ভূমিকা
মহম্মদ বিন তুঘলকের উদ্ভাবলির শক্তি ছিল অসীম। মধ্যযুগীয় এই শাসকের প্রচলিত ব্যবস্থার গণ্ডির মধ্য থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের পরিবর্তে নিত্য নতুন করে কল্পনা গ্রহণ করে তার শাসন প্রতিভা কে বিকশিত করতে অধিক আগ্রহী ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি মধ্যে অন্তগত ছিল দোয়াবের রাজস্ব বৃদ্ধি, দিল্লি থেকে দেবগিরিতে মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর ।
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তরঃ
1328-29 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর। আদিতে দৌলতাবাদ এর নাম ছিল দেবগিরি। বরানির মতে সুলতান ভৌগোলিক পরিস্থিতির বিচারে দিল্লির তুলনায় অধিকতর একটি কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রাজধানী স্থাপনের কথা চিন্তা করেন। দেবগিরি থেকে দিল্লি, গুজরাট, বাংলা, তেলেঙ্গানা, দূরত্ব ছিল প্রায় সমান। ইবন বতুতার বিবরণে জানা যায় যে দিল্লির অধিবাসীরা সন্তানের প্রতি বিরূপ ছিলেন তাই তাদের জব্দ করার জন্য সুলতান দিল্লি তাক করে দৌলতাবাদে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি জানিয়েছেন যে মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন নিশংস।
![]() |
দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর |
গভীর রাত্রে সুলতান তার প্রসাদের ওপর থেকে অলক্ষীণ দিল্লি শহর দেখে শান্তি পেতেন। তবে দিল্লী বাসির প্রতি সুলতানের ক্ষোভের তত্ত্ব খুব একটা জোরদাড় নয় আর তিনি সমস্ত দিল্লিবাসীতে দেবগিরিতে যেতে বাধ্য করেননি। মহম্মদ হাবিব জানিয়েছেন যে, আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারতের সাথে দিল্লির দূরত্বের বিবেচনা যেখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেননি মহম্মদ উপলব্ধি করেছিলেন যে বরঙ্গলে দিল্লির কর্তৃত্ব স্থাপিত না হলে দেবগিরিতে ও দিল্লির আধিপত্য স্থায়ী হবে না তাই তিনি বরঙ্গলকে দিল্লির অন্তর্ভুক্ত করেন। দেবগিরির সরকারি কর্মী ছাড়া প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। সুলতান বেশ কিছু সুফি সাধককে দেবগিরিতে আনার সিদ্ধান্ত নেন কারণ এদের প্রভাবেই উত্তর ভারতের বহু নিম্ন বর্ণের হিন্দু ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন
গার্ডেনার ব্রাউনের মতে, মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর ছিল একান্তভাবেই আর্থ-রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং অনিবার্য। মঙ্গল আক্রমণের পেনৈপুনিবাতা দিল্লির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছিল এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি ও শিথিল হয়ে গিয়েছিল তাই প্রতিহিংসা পরায়ণতা বা দক্ষিণ ভারতে ইসলামের সম্প্রসারণের জন্য তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেননি।
শির হিন্দি লিখেছেন সুলতান 1326-27 এর মধ্যেই দিল্লি ও দৌলতাবাদের মধ্যে প্রশস্ত রাস্তা, অসংখ্য সরাইখানা, বিশ্রামের জন্য রাস্তার দুপাশে বৃক্ষরোপণের, কাজ করেছিলেন। প্রথমে সুলতানের মা, আমীর মালিক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের দেবগিরিতে পাঠানো হয়। তারপর শেখ সৈয়দ উলিমাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সম্ভবত ইসলামীয় বৃদ্ধ পিতামহ দৌলতাবাদের যাওয়ার পথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাই এই পরিকল্পনা ইসামি লেখনীতে একটা বিশ্বাস রূপ নিয়েছে। আর ইবনবতুতা দিল্লির দুরাবস্থার কথা লিখেছেন লোক মুখে শুনে শুনে।
তবে মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর পদ্ধতি, সময়কাল ও লক্ষ্য সুনিশ্চিত না। দীর্ঘ 160-70 বছর ধরে দিল্লিতে যে প্রতি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া এক ধরনের আত্মতা সৃষ্টি হয়েছিল ভূমির সঙ্গে তার অধিবাসীদের।
মূল্যায়ন
সুলতানের আদেশ মান্য করতে জনগণের কানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। প্রচন্ড গ্রীষ্মের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নির্দিষ্ট স্থানে অনেকেই পৌঁছতে পারেননি। সুলতান ও বুঝতে পারেন যে, এই সুদূর দক্ষিণ থেকে উত্তর পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই তিনি পুনরায় দিল্লী প্রত্যাবর্তনে সিদ্ধান্ত নেয়।