাজ শক্তির ক্ষমতা হ্রাস ও সামন্তদের ক্ষমতা বৃদ্ধির তত্ত্ব ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার মানতে চাননি। তিনি আদি মধ্যযুগীয় তাম্র শাসন বিশ্লেষণ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, দানগ্রহীতা রাজা, রাজকোষ থেকে টাকা দান করতেন। কর শাসন রাজকীয় আদেশ নামার দ্বারা অগ্রহার এলাকা থেকেও কর আদায় করা হত। কিন্তু তার লেখায় ফিফ, ফিউডেষ্টরি প্রভৃতি সামন্ততান্ত্রিক কবিতা ব্যবহার স্ববিরোধে পূর্ণ তবে দানগ্রহী তাদের শক্তিশালী হয়ে ওঠার নিয়ে কোন সংশয় নেই। ডি আর ভান্ডার কর গুপ্ত লেখমালায় উল্লিখিত দন্ড নায়কদের শক্তিশালী সামন্ত বা অভিজাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যারা প্রচুর সেনা রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য ভূমিকা পালন করতো। দক্ষিণে চল অঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্রহ্মদেয় গ্রামের সংখ্যা বাড়ছিল।
মূল্যায়নঃ
অগ্রহার দানের ফলে আদি মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। গাঙ্গেয় উপত্যকায় বৈশ্য কৃষকদের অবস্থার হীনতর হয়েছিল। উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শ্রেণীর রূপে রাজপুত্রের আগমন ঘটে। পরিবর্তন বর্ণ ব্যবস্থাকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার নিরিখে সাজানো হয়ে থাকে। শূদ্রদের উপবিভাগের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। লেখক হিসেবে কায়স্থ শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। তারা ব্রাহ্মণদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায় একই সঙ্গে আঞ্চলিক সংস্কৃতির মৃদু বিকাশ ঘটেছিল। এবং অগ্রহার প্রথা ভূমিদান ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন এনেছিল।