মেইজি জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকার মূল্যায়ন করো
জাপানে যন্ত্রচালিত রেশম গোটানোর কারখানাগুলির মধ্যে খুব স্বল্প সংখ্যকই সরকারি উদ্যোগে গড়া। বাকী সব মিল বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। রেশম আমদানি ও ব্যাঙ্কিং বাণিজ্যে খ্যাত গুনো (One) পরিবার ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে টোকিওতে একটি রেশম গোটানোর কারখানা স্থাপন করে এবং ১৮৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে আরো সাতটি কারখানা গড়ে তোলে। বেসরকারি উদ্যোগীরা বিশেষ করে রেশম উৎপাদকারী কেন্দ্রীয় হোনশু প্রদেশের স্থানীয় বণিকেরা রেশম শিল্পের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জাপানের রেশম রপ্তানির ৩০ শতাংশ ছিল মেশিনে গোটানো রেশম পণ্য। এই সময় জাপানের রপ্তানির ৪৩ শতাংশই ছিল রেশমজাত পণ্য, যা দ্বিতীয় রপ্তানি পণ্য চায়ের দ্বিগুণ ছিল। বিদেশে জাপানী রেশমের চড়া চাহিদার দরুন আশির দশকের মধ্যভাগে জাপানী বাণিজ্যে অনুকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্য বজায় থাকে। তাই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে জাপানের যে শিল্প বিদেশী বাণিজ্যে অনুকূল ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা প্রধানত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিকশিত হয়েছিল।
সূতীবস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পুঁজি বিনিয়োগের গতি ছিল মন্থর। তবে সরকারি পরীক্ষামূলক কারখানা স্থাপনের পর সূতীবস্ত্র শিল্পেও ব্যক্তিগত বিনিয়োগ লক্ষ্য করা যায়। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাতসুমা ক্ষেত্রে নির্মিত দুটি কারখানা একটি ব্যক্তিগত ফার্মকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি সাহায্য পাওয়া গেলে পরবর্তী সাত বছরে আরো পনেরোটি প্রাইভেট কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর থেকে দ্রুত গতিতে কক্তিগত উদ্যোগে সুতো কাটার ফার্মের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই মেইজি জাপানের সবচেয়ে বড় শিল্প সুতো কাটার কারখানাও পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিকাশ লাভ করে।
![]() |
মেইজি জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকার মূল্যায়ন |
এছাড়া প্রথম থেকেই বেসরকারি উদ্যোগে অন্যান্য যে শিল্প গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে দেশলাই এবং কাগজ তৈরির কারখানা অন্যতম। মেইজি জাপানে অধিকাংশ খনি শিল্পও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল, যদিও এগুলি ছিল খুবই ছোট আকারের এবং অযান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে কয়লা উৎপাদনের ১৯ শতাংশ, লৌহ উৎপাদনের ৯৪ শতাংশ এবং ভাষা উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ ব্যক্তিগত মালিকানার খনি থেকে এসেছিল।
গ্রামীণ সম্পন্ন ভূস্বামী ও বণিকরা পুজি লগ্নি করতে থাকে। মেজি জাপানে মাথাপিছু আয় তেমন বেশি ছিল না কিন্তু পরিভোগ কম ছিল, এজন্য পুঁজি গড়ে উঠেছিল। জাপানে অবাধ, মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল বলা যায় না, রাষ্ট্র ও সমাজের কথা ভেবে রাষ্ট্র অর্থনীতির বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে চলেছিল।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগে প্রচুর সরকারি ও বেসরকারি মূলধন লগ্নি করা হয়েছিল। রেলপথ ও জাহাজ পরিবহনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক মূলধন বিনিয়োগ করা হয়। জাপানের প্রথম রেলপথ টোকিও শহরকে ইয়াকোহামা বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। বেশিরভাগ রেলপথ বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়, তবে সরকার এগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার সতেরোটি রেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেছিল, ইম্পিরিয়াল জাপানিজ রেলওয়েজ কোম্পানি ৯০ শতাংশ রেল পরিবহন নিয়ন্ত্রণের অধিকার ভোগ করত। রেলপরিবহনের জন্য পণ্যের মাশুল কমেছিল, শ্রমিক শ্রেণীর গতিশীলতা বেড়েছিল। রেলপথে বহু প্রযুক্তিবিদ দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায়, সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা বেড়েছিল।
জাহাজ পরিবহনের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পুঁজির সহযোগিতা ছিল। মিৎসুবিশি জাইবাৎসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘নিপ্পন ইউসেন কাইসা’ (এন. ওয়াই. কে) হল সবচেয়ে বড়ো জাহাজ পরিবহন সংস্থা। ওসাকা জাহাজ মালিকরা সুমিতোমোর নেতৃত্বে গঠন করেছিল ‘ওসাকা শোসেনকাইসা’ (ও. এস. কে)। সরকার জাহাজ পরিবহনের ক্ষেত্রে উদারভাবে অনুদান দিয়েছিল। ১৮৮৩-১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জাপানের বাণিজ্য জাহাজের পরিবহন ক্ষমতা বেড়ে ৪৫,০০০ টন থেকে দাঁড়িয়েছিল ১.৫৭৭ মিলিয়ন টনে। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ লাইন বসিয়ে জাপান আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছিল, প্রথম মহাযুদ্ধের আগে চুরাশি হাজার ব্যক্তি এই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে আধুনিক যন্ত্রশিল্পের ভূমিকা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। নতুন আমলাতন্ত্র, স্থলবাহিনী, নৌবহর, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা, আধুনিক রেলপথ, জাহাজ পরিবহন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বহু লোকের কর্ম- সংস্থানের ব্যবস্থা করেছিল, নতুন পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। আধুনিক শিল্পের মধ্যে অগ্রাধিকার পেয়েছিল রেলপথ, বাণিজ্য জাহাজ ও খনি শিল্প। সুতো ও বস্ত্র, লোহা ও ইস্পাত এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প স্থাপনে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল কারণ এগুলি ছিল পুঁজি-নিবিড় শিল্প। জাপানে রাষ্ট্র ও পুঁজিপতিরা বাজারের চাহিদা ও জাতীয় স্বার্থকে মিলিয়ে অর্থনৈতিক বিকাশের কথা ভেবেছিল। এতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়নি বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। সুতি, সুতিবস্ত্র ও রেশম শিল্পের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও সংগঠন পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়।
শিবুসাবা আইচি হলেন জাপানের বস্ত্রশিল্পের প্রধান উদ্যোক্তা, তাঁর ওসাকা স্পিনিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই সাফল্য পেয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে বস্ত্ৰবয়ন ছিল প্রধান কুটিরশিল্প, এই সময়ে জাপানে পাওয়ার লুমের সংখ্যা হল মাত্র পঁচিশ হাজার। এসময়কার অন্যান্য হালকা শিল্প হল চিনি, মদ, মুদ্রণ, কাগজ ও কাঁচ। আধুনিক জাপানের ভারী শিল্প হল ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণ ও ইঞ্জিনিয়ারিং। জাতীয় প্রতিরক্ষার কথা ভেবে সরকার ইস্পাত শিল্প স্থাপনের দিকে নজর দিয়েছিল (Steel is the mother of industries and the foundation of national defence)। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ইয়াওয়াটা আয়রন ওয়ার্কস উৎপাদন শুরু করেছিল, সরকারি অর্থে এটি স্থাপিত হয়।
বেসরকারি উদ্যোগে সরকারি প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে স্থাপিত হয় নিপ্পন স্টিল পাইপ, ফুজি স্টিল ও কোবে স্টিল। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ কাজ করেছিল। ১৯০৫-১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পুঁজিপতিদের উদ্যোগে একাত্তরটি জাহাজ নির্মাণ করা সম্ভব হয়। অস্ত্র, রেল ইঞ্জিন ও টেলিফোনের মতো শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল, পুঁজি, প্রযুক্তি ও উদ্যোগের কোনো অভাব হয়নি। প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে জাপানি অর্থনীতি খানিকটা অসুবিধার মধ্যে পড়েছিল, ১৯১৪-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জাপানের অর্থনীতির ৪০ শতাংশ শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল, বার্ষিক উন্নতির হার হল ৯ শতাংশ। যুদ্ধের সময়ে আধুনিক শিল্প যথেষ্ট উন্নতি করেছিল, শিল্পোন্নয়নের স্বনির্ভর শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপিত হয় (The foundations had been laid for self-sustaining industrial growth) ।
জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে রাষ্ট্রের একটি বিশিষ্ট ভূমিকার কথা অনেকে উল্লেখ করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকাঠামো, যোগাযোগ ও পরিবহন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক হয়। শিল্পের সব বিভাগ উপকৃত হয়েছিল, তবে মেজি যুগে প্রথাগত শিল্প বেশি লাভবান হয়। আধুনিক যন্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান, শুল্ক সংরক্ষণ, প্রযুক্তিগত সাহায্য ও উৎপন্ন পণ্য ক্রয়ের মাধ্যমে ভারী শিল্পের প্রসারে রাষ্ট্র সহায়ক হয়। সরকারের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি (Fiscal Policy) অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল। সামরিক খাতে সরকার ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধি করে চলেছিল, এর ফলে আধুনিক যন্ত্রশিল্প গড়ে উঠতে পেরেছিল।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপানি অর্থনীতিবিদরা জার্মান হিস্টোরিক্যাল স্কুলের’ ওয়াগনার, স্টেইন ও ফ্রেডারিক লিস্টের তত্ত্ব অনুসরণ করে জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের পথ ধরেছিল। গোড়ার দিকে প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গঠিত শিল্প তেমন সফল হয়নি, পরে সরকারি উৎসাহে ও সহযোগিতায় যেসব বেসরকারি শিল্প স্থাপিত হয় সেগুলি সফল হয়। মেইজি জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকার মূল্যায়ন ছিল ইতিবাচক।