মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কার গুলি আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ
মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কার গুলির মধ্যে অন্তগত ছিল ভূমি রাজস্ব সংস্কার, মুদ্রা সংস্কার, রাজধানী স্থানান্তর, দোয়াবের রাজস্ব বৃদ্ধি, তাম্র মুদ্রা প্রবর্তন এবং খোড়াসান ও কারাচল অভিযান। বিভিন্ন বিবরণের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, 1325-1335 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা রূপায়ণ সচেষ্ট হয়েছিল।
![]() |
মহম্মদ বিন তুঘলক |
মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কার
ভূমি সংস্কার
মহম্মদ বিন তুঘলকের ভূমি সংস্কার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তিনি এক নির্দেশ জারি করে বিভিন্ন প্রদেশের আয় ব্যায়ের হিসেব লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ভূমির রাজস্ব ব্যবস্থায় সামঞ্জস্যবিধানে সচেষ্ট ছিলেন।
রাজস্ব সংস্কার
ড: ঈশ্বরী প্রসাদ ও রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে 1325-27 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহম্মদ বিন তুঘলক গঙ্গা, যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে ভূমি রাজস্বের হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেন। বরানির তথ্য অনুযায়ী দোয়াবে রাজস্বের হার 10-20 গুন বৃদ্ধি করা হয়েছিল। রাজ কর্মচারীরা এর সঙ্গে আক্রয়াব আদায় করার জন্য কঠোরতা অবলম্বন করলে রায়ত্তরা ক্ষুব্দ হয়। কীক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। অধিকাংশ জমি পতিত থেকে যায় ফলে দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলে ও দোয়াবে খাদ্যভার ও দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। অনাবৃষ্টি জনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই অবস্থাকে আরো ঘনীভূত করে। বরানির বর্ণনায় সুলতান জমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে বলে জানিয়েছেন।
তবে বরানির বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে আধুনিক কালের ইতিহাসবিদরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এবং এই তথ্যে অতিরঞ্জন ছাপ সুস্পষ্ট। গার্ডনার ব্রাউন মনে করেন যে, রাজস্বের ধিতগর নয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তার পরিকল্পনাতে সমালোচনার মুখে দাঁড় ছিল। মহম্মদ বিন তুঘলক রাজকোষ কে সমৃদ্ধ করতে এবং কৃষক শ্রেণীকে জব্দ করতে দয়াবে কর বৃদ্ধি করেছিলেন বলে বদাউন মত প্রকাশ করেছিলেন। তবে এ তথ্য সম্পন্ন সত্য নয় তবে জনসাধারণের দুর্দশা খবর পাওয়ায় পড়ে সুলতান তাদের অর্থ, খাদ্য ও বলদ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কর মকুব ও করা হয়। কিন্তু সুলতানের এই ব্যবস্থা সমরাচিত না হওয়াই এবং কর্মচারীদের অসাধু তা ও দায়িত্ব হীন তার জন্য কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ ব্যর্থ হয়েছিল।
মহম্মদ বিন তুঘলকের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা কৃষকদের জন্য যে অঞ্চলটিকে বেছে নিয়েছিলেন তা কৃষিকাজের উপযুক্ত ছিল না। এই পরিকল্পনাটির অভিনব হলেও তার রূপায়ণের জন্য দক্ষ নজরদারি ছিল, যা সম্ভব হয়নি। এই ধরনের কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য প্রাক সমীক্ষা প্রস্তুতি ও সময়ের প্রয়োজন ছিল কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি। দরিদ্র কৃষকদের অনেকেই সরাসরি অনুদানের পূর্ণ ব্যবহার করতে পারেননি। অধ্যাপক এ এল শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন যে, এভাবেই ভূমির রাজস্বের ইতিহাস একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ ও পরিতক্ত হয়েছিল।
মুদ্রা সংস্কার
মহম্মদের পরীক্ষামূলক কর্মসূচির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল মহম্মদ বিন তুঘলকের মুদ্রা সংস্কার এর প্রতীক মুদ্রার প্রচলন। 1327-30 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুলতান প্রতীক মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। ভারতে প্রথম হলেও বিশ্বের দরবারে প্রতীক মুদ্রার ব্যবহার অজানা ছিল না। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই স্বর্ণ ও রৌপের প্রকার বদলে প্রতীক মুদ্রার বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ছিল। চীনে বুখলাই ঘট এবং পারস্যে কাই ঘটু – প্রতীক মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন।
বড়ানি জানিয়েছেন মহম্মদের প্রতীক মুদ্রায় তামা ব্যবহার করা হয়েছিল আবার ফেরিস্তা জানিয়েছেন এটি ছিল ব্রোঞ্জ ‘ দিনার’ ‘টঙ্কা’ জিতলের প্রচলন ছিল। মহম্মদ টঙ্কার সমমানের ব্রোঞ্জের নতুন মুদ্রা চালু করেন। ফার্সিতে লেখা সরকারি টাকসালে প্রস্তুত এই মুদ্রা যাতে জাল না হয় তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সহজলভ্য ধাতুদ্বারা মুদ্রা তৈরি হওয়ায় দেশে জাল মুদ্রা ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা এই মুদ্রা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। সুলতান তার প্রতীক মুদ্রার এই করুণ পরিণতি দেখে তিনি তিন বছরের মধ্যেই তা প্রত্যাহার করে নেন। এবং সমস্ত ব্রোঞ্জ মুদ্রার পরিবর্তে মুদ্রার গ্রাহকদের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা দেওয়া হয়।
বরানীর মতে, সুলতান রাজকোষের শূন্যতা দূর করার জন্য প্রতীক মুদ্রার বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু নিজামি, ড: মাহাদী হুসেন জানিয়েছেন যে রাজ কোষের শূন্যতা এজন্য দায়ী ছিল না কারণ তা ছিল রাজকোষ থেকে সোনা ও রুপোর মুদ্রা দিয়ে ক্ষতিপূরণ দিতে পারতেন না। প্রকৃতপক্ষে চতুর্দশ শতকে বিশ্বব্যাপী রৌপ্য সংকট দেখা দেয়। বাংলা ও দক্ষিণ ভারত থেকে রুপোর সংগ্রহের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। সম্ভবত এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যেই তিনি ব্রোঞ্জ প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সুলতানের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
মূল্যায়ন
মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কার গুলির মূল্যায়ন আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও তার দীর্ঘ প্রসারী ফলাফল ছিল। মূলত তার ধৈর্যশীলতার কারণেই সময়ের থেকে অনেক বেশি অগ্রগামী পরিকল্পনাগুলি সাফল্যের মুখ দেখেনি। ইবন বতুতা বা ইসামি অথবা বরানী সঠিক তথ্য তুলে না ধরাই মহম্মদ বিন তুঘলকের সম্পর্কে কুরুচিকর খারাপ ধারণা জনমহলে তৈরি হয় যা পরবর্তীকালে আধুনিক ঐতিহাসিকদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। তবে ভূমি রাজস্ব ও মুদ্রা সংস্কার, এবং তাম্র মুদ্রা প্রবর্তনে মহম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।