ঠান্ডা যুদ্ধের প্রকৃতি বা চরিত্র।
ভূমিকা
ঠান্ডা যুদ্ধের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, রয়েছে নানান তাত্ত্বিক কচকচানি। মূলত তিনটি প্রধান ধারায় ঠান্ডা যুদ্ধের প্রকৃতি সংক্রান্ত আলাপ আলোচনাকে বিশ্লেষণ করা যায়।
- চিরায়ত ভাষ্য (ঠান্ডা যুদ্ধের চরিত্র মূলত আদর্শগত এবং এর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ানের একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সাম্যবাদী আদর্শ দায়ী),
- সংশোধনাবাদী ব্যাখ্যা (ঠান্ডা যুদ্ধের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম করার মার্কিন উদ্যোগ) এবং
- বাস্তববাদী ব্যাখ্যা (ঠান্ডা যুদ্ধের মূল কারণ ছিল প্রভাবাধীন অঞ্চল গঠনের জন্য সোভিয়েত প্রয়াস এবং এর বিরুদ্ধে শক্তিসাম্য বজায় রাখার জন্য মার্কিনী প্রতিক্রিয়া)।
![]() |
ঠান্ডা লড়াই |
চিরায়ত ভাষ্য
চিরায়ত ভাষ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম লগ্ন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনে সাম্যবাদী রাশিয়ার উদ্দেশ্য এবং সম্প্রসারণশীল দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান স্পষ্টভাবে বলেছেন ‘নাৎসী, কামিউনিস্ট, ফ্যাসিস্ট ইত্যাদি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই- তারা সবাই সমান’ (There is not any difference in totalitarian states – Nazi, Communist or Facist or Franco or anything else they are all alike. )।
১৯৪৫ – সালে মার্কিন নৌ সচিব জেমস ফরেস্টাল তার ডায়েরীতে লিখছেন যে সাম্যবাদী রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি গণতান্ত্রিক দেশের মুক্তপন্থী পররাষ্ট্রনীতি থেকে আলাদা কেননা একনায়কতন্ত্রী রাশিয়া বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তার অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে। উইনস্টন চার্চিল ‘The Second World War’ গ্রন্থে, হার্বার্ট ফিস “Churchill, Roosevelt and Stalin’ এবং From Trust to Terror” গ্রন্থে এবং জর্জ কেন্নান ‘American Diplomacy’ গ্রন্থে, সাম্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার বিস্তারের নীতিকে ঠান্ডা যুদ্ধের উন্মেষের জন্য দায়ী করেছেন।
রূশ রাষ্ট্রপতি স্ট্যালিন ১৯৬৪’র ৯ই ফেব্রুয়ারী একটি ভাষণে বলেছিলেন যে সাম্যবাদ জয়ী না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট ও পজিবাদী দেশগুলির মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষ চলবে। প্রাক্তন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাকিসম লিটভিনভও ঠান্ডা লড়াই’র কারণ হিসাবে আদর্শগত দ্বন্দ্বের কথাই বলেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিশ্বরাজনীতিতে দ্বিমেরুকরণ ঘটে এবং পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ পরস্পরবিরোধী এই দুই জীবনচর্যা একে অপরের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। বস্তুতপক্ষে নিজ দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৈধতা এবং বহির্বিশ্বে সম্প্রসারণের নীতিকে যৌক্তিকতা প্রদানের জন্য আদর্শবাদের সংঘাতকে মোড়ক হিসাবে রাশিয়া ব্যবহার করতে চেয়েছিল। স্পেনিয়ারের মতে ‘The Soviet leadership not only required a foreign enemy but the idealogy that legitimated its power also conveniently defined that enemy’- (American Foreign Policy since World War II) ।
সংশোধনাবাদী ব্যাখ্যা
সংশোধনবাদী ভাষ্য প্রচলিত হয় ষাটের দশকে, যদিও ১৯৪৭ সালে ওয়াল্টার লিপম্যানের লেখা ‘The Cold War and its Origins 1917-1960’ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে এই ব্যাখ্যার সূত্রপাত।
জর্জ এফ কেন্নানের বেষ্টনী নীতির সমালোচনা করে লিপম্যান মত প্রকাশ করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইওরোপে সোভিয়েত রাশিয়ার বিশেষ স্বার্থকে বাধা দিয়ে রাশিয়াকে অনমনীয় করে তোলে। পরবর্তীকালে সংশোধনবাদী তত্ত্বের সমর্থকরা বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রাশিয়াকে বাধা দানের পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণ নিহীত ছিল। ডি এফ ফ্লেমিং ” গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতি রুডেন্টের সহাবস্থানের নীতি থেকে সরে এসে টুম্যান রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্বেষের নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৪৫ সালে রাশিয়াকে পোল্যান্ডে সম্প্রসারণের নীতি পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেন, এমনকি আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেন।
ফ্লেমিং’র মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াই এ বাধ্য হয়ে যোগদান করেনি, যুদ্ধোত্তর বিশ্বে আর্থিক এবং সামরিক দিক দিয়ে মহাশক্তিধর হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র নিজ সহায় সম্পদকে যৌক্তিকভাবে কাজে লাগানোর জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় এবং আগ্রাসী নীতি নিয়েছিল। উইলিয়াম এ উইলিয়ামস এবং লয়েড গার্ডনার মনে করেন যে ঠান্ডা লড়াই’র সূচনা অবধারিত হলেও পরে এই লড়াইকে ঠেকানো যেত, কিন্তু অননীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্যবাদের বিরুদ্ধে ক্রুশেড তা হতে দেয় নি। বিশেষজ্ঞদের মতে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইওরোপকে রাশিয়ার প্রভাবাধীন অঞ্চল হিসাবে মেনে নিলে ঠান্ডা লড়াই থেমে যেত।
অধ্যাপক ডেভিড হারোউইজ From Yalta to Vietnam’ গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে রাশিয়া সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। জার্মানীর রূশ অভিযান বা বারের বিরুদ্ধে অভিযান’এ ২৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুহারা হয়, অসংখ্য জনপদ (১৭০০০ শহর, ৭০০০০গ্রাম), কলকারখানা (৩১০০০ ) ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর্থিক হিসাবে গুংসের পরিমাণ ছিল ৬৭৯,০০০ মিলিয়ান রুবেল। সমগ্র যুদ্ধ জুড়ে রাশিয়ায় সাত থেকে দশ মিলিয়ান অসামরিক ব্যক্তি এবং সাড়ে সাত মিলিয়ান সেনা প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই অবস্থায় স্ট্যালিনের পক্ষে বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদী প্রসারের আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করা বাস্তবসম্মত ছিলনা, তিনি একটি আত্মমুখী রক্ষণাত্মক বা ‘Self Containment’ নীতি চেয়েছিলেন ভৌগোলিক দিক দিয়ে নিকটবর্তী বা পার্শ্ববর্তী পূর্ব ইওরোপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একটি নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
আইজাক ডয়েশার’র লেখা স্ট্যালিনের জীবনীতে রূশ রাষ্ট্রপ্রধানের এই রক্ষণশীল মানসিকতা তুলে ধরা হয়েছে। হারোউইজ আরও দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে যুদ্ধকালীন পাশ্চাত্য মিত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তিনি গ্রীস, চীন, ইতালী, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের কমিউনিস্টদের বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের নীতি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে ঐতিহাসিক গাল অ্যালপারোভিজ ‘Atomic Diplomacy’ নামক গ্রন্থে বলেছেন যে সমসাময়িক বিশ্বে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই সফলভাবে আণবিক বোমা ব্যবহারের চাবিকাঠি ছিল – ফলত যুক্তরাষ্ট্রের শাসকবৃন্দের একটি বড় অংশ সহাবস্থানের নীতি প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং সংঘাতের নীতি নিয়েছিল – রাষ্ট্রপতি টুম্যানের ঘোষণার মধ্যে দিয়ে এই মানসিকতাগত পরিবর্তন স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। ইয়ান্ট সম্মেলনে আপোসমুখী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বছরের মধ্যেন্ত হয়ে উঠেছিল আপোষহীন ও আগ্রাসী। তবে গাল অ্যালপারোডিজ ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই একতরফাভাবে দায়ী করেননি, তিনি দেখিয়েছেন যে সোভিয়েত রাশিয়াও সমনাভাবে অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েছিল যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
আবার ঠান্ডা যুদ্ধের প্রকৃতি, কারণ এবং দায়বদ্ধতাকে আর্থিক প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করে ‘The Politics of War: The World and United States Foreign Policy, 1943-45’ নামক গ্রন্থে ঐতিহাসিক গ্যাব্রিয়েল কলকো মত দিয়েছেন যে যুদ্ধান্তে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এই অর্থনৈতিক সম্পদ ও শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির পরিচালিকা শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিল।
মার্কিন নীতি নির্ধারকরা চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক ও মুক্তপন্থী আদর্শের কাজে লাগিয়ে বিশ্বজুড়ে মুক্ত অর্থনীতির প্রয়োগ ঘটাতে – যুদ্ধবিধস্ত ইওরোপ তথা বিশ্বে আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে পরিত্রাতা ও মুক্তিদাতা হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল – অন্তরে লুকিয়ে ছিল বিশ্বজুড়ে মার্কিন অর্থনীতিকে প্রসারিত করার গোপন অভিসন্ধি। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল সাম্যবাদী আদর্শ ফলে ঐ আদর্শের ধারক-বাহক রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংঘাতে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। কলকো দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে ১৯৪৩ সাল থেকেই মুক্তপন্থী বাণিজ্য অর্থনীতির আবহে সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতিকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রন করতে চেয়েছিল এবং পররাষ্ট্র সচিব কর্ডেল হালের মত অনেকেই এই অর্থনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের ঘোরতর সমর্থক ছিলেন।
নব্যবাম ঐতিহাসিকবৃন্দ ( New Left Historians) সংশোধনবাদী ধারার অন্যতম রূপকার। তাদের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে টুম্যান বা তার অনুগামীদের মধ্যে দিয়েই মার্কিন আগ্রাসনকে বোঝা যাবে না, বস্তুতপক্ষে তার অনেক আগে থেকেই ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে স্পেনীয়-মার্কিন সংঘাতের মধ্যে দিয়েই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী চরিত্র প্রতিফলিত হয়। উইলিয়াম অ্যাপেলম্যান উইলিয়ামস “The Tragedy of American Diplomacy’ এবং ‘The Contours of American History’ গ্রন্থ দুটিতে দেখিয়েছেন যে ১৭৬০ সাল থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা দেখিয়েছিল তবে ১৮৯০ পর্যন্ত তা কেবল সীমাবদ্ধ ছিল পশ্চিম গোলার্ধে, পরে তা মুক্তদ্বার নীতির সূত্র ধরে সুদূর প্রাচ্যেও প্রসারিত হয়েছিল। ওয়াল্টার লেফেবার, গ্যাব্রিয়েল কলকো প্রমুখ পন্ডিতরা পরে মার্কিন অর্থনীতির এই সম্প্রসারণবাদী চরত্রিকে আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন।
বাস্তববাদী ব্যাখ্যা
ঠান্ডা যুদ্ধের চরিত্র বা প্রকৃতি সংক্রান্ত চিরায়ত ব্যাখ্যার সমর্থক এবং সংশোধনবাদীদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করছেন বাস্তববাদী ব্যাখ্যার প্রবক্তারা তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেষ্টনী নীতি অথবা সোভিয়েত ইউনিয়ানের সাম্যবাদী সম্প্রসারণ কোনটাকেই ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য একতরফাভাবে দায়ী করেননি। বাস্তবাবাদী ঐতিহাসিকরা ঠান্ডা যুদ্ধকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন জাতীয় স্বার্থের সংঘাত, শক্তির প্রতদ্বন্বিতা ও শক্তিসাম্য নীতির আঙ্গিকে। এই মতের সমর্থক লুই জে হ্যালে মজ করে লিখেছেন যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ যেন একটি বোতলে বিষাক্ত বিছে এবং মাকড়সা আবদ্ধ হয়ে একে অপরের সঙ্গে লড়াই লিপ্ত। বস্তুতপক্ষে বাস্তববাদী ধারার ঐতিহাসিকদের মতে রাশিয়া ও আমেরিকা উভয় পক্ষই সংকীর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ধরাবাহিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। এই ধারার পন্ডিতদের বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা কর হল।
হ্যানস জে মরগ্যানথো এবং লুই জে হ্যালে মরগ্যানথো ‘In Defence of the National Interest: A critical Examination of American Foreign Policy” গ্রন্থে মত দিয়েছেন যে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত সম্প্রসারণের নীতিকে সামাবাদী মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ভুল করেছিল এবং অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ানও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখেছিল সাম্যবাদের শত্রু পুঁজিবাদী জগতের কর্ণধার রূপে। লুই দে হ্যালের মতে (The Cold War as History) ঠান্ডা যুদ্ধ ছিল ক্ষমতার রাজনীতি এবং শক্তিসাম্য থেকে উদ্ভূত সমস্যা নেপোলিয়ানের যুদ্ধ এবং দুই বিশ্বযুদ্ধের মতই ঠাণ্ডা লড়াই ছিল নতুন মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের সম্প্রসারণশীল নীতির বিরুদ্ধে পাল্টা জোট গড়ে উঠার প্রথাগত ঐতিহাসিক কাহিনী।
পূর্বতন সংঘাতগুলির মত ঠান্ডা লড়াই’র ক্ষেত্রেও ইওরোপীয় মহাদেশের রাজনৈতিক ঘাতপ্রতিঘাতই যুদ্ধের প্রেক্ষিত রচনা করেছিল পার্থক্য বা অভিনবত্ব শুধু এখানেই ছিল যে ঠান্ডা লড়াইয়ে যুজমান দুই মূল পক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইওরোপের বাইরে পশ্চিম গোলার্ধে অবস্থিত ছিল এবং সোভিয়েত রাশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও অপেক্ষাকৃত পূর্ব দিকস্থ রাষ্ট্র ছিল। সুতরাং হ্যালের মতে ঠান্ডা লড়াই হল ইওরোপীয় রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চিরায়ত বা ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতার স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। তবে পূর্বতন তিনটি মহাসংগ্রাম অর্থাৎ নেপোলিয়ানের যুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল এই যে ঐ যুদ্ধগুলি ছিল ভয়ঙ্কর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম যেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল, ঠান্ডা যুদ্ধের ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি বা রক্তপাতের ঘটনা নেহাতই দুর্ঘটনাবশতঃ হয়েছিল এই যুদ্ধে বিবাদমান দুই পক্ষই নিজ নিজ ভৌমিক অধিকার বজায় রাখার জন্যেই আগ্রহী ও ব্যস্ত ছিল।
তবে বাস্তববাদী ভাষ্যের সমর্থক হ্যালে ঠান্ডা যুদ্ধের আগমেনর জন্য সোভিয়েত রাশিয়া এবং বিশেষভাবে ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাশ্চাত্য জগত সম্পর্কে স্ট্যালিনের অনমনীয় মনোভাবকে দায়ী করেছেন। তার মতে স্ট্যালিন সামান্য নমনীয়তা দেখালে ঠান্ডা যুদ্ধকে এড়ানো যেত। হ্যাল একথাও বলেছেন যে স্ট্যালিনের অনমনীয়তার জন্য দায়ী ছিল পাশ্চাত্য দেশগুলির শক্তি সম্পর্কে এবং পাশ্চাত্য দেশগুলির বিদ্বেষমূলক মনোভাব সম্বন্ধে স্ট্যালিনের ভ্রান্ত ধারণা। হ্যালের ভাষায় ‘It is clear that in the summer of 1947 Stalin both underestimated the intrinsic strength of the west and overestimated its hostile intentions ।
স্ট্যালিন ভেবেছিলেন যে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য দুনিয়ার আর্থিক সংকট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসতে পারবে না এবং তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে আণবিক শক্তিতে বলিয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোন ধরণের আগ্রাসন দেখাতে প্রস্তুত। এই ধারণা থেকেই ১৯৪৭ সালে কমিনফর্ম গঠন এবং পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের বিরুদ্ধে সামাবাদী গণতান্ত্রিক শিবিরের যুদ্ধ ঘোষণা। হ্যালে বলছেন যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যানও ১৯৪৮ সালে তার নীতির মধ্যে দিয়ে মুক্ত দুনিয়া রক্ষা করা এবং সোভিয়েত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার অঙ্গীকার করলেন এবং ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা নিশ্চিত হল।
ঠান্ডা যুদ্ধকে আদর্শের সংঘাত বলে মানতে চাননি অধ্যাপক রিচার্ড ক্রকেটও (The Fifty Years War, 1941 1991)। তাঁর মতে আদর্শবাদী লড়াই হলে ঠান্ডা যুদ্ধ ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই তা শুরু হত। তিনি বলেছেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইওরূেপে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ব্যাপক শক্তিক্ষয়, এবং জার্মানীর পতনের ফলে এক রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল যা পূরণ করার পক্ষে রাশিয়ার যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের এই পরিবর্তন ইওরোপে রাশিয়াকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তোলে এবং শক্তিসাম্যের ভারসাম্য রক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর দ্বারা রাশিয়াকে বাধা দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিফলন ঘটায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী এবং রাশিয়া সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় এই ক্ষমতা বা শক্তির লড়াইকে আদর্শের পোষাক পড়ানো হয়। তাই ক্রকেট লিখছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া এক আদর্শে ও ব্যবস্থায় বিশ্বাসী হলেও আলোচ্য সময়কালে এবং পরিস্থিতিতে উভয়ের মধ্যে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী ছিল। (…..but it is difficult to believe that the US- Soviet relationship would have been conflict free, even had they possessed similar political systems and social values)
সমসাময়িক অনেক ঐতিহাসিকই ঠান্ডা যুদ্ধকে সংঘর্ষের অনুঘোটক রূপে মানতে চাননি, তাদের ব্যাখ্যায় ঠান্ডা যুদ্ধ সমসাময়িক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুদ্ধের নামে স্থায়িত্ব ও শক্তিসাম্যের রক্ষক। জন গ্যাডিস ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত The Long Peace: inquiries into the history of the Cold War’ নামক গ্রন্থে ঠান্ডা যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দ্যোতক বলে অভিহিত করেছেন। এই ব্যাখ্যার সমর্থনে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পরবর্তী চল্লিশ বছরে পৃথিবীতে রাজনৈতিক টেনশন থাকলেও বড় মাপের কোন ধ্বংসাত্মক সংগ্রাম হয়নি, বরং একটি আত্মনিয়ন্ত্রনকারী ব্যবস্থা রূপ নিয়েছে। ঐজন্য গ্যাডিস ঠান্ডা যুদ্ধের যুগকে দীর্ঘ শান্তির যুগ বা ‘The Long Peace’ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
ইরান (১৯৪৬), গ্রীস (১৯৪৭), বার্লিন (১৯৪৮), কোরিয়া (১৯৫০), হাঙ্গেরী (১৯৫৬), সুয়েজ (১৯৫৬), বার্লিন (১৯৫৯), কিউবা (১৯৬২), আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ (১৯৬৭, ১৯৭৩), ভিয়েতনাম (১৯৬৫-৬৮) আফগানিস্থান (১৯৭১) এবং পোল্যান্ড (১৯৮১) প্রভৃতি সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ান চরম সংঘর্ষের লিপ্ত হতে পারত, কিন্তু হয় নি। অন্যদিকে কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্থানে রাশিয়া দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।
বস্তুতপক্ষে সামরিক দিক দিয়ে মহাশক্তিধর এই দুই রাষ্ট্র পরস্পর ধ্বংসসাধনের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই লিপ্ত হয়নি, গোলকের নিজ নিজ অংশকে নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্টাটাই সযত্নে করে গেছিল। গ্যাডিস মনে করেন উভয় রাষ্ট্রের কেউই কাউকে বা একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়নি। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেষ্টনী নীতির মাধ্যমে রাশিয়াকে সংযত করতে এবং মানসিকতা বদলাতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে স্ট্যালিন পাশ্চাত্য দুনিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা বললেও তার কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল রাশিয়ার নিরাপত্তা। স্ট্যালিন পরবর্তী রুশ রাষ্ট্রপ্রধানরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথাই বলেছিলেন। গ্যাডিস পরিহাস করে ঠান্ডা যুদ্ধের এই অবস্থাকে ট্যাঙ্গো নৃত্যের সঙ্গে তুলণা করে বলেছেন যে দু পক্ষকেই প্রাণবন্ত ও হৃষ্টপুষ্ট না হলে চলবে না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বিমেরুকরণের যে ভারসাম্য ছিল তা বিংশ শতকের অন্তিম দশকে বিনষ্ট হয়ে যায় – আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একমেরুকরণের প্রবণতা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়।
গ্যাডিস লিখেছেন ‘The Cold War, with all of its rivalries, anxieties and unquestionable danger has produced the longest period of stability in relations among the great powers that the world has known in this century’। বস্তুতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে দ্বিমেরুকরণের রাজনীতি থেকে সৃষ্ট ঠান্ডা যুদ্ধ ১৯৪৫- ১৯৯০ পর্যন্ত বিশ্বরাজনীতিতে অদ্ভুত এক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।