ওপেক (OPEC) এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বা তাৎপর্য।
ভূমিকা
খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারী দেশগুলির সংগঠন ওপেক আসিয়ান এবং আফ্রিকান ইউনিয়ানের মত একটি আন্তঃ রাষ্ট্রীয় সংগঠন, কিন্তু এটি অঞ্চলভিত্তিক নয়, কর্মভিত্তিক। ১৯৬০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে ইরান, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব এবং ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে ১৯৬০ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক প্রতিষ্ঠিত (গঠিত) হয়। opec এর পূর্ণরূপ বা পুরো নাম (ফুল ফর্ম) হলো Organization of Petroleum Exporting Countries। পরবর্তীকালে কাতার (১৯৬১), ইন্দোনেশিয়া (১৯৬২), লিবিয়া (১৯৬২), সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (১৯৬৭), আলজিরিয়া (১৯৬৯), এবং নাইজিরিয়া (১৯৭১) ওপেকের সদস্যপদ গ্রহণ করে। পরে ইকুয়েডর ১৯৭৩ সালে এবং গ্যাবন ১৯৭৫ সালে ওপেকের সদস্য হয় কিন্তু এই দুটি রাষ্ট্র যথাক্রমে ১৯৯২ ও ১৯৯৫ সালে ওপেকের সদস্যপদ ত্যাগ করে। সুতরাং বর্তমানে ওপেকের সদস্য উপরোক্ত এগারোটি দেশ। ওপেকের সচিবালয় বা সদর দপ্তর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে অবস্থিত।
ওপেকের সাংগঠনিক কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে ওপেক সম্মেলন ( OPEC Conference ) যা সাধারণভাবে বছরে দুবার বসে। ওপেক সম্মেলনে ১১টি সদস্য রাষ্ট্রের তৈল ও শক্তি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীগণ সংগঠনের নীতি নির্ধারণ ও কর্মসূচী প্রণয়ন করেন। কাঠামোর পরবর্তী স্তরে রয়েছে বোর্ড অফ গভরনর্স (Board of Governors / BOG) যার দায়িত্ব হল সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ও নীতিসমূহকে বাস্তবে প্রয়োগ করা। ওপেক সচিবালয় পরিচালনা করেন একজন মহাসচিব বা মুখ্য প্রশাসক।
 |
| ওপেক (OPEC) |
উদ্দেশ্য
ওপেক এর উদ্দেশ্য হল সারা বিশ্বে খনিজ তেল এবং তেলজাত অন্যান্য দ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রন, তেলের মূল্য নির্ধারণ, তেলের বাজারের স্থিতাবস্থা বজায় রাখা, এবং সর্বোপরী তেল উৎপাদক দেশগুলি যাতে অর্থনৈতিক প্রগতি সাধন করতে পারে তা সুনিশ্চিত করা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংগঠনের সদস্যপদ সমস্ত তেল উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারী রাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
১৯৫০ এর দশকের শেষভাগে সারা বিশ্ব জুড়ে তেলের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশী ছিল। এর ফলে তেলের মূল্য যা কিনা কেবল বেসরকারী কোম্পানী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত, তা ভীষণভাবে কমে যায় এবং এর ফলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র গুলির রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও হ্রাস পায়। ফলে তেলের বাণিজের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। এই ক্ষতির হাত থেকে রাষ্ট্রগুলিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়েই গঠিত হয়েছিল ওপেক। এছাড়া ১১৫০ ও ৬০ এর দশকে তেল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রগুলি বেসরকারী তেল কোম্পানীগুলির জাতীয়করণ করে এবং বিশ্বের তেলের বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চেষ্টা করে।
গুরুত্ব বা তাৎপর্য
বিংশ শতকের সত্তরের দশক থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ওপেক (opec) এর তাৎপর্য বাড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালে আরব ইজরায়েল যুদ্ধের সময় ওপেক ইজরায়েলকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে পশ্চিম ইওরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্র গ্যাসোলিনের অভাব দেখা যায়। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৭৩ সাল থেকেই ওপেক তেলকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে এবং এই তেল কূটনীতি বা ‘Oil Diplomacy’ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ওপেককেও খুব গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
ওপেক তার সদস্য রাষ্ট্রগুলির উপর বছর প্রতি তেল উৎপাদন / উত্তোলন এবং তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয় এবং এইভাবে তেল উৎপাদন ও সরবরাহের উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রন কায়মে করে। ১৯৮০’র দশকে সদস্য রাষ্ট্রগুলির একাংশ ওপেক নির্ধারিত তৈল উৎপাদনের উদ্ধসীমা লঙ্ঘন করে তেল উৎপাদন করার ফলে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম কমে যায়, ফলে উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর থেকে অবশ্য সদস্যরাষ্ট্রগুলি নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং ওপেক নির্ধরিত তেল উৎপাদনের উর্দ্ধসীমা এবং মূল্যমান মেনে চলে। বস্তুতপক্ষে ওপেক নির্ধারিত তেলের মূল্য সমগ্র বিশ্বজুড়ে মেনে চলা হয় – এর থেকেই এই সংগঠনটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
আসলে বর্তমান যন্ত্র এবং প্রযুক্তি চালিত সভ্যতায় তেল প্রায় জলের মতই অপরিহার্য এবং তেলের নিয়ন্ত্রনকারী সংগঠনরূপে ওপেক সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সারা বিশ্বের তৈল ভান্ডারের ৭৮% রয়েছে ওপেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলিতে এবং সমগ্র বিশ্বের তেল রপ্তানির প্রায় ৪৫% দখল করে আছে ওপেক সদস্য রাষ্ট্রসমূহ। তবে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে ওপেক সুসংগঠিত হলেও ওপেক এর সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, এমনকি সংঘ রয়েছে যেমন ইরান এবং ইরাকের মধ্যে যুদ্ধ ইরাক এবং কুয়েতের মধ্যে সংঘর্ষ সুবিদিত। তবে এই রাজনৈতিক সংঘগুলি সংগঠন হিসাবে ওপেক এর গুরুত্ব কে হ্রাস ঘটায়নি।