ভূমিকা
আলাউদ্দিনের অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার বাজারদর বা পণ্য নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা। আলাউদ্দিন খলজি বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করেন। দিল্লির সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন খলজি বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য পরিচিত ছিলেন। প্রজা হিতেষনা নয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সুলতান আলাউদ্দিন খলজি যে, সমস্ত বিধান জারি করেছিলেন সেগুলির পিছনে ছিল সামরিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ইতিপূর্বে দেবগিরি লুণ্ঠন লব্ধ প্রচুর ধনরত্ন সুলতান তার অনুগামীদের মধ্যে বিতরণ করায় মুদ্রাস্ফীত অবধারিত হয়ে ওঠে।
সুলতানি অর্থনৈতিক কাঠামো ও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। গুরুভার কার প্রজাদের সাহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে গিয়েছিল এবং নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির সূচক ছিল উর্ধ্বমুখী। কর্মচারীদের সামান্য বেতন বৃদ্ধির দ্বারা এই সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল না।
দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা)
1303 সালের ভয়ংকর মঙ্গল আক্রমণের পর আলাউদ্দিনের পক্ষে এক বিশাল ও স্থায়ী সেনাবাহিনী মোতায়েন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিল। অথচ এই বিপুল সেনাবাহিনীর ব্যায়ভার বহনের ক্ষমতা রাজ কোষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
প্রখর সাধারণ বুদ্ধি সম্পন্ন সুলতান এই সংকট মোচনের জন্য যে সমস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাদের যতদূর সম্ভব কম বেতন দিয়ে তাদের জীবন যাত্রার ব্যায়ভার হ্রাস করা। এজন্য নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও পণ্যে ক্রয় বিক্রয়ের জন্য সরকারি তত্ত্বাবধানে বাজার বসানোর যে ব্যবস্থা হয় সেগুলি ছিল একে অন্যের পরিপূরক। সফলভাবে আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন।
![]() |
আলাউদ্দিন খলজির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বিধি |
অধ্যাপক ইরফান হাবিব জানিয়েছেন যে বরানী শুধুমাত্র আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ পরিমাপের শুধু গুরুত্বপূর্ণ মূল্য তালিকা দেননি, উপরন্তু দ্রব্য ও মৌলের পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়ের উল্লেখ ও করেছেন। চিতোর অভিযান শেষ করে দিল্লিতে ফিরে আসার পর আলাউদ্দিন খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে অশ্ব, গবাদি পশু, ক্রীতদাস, দামি আমদানি বস্ত্র সবকিছু দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য বিভিন্ন আদেশ জারি করেন। তবে এই ব্যবস্থা সাম্রাজ্যের কোন কোন অঞ্চলে প্রবর্তিত হয়েছিল তা বলা কঠিন।
বরানির তথ্য অনুযায়ী অনুমিত হয় যে কেবলমাত্র দিল্লিতেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বিধি প্রযুক্ত হয়েছিল। সম্ভবত সন্নিহিত এলাকার বড় বড় শহরগুলিও এর আওতায় আসে। ইরফান হাবিবের বিশ্বাস যে, যেসব অঞ্চলে আলাউদ্দিনের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। অর্থাৎ লাহোর থেকে দিল্লি পরিপার্শ্ব নিয়ে গড়ে ওঠা, যমুনা অতিক্রান্ত অঞ্চল এবং ছাঁ’য় এলাকায় এবং পূর্ব কটিয়ার পর্যন্ত ভূখণ্ডকে এই ব্যবস্থার পরিধির মধ্যে আনা হয়।
নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য কেনা বেচার জন্য আলাউদ্দিন দিল্লিতে বিভিন্ন ধরনের বাজার বসেছিলেন। যেমন-
- মান্ডি ( প্রধান শস্য বাজার),
- সর -ই-আদল ( চিনি, বস্ত্র,ওষধি, শুকনো ফল, মাখন, তেল, ঘি, প্রভৃতির বাজার),
- ক্রীতদাস, অশ্ব ও গবাদিপশুর বাজার এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের জন্য সাধারণ বাজার।
মান্ডি ( প্রধান শস্য বাজার)
মান্ডিতে নানা ধরনের খাদ্যশস্য বিক্রি হতো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সুলতান যেসব নিয়মকানুন বা জাওবিৎ জারি করেছিলাম তা বিশেষ কঠোরতার সঙ্গে মানা হতো। অবশ্য কি হিসেবে বা কিসের মানদণ্ডে খাদ্যশস্যের দাম নির্ধারিত হয়েছিল তা বলা কঠিন। বরানি ও নাসির উদ্দিন এর অনুযায়ী সরকার নির্দিষ্ট বেধে দেওয়া দাম ছিল মন প্রতি গম 7½ জিতাল, বার্লি 4 জিতাল, চাল 5 জিতাল, ভাল 5 জিতাল, ছোলা 5 জিতাল ইত্যাদি। যতদিন আলাউদ্দিন বেঁচে ছিলেন এই দামের কোন বৃদ্ধি হয়নি। এটা ছিল তৎকালীন যুগের এক বিস্ময়। কম দামে দ্রব্য কিনে সরকারি দামের বেশি মূল্যে বিক্রিয় নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। অসৎ উপায় অবলম্বন ছিল কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
![]() |
মান্ডি |
সুলতানের অপর এক নির্দেশ অনুযায়ী সরকারের প্রশাসনিক আমলা ও রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে কৃষকরা যাতে তাদের শস্য মাঠ থেকে সরাসরি শস্য চালানকারী বণিকদের হাতে নগদ টাকায় বিক্রি করে সে বিষয়ে নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে চাষীদের শস্য লুকিয়ে রাখা বা পরে বেশি দামে বিক্রি করার পথ বন্ধ হয়ে যায়। দোয়াব অঞ্চলে কৃষকদের থেকে জোড়পূর্বক খাজনা আদায় করে শস্য ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে তাদের শস্য বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। আইন করে বলা হয় যে কেউ কম দামে দ্রব্য কিনে সরকারি দামের উপরে বিক্রি করতে পারবেনা।
সর-ই-আদল
সর-ই-আদল স্থাপিত হয়েছিল দিল্লির বদাউন তোরনের কাছে। এই বাজারে বিক্রিত পণ্যের মধ্যে ছিল পোশাক পরিচ্ছদ, চিনি, শুকনো ফল, ঘি, মাখন, প্রদীপের তেল, ও নানা ধরনের গাছের শিকড়। বণিকদের বা সরকারি ব্যয়ের আমদানিকৃত সমস্ত দ্রব্যই সর-ই-আদল নিয়ে আসা হত। এবং সমস্ত আমদানিকৃত পন্যের বিক্রয় ছিল বাধ্যতামূলক। অন্যথায় শাস্তি ও পণ্য বাজেয়াপ্ত হতো। রেশমি বস্ত্রের দাম ছিল 3-163 তঙ্কা, তাঁতের কাপড় (সাধারণ বিছানার চাদরের মাঠে) দাম ছিল 6-36 জিতাল, একসের মিছারের দাম ছিল 2½ জিতাল, দেরসের ঘির দাম 1 জিতাল ও ও একই দামে পাঁচ সের নুন পাওয়া যেত। মহার্ঘ্য পোশাক ও বস্ত্রাদী ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতি গ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক।
![]() |
সর-ই-আদল |
দেশি বিদেশি সমস্ত ব্যবসায়ীকে “ দেওয়ান-ই-রিয়াসৎ” (কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দপ্তর) এ নাম নথিভুক্ত করতে হত। দেওয়ানের তত্ত্বাবধানে এই ব্যবসা বাণিজ্য এই ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হত। অসাধুতার শাস্তি ছিল অতি কঠোর। বহুদূর থেকে যেসব দামি পণ্য আসতো সেগুলি সরকারি অনুদান পেত। মূল্য নির্ধারিত হতো ক্রেতার আয় ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। বণিকরা ক্রেতাদের সরাসরি বিক্রি করলে বেশি দাম পেত। সুলতান মুলতানী বনিকদের বড় গোষ্ঠীকে সর-ই-আদল আমলা হিসেবে নিয়োগ করে ঋণ হিসেবে বাৎসরিক 20 লক্ষ্য তঙ্কা দেন। বলা বাহুল্য সুলতানি বণিক রায় মহার্ঘ পোশাক আমদানি করত। অন্যান্য বিদেশী বণিকদের সাহায্যদানের ও ব্যবস্থা ছিল। যে সমস্ত দামী কাপড় যা সাধারণ লোক কিনবে না সেগুলি বিক্রির জন্য পরওয়ানা আমলারা অনুমতি পত্র দিতেন যা আমীর মালিক ও অন্যান্য অভিজাতকদের আয়ের ভিত্তিতে অনুমতি দেওয়া হতো।
অশ্ব, দাস ও গবাদি পশুর বাজার
তৃতীয় শ্রেণীর বাজারে অশ্ব, গবাদি পশু, ক্রীতদাস দাসী ক্রয় বিক্রয় একই নিয়মে পরিচালিত হত। গুণগতমান বিচার করে দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ, বণিক ও পুঁজিবাদীদের অপসারণ, দালালদের ওপর কড়া নজর এবং বাজারে ব্যক্তিগত নজরদারি ও অনুসন্ধান নিয়মগুলি সবকটি বাজারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। সাধারণত অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য উপযুক্ত অশ্বগুলিক মান অনুযায়ী তিন শ্রেণীতে ভাগ করে দাম নির্ধারণ করা হত। প্রথম বা উন্নত শ্রেণীর ঘোড়ার দাম 100 তঙ্কা , মাঝারি 80-90 তঙ্কা, এবং তৃতীয় শ্রেণির দাম 60-70 তঙ্কা। অশ্ব ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও যেমন তেমনি গবাদি পশু ও দাস-দাসীদের বাজারও ছিল সুলতানের কড়া অনুশাসন। একইভাবে মান অনুযায়ী তাদের দান নির্ধারিত হত।
![]() |
অশ্ব, দাস ও গবাদি পশুর বাজার |
চতুর্থ শ্রেণী অর্থাৎ সাধারণ বাজারের জন্য রাজধানীর কোন সুনির্দিষ্ট স্থান ছিল না। নেত্র প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয় চলত ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অঞ্চলে। তবে এইসব বাজারেও যাতে সরকার নির্দিষ্ট দামে পণ্য বিক্রয় হয়। সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রালয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখত।
মূল্যায়ন
আলাউদ্দিনের এই অর্থনৈতিক সংস্কারের গুরুত্ব ও সাফল্য দুই-ই অনস্বীকার্য। ফেরেস্তা লিখেছেন যে, সুলতানের রাজস্বের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বাবস্থায় পণ্য সম্ভারের দাম অপরিবর্তিত থেকে যায়। বরানির মতে নিয়ম-কানুনের কঠোরতা জনসাধারণের অর্থাভার , কর্মচারীদের তৎপরতা এবং শান্তির ভিত্তি এই সংস্কারের সাফল্য এনে দিয়েছিল। এই সংস্কারগুলি বিশেষ করে শস্যের দাম একই রেখে দেওয়াকে “wonder of the age” হিসেবে বর্ণনা করলেও এই কানুনগুলির মধ্যে হিন্দুদের জব্ধ করার একটা প্রচেষ্টা ও লক্ষ্য করেছেন। এ সময়ে ব্যবসায়ী বণিকদের অনেকেই ছিলেন হিন্দু এবং তারা যাতে পণ্য ব্যবসায় মুনাফা লাভ করতে না পারে সেজন্যই সুলতান তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।
অধ্যাপক সতীশচন্দ্র এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, পশ্চিমে ও মধ্য এশিয়াই বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যে বৈদেশিক বাণিজ্য এ সময় চালু ছিল তা পরিচালিত হতো প্রধানত খোরসানী ও সুলতানি বণিকদের দ্বারা যাদের অধিকাংশই ছিল ধর্মে মুসলমান। আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক বিধান তাদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযুক্ত হত।
অধ্যাপক শর্মা এর মতে, আলাউদ্দিনের অভিনব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে জনসাধারণের বিন্দুমাত্র উপকার হয়নি। সামরিক সংগঠনকে আরো ব্যাপক করার উদ্দেশ্যই সুলতান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া সমস্ত সাম্রাজ্যের নয় কেবলমাত্র দিল্লি এবং সন্নিহিত অঞ্চলেই খাদ্যশস্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। উপরন্তু এই নীতির পিছনে প্রজাহিতেষনামূলক পরিকল্পনা না থাকায় সুলতানি সাম্রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিন্দুমাত্র উপকৃত হয়নি।
বরানির রচনায় দিল্লির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উল্লেখই পাওয়া গিয়েছিল যদিও তিনি লিখেছেন রাজধানীর মত অন্যত্র ও তার নিয়ন্ত্রিত হত। তার ভাষায় সম্রাটের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সেনাদের তুষ্ট রাখা এবং সেনারা যে শুধুমাত্র রাজনীতিতে মোতায়েন ছিল তা নয়। কিন্তু ডা: হাবিব এ জাতীয় সিদ্ধান্ত সহমত নন। কারণ বরানির রচনাতেই আছে যে দিল্লির নিয়ন্ত্রিত বাজার থেকে পণ্য সামগ্রী কিনে অন্যত্র যাতে অপেক্ষাকৃত চড়া দরে বিক্রি করা না যায় সেদিকে সুলতান নজর দিতেন। এতেই প্রমাণ হয় যে, সমগ্র সাম্রাজ্যের এই ব্যবস্থা চালু ছিল না। শুধুমাত্র কঠোর শাস্তির ভয় দেখিয়ে সুলতান বাজারদর নিয়ন্ত্রিত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কোন অর্থনীতির নিয়ম মেনে নয়।
ড: হাবিবের মতে আলাউদ্দিনকৃত ব্যবস্থার সুফল আদৌ প্রজারা লাভ করেনি। বিপুল হারে রাজস্ব সাধারণ কৃষকদের সঙ্গে গ্রামীন অভিজাতদেরও দরিদ্র করেছিল তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল। উপরন্ত দোয়াব অঞ্চল ছিল সর্বাপেক্ষ উৎপীড়িত। বরানির তথ্যের ভিত্তিতে ড: হাবিব সিদ্ধান্ত করেছেন কিছু অভিজাত উচ্চপদে আসীন সরকারি কর্মচারী সুলতানি বনিক, সাহুকার(মহাজন) দের হাতেই নগদ অর্থ ছিল। এবং কম পণ্য মূল্যের সুবিধা এই শ্রেণীর ক্রেতারাই লাভ করেছিল সাধারণ প্রজারা নয়। এভাবেই অর্থনীতির বহু স্বাভাবিক নিয়ম বহু অংশে সুলতান লঙ্ঘন করেছিলেন। অর্থনীতিবিদরা মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছেন কারণ তাদের মতে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে রাজা লাভবান হয়েছিল জনগণ না।
ইংরেজ ঐতিহাসিক লেনপুলের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মতে নেপোলিয়নের মত আলাউদ্দিন ও বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্রের সাফল্য নির্ভর করে জনগণের হাতে। সস্তায় খাদ্যদ্রব্য তুলে দেওয়ার ওপর বলা বাহুল্য সুলতান ও ব্যাপারে স্বয়ং নজরদারি করতেন এবং এ কাজে সাধারণ প্রজার সমর্থন ছিল সুলতানের প্রতি। সুলতান ধনীদের কাছ থেকে নানাভাবে অর্থ আদায় করে দরিদ্র জনগণকে কিছুটা সুবিধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। লেনপুল এজন্যই আলাউদ্দিনকে “Political economist” হিসেবে প্রশংসা করেছেন।
অপরপক্ষে k.s. Lal এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, ক্রেতাদের সুবিধা দিতে গিয়ে আলাউদ্দিন শস্য উৎপাদনকে স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেননি। ফলে উৎপাদকরা উদ্বৃত্ত উৎপাদনে উৎসাহী হয়নি। মুনাফা অর্জন যে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান প্রেষণা হতে পারে এ তথ্য আলাউদ্দিন উপলব্ধি করেননি। পি.শরনের মতে, এই নীতি ছিল পুরোপুরি যুক্তিহীন, ভ্রান্ত পরিকল্পনা যুক্ত, কৃত্রিম এবং সফল প্রকার অর্থনৈতিক নিয়ম বহির্ভূত।
তবে সুলতানের এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুটি তাৎক্ষণিক সুফল বিষয়ে নিঃসন্দেহে পাওয়া যায়। আলাউদ্দিনের শাসন শুরুর আগে ও পরে মোহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের সময় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, সরকারি শস্যাগার পুণ্য থাকায় আলোচ্য অধ্যায় সে জাতীয় কোন দুর্বিপাক হয়নি।
দ্বিতীয়তঃ খাদ্যশস্যের দাম বেধে দেওয়ায় সুলতানের পক্ষে নগদ কিন্তু কম বেতনে এক বিশাল ও স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সৈন্য সংগ্রহের জন্য সুলতানকে আর ইক্তাদারদের উপর নির্ভর করতে হতো না। খিলজী সাম্রাজ্যবান এভাবে সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী হবার এক দুর্লভ সুযোগ পেয়ে যায়। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ রাখার বিরুদ্ধে সরকারি নীতি ছিল একান্ত ভাবেই আলাউদ্দিনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ নির্ভর পরবর্তী কোনো সুলতানকে এজাতীয় উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।