ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কি ছিল। ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য ।
ভূমিকা
ভারতে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে রেলপথ স্থাপনের প্রস্তাব উঠতে থাকে। শেষপর্যন্ত বড়োলাট লর্ড ডালহৌসির (১৮৪৮-৫৬ খ্রি.) আমলে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানি’ ভারতে সর্বপ্রথম রেলপথের প্রতিষ্ঠা করে। ডালহৌসিকে ভারতীয় রেলপথের জনক বলা হয়। তাঁর আমলে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ এপ্রিল) বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ২১ মাইল পথে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ভারতের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৪ মাইল পথে ভারতের দ্বিতীয় রেলপথ চালু হয়। ডালহৌসির আমলে ভারতে প্রায় ২০০ মাইল রেলপথ নির্মিত হয়। মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭ খ্রি.) পর ভারতে রেলপথের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলপথের জাতীয়করণ করা হয়, এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম নেটওয়ার্ক (network) হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
![]() |
ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য |
উদ্দেশ্য
- স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য : ভারতীয়দের কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, সম্পূর্ণভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইংরেজরা ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ভারতে রেলপথ স্থাপনের পিছনে ইংরেজদের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী ও শোষণমূলক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। মূলত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যেই ভারতে রেলপথের প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য : অধ্যাপক জে. এম. হার্ড ‘কেম্ব্রিজ ইকনমিক অব ইন্ডিয়া’ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে বলেন যে, রেলপথ স্থাপনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান এখনও সম্ভব না হলেও, এর পিছনে যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যই ছিল, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই।
- ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা : ভারতে রেলপথ স্থাপনের পিছনে লর্ড ডালহৌসির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এদেশে সুদক্ষ ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ইংরেজ সেনাবাহিনীকে দ্রুত ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া, ভারতে ব্রিটিশ পুঁজি ও শিল্পোদ্যোগ বৃদ্ধি করা, কাঁচামাল ও উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য দ্রুত ও সহজে পরিবহণ করা প্রভৃতি প্রয়োজনে তিনি ভারতে রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
- কাঁচামাল রপ্তানি : ইংল্যান্ডের কারখানাগুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সেখানে কাঁচামালের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ভারত থেকে উৎপাদিত কাঁচামাল ইংল্যান্ডের কারখানাগুলিতে পাঠানো হয়। ভারতের অভ্যন্তর থেকে রেল পরিবহনের মাধ্যমে দেশের কাঁচামাল বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছে দেওয়া ছিল রেলপথ স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
- পন্যের আমদানি : ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে সেখানকার কারখানাগুলিতে প্রচুর শিল্পসামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকে। এসব সামগ্রী সহজে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়াও ভারতে রেলপথ স্থাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
- ইংরেজাদর অর্থকরী স্বার্থ : ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগ বহু ইংরেজ ধনপতিকে তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ লগ্নি করার সুযোগ করে দেয়। একইসঙ্গে রেলপথ স্থাপনের কাজে ভারতে বহু ইংরেজের কর্মসংস্থান হয়।
- রাজনৈতিক উদ্দেশ্য : বিশাল ভারতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে দ্রুত সংবাদ আদানপ্রদান ও যোগাযোগ রক্ষা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ, সেনাবাহিনীর কাছে দ্রুত খাদ্য ও রসদ পৌঁছে দেওয়া প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ভারতে রেলপথ স্থাপনকে ব্রিটিশ সরকার অপরিহার্য বলে মনে করে। ব্রিটিশ সরকার আরও মনে করে যে, ভারতে রেলপথের প্রসার ঘটলে বহু ইংরেজের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।
- সামরিক উদ্দেশ্য : লর্ড ডালহৌসি ভারতে সামরিক প্রয়োজনে রেলপথের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। অবশ্য তাঁর আগে লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সামরিক প্রয়োজনে ভারতে রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। এরপর ডালহৌসি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রতিবেদনে একই কথা বলেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সামরিক প্রয়োজনে ভারতে রেলপথ নির্মাণের গুরুত্ব ভালোরকম উপলব্ধি করে। তাই দেখা যায়, বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল না—এমন বহু স্থানেও শুধু সামরিক উদ্দেশ্যে ভারতে রেলপথ স্থাপিত হয়।
উপসংহার
বিলাতি পণ্যসামগ্রী ভারতের অভ্যন্তরের বাজারগুলিতে পৌঁছে দেওয়া এবং ভারতের কাঁচামাল বন্দরে পাঠানোর ক্ষেত্রে রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাই ভারতের রেলপথের গুরুত্ব বাড়ে এবং ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভারতে তাদের পুঁজি বিনিয়োগের সবচেয়ে লাভজনক ক্ষেত্র হিসেবে রেলপথ স্থাপনকেই বেছে নেন। বিপুল লাভের আশায় তারা রেলপথ স্থাপনে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করে। ‘গ্যারান্টি ব্যবস্থা’র মাধ্যমে রেলপথ নির্মাণ করে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। তাদের উদ্যোগে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে প্রায় ২৫ হাজার মাইল রেলপথ নির্মিত হয়।