সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ
সাঁওতালরা ছিল কৃষক। সাঁওতাল বিদ্রোহের আদি নাম ছিল খেরওয়ার হুল। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ভাগে পূর্ব ভারতের কটক, ধলভূম, মানভূম, বরাভূম, পালামৌ, ছোটোনাগপুর, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বীরভূম থেকে সাঁওতালরা রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশে ভাগলপুর ও বীরভূম অঞ্চলে সাঁওতালরা বসতি স্থাপন করে। এই অঞ্চলের সাঁওতালি নাম হল দামিন-ই-কোহ (দামিন-ই-কোহ শব্দের অর্থ পাহাড়ের পাদদেশ)। এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকার ভূমি বন্দোবস্ত করেছিল, আশপাশে জমিদারি বন্দোবস্ত ছিল, এখানে ছিল ইজারাদারি ব্যবস্থা। এখানে ১৪৭৩টি গ্রাম ছিল যেগুলিতে বাস করত ৮২,৭৯৫ জন সাঁওতাল। এখানকার খাজনা ছিল মাত্র দু’হাজার টাকা, বিদ্রোহের আগে এখানকার খাজনা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৪৩,৯১৮ টাকা, অর্থাৎ বাড়ানো হয়েছিল ২২ গুণ। এই অঞ্চল পরবর্তীকালে সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ওপরে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা সকলে জানিয়েছেন যে, সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান কারণ হল অর্থনৈতিক। সাঁওতাল কৃষক প্রচণ্ড পরিশ্রম করে যে ফসল ফলাত মহাজনরা নানা কৌশলে তা আত্মসাৎ করে নিত। ঋণ নেবার সময় সাঁওতালদের চুক্তিতে ছাপ নেওয়া হত। এরপর তাদের দুধরনের শ্রম দিতে হত—কামিয়াতি ও হারওয়াহি। ঋণ নিলে ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত মহাজনের জমিতে তাকে কাজ করতে হত, আর দ্বিতীয় ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতাকে প্রয়োজনমতো শ্রম দিতে হত। বণিক ও মহাজনরা অশিক্ষিত সাঁওতালদের সরলতার সুযোগ নিত এবং ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করত।
সাঁওতালরা বিদেশি বণিক ও মহাজনদের বলত দিকু, এদের বেশিরভাগ ছিল বাঙালি ও উত্তর ভারতীয় ব্যবসাদার। কোনো পণ্য কেনার সময় তারা ভারী বাটখারা ব্যবহার করত, আবার পণ্য বিক্রির সময় তারা হালকা বাটখারার সাহায্য নিত। ঋণের দায়ে মহাজনরা সাঁওতালদের জমির ফসল, বলদ, মোষ এমনকি বাসনপত্রও জবরদস্তি করে কেড়ে নিয়ে যেত। অধ্যাপক কালীকিঙ্কর দত্ত জানিয়েছেন যে শস্য ব্যবসায়ীরা এই পণ্যের বেশিরভাগ বাংলাদেশে বিক্রি করে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল অর্থ সম্পদের অধিকারী হয়ে বসেছিল।
সাঁওতালরা মনে করত জমির জন্য খাজনা দেওয়া হল নীতিবিরুদ্ধ কাজ। জমি মেপে খাজনা ধার্যের যে পদ্ধতি সরকার চালু করেছিল তা সাঁওতাল কৃষকরা বাতিল করেছিল। তারা বলদ বা মোষের সংখ্যা অনুযায়ী খাজনা দিত, এটাই ছিল তাদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা। এই প্রথা ভারতের অন্যত্র একেবারে অপ্রচলিত ছিল না। বলদ প্রতি এক আনা এবং মোষ প্রতি দু আনা খাজনা দিতে তারা রাজি ছিল। জমিদার ও ইজারাদার নানা ছলছুতোয় তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করত।
জমিদার, নায়েব, গোমস্তা, মহাজন, ব্যবসাদার, সাজোয়াল, পুলিশ, আমলা, নিম্ন আদালত সকলে সাঁওতালদের বিরোধিতায় নেমেছিল। পুলিশ ও নিম্ন আদালতের কর্মচারীদের হস্তগত করে ব্যবসায়ী ও মহাজনরা সাঁওতালদের ওপর শোষণ চালাত। সরকারি প্রশাসন বা আদালত সব সময় শোষকের পক্ষ নিত। সাঁওতালরা ছিল ক্ষুব্ধ ও দিশাহারা, অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিকারের পথ তারা খুঁজে পায়নি।
![]() |
সিধু |
ব্রিটিশ সরকার এই সময় রেলপথ স্থাপনের কাজ করে চলেছিল, সাঁওতাল পরগনা থেকে কুলি সংগ্রহ করা হত। কুলিদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হত না, তাদের গ্রাম থেকে হাঁস, মুরগি, পাঁঠা, জোর করে বিনা পয়সায় নিয়ে যাওয়া হত। সাঁওতাল রমণীদের বেইজ্জতি করা হত। সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হূলের প্রতীক ছিল ।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই ভাগলপুর ও বীরভূমের দামিন-ই-কোর সাঁওতাল কৃষকরা অত্যাচারী মহেশ দারোগা ও তার সঙ্গীদের হত্যা করে সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু করেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার মধ্যে প্রধান ছিলেন সিধু ও কানু। সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক ছিল শাল গাছ । ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এটি হল এক বড়ো ঘটনা। অধ্যাপক বিনয় চৌধুরি, রণজিৎ গুহ ও স্টিফেন ফুক্স (Fuchs) এই বিদ্রোহের ওপর ধর্ম ও মনোজগতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিশেষ ভূমিকা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
![]() |
কানু |
বিনয় চৌধুরি মনে করেন সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ শুধু অর্থনৈতিক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। রণজিৎ গুহ ও স্টিফেন ফুক্স সাঁওতাল ধর্মচেতনার সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে এই ধর্মচেতনার বিস্তার ছাড়া সাঁওতালদের হুল (সাঁওতালি ভাষায় বিদ্রোহকে হুল বলা হয়) সম্ভব হত না। বিনয় চৌধুরি জানিয়েছেন সাঁওতাল বিদ্রোহে সাঁওতালদের মনোজগতের পরিবর্তন একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। বিদ্রোহের যৌথ সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র প্রভুশ্রেণি সম্পর্কে কৃষকদের নিরুদ্ধ আক্রোশের ফল নয়, তাদের নানা বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা প্রতিরোধের সংকল্পকে প্রভাবিত করেছিল। সাঁওতালদের পুরাণ, ঐতিহ্য, মিথ ও সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা এই মানসিকতা গঠনে সহায়ক হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল
সাঁওতালদের মানসিকতার পরিবর্তন স্থানীয় প্রশাসনকে বিস্মিত করেছিল। সরকারি এলাকা দামিন-ই-কো ও আশেপাশের জমিদারি এলাকায় তারা বসতি স্থাপন করেছিল। গোড়ার দিকে রাজস্বের ব্যাপারে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পেলেও পরে রাজস্বের হার ও পরিমাণ বেড়েছিল। সাঁওতালরা মনে করত জমির পরিমাণের ওপর রাজস্ব ধার্য হওয়া উচিত নয়। মোষ ও গোরুর লাঙলের সংখ্যার ওপর রাজস্ব ধার্য হওয়া উচিত।
রাজস্বের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমলাদের তদারকি বেড়েছিল। নতুন অঞ্চলে বসতি স্থাপনের জন্য মহাজনদের ওপর তারা নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রশাসনের ওপর সাঁওতালদের আস্থা কমতে থাকে কারণ প্রশাসন ও মহাজনদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। মহাজনি শোষণের তাৎপর্য শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, মহাজনের কাছে বিচিত্র ধরনের অধীনতার বেড়াজালে সাঁওতালরা ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছিল।
সাঁওতালদের প্রধান অভিযোগ হল তারা দেনার দায়ে শুধু সর্বস্বান্ত হয়নি, গোলামে পরিণত হয়েছে। তাদের সামাজিক মান-মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। তাদের মা, স্ত্রী ও বোনের ইজ্জত গেছে অথচ আদালতে এর কোনো প্রতিকার মেলেনি। সাঁওতালদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল ধারের জন্য সুদ আদায়ের প্রথা ন্যায়বিরোধী। সুদ আদায় যেহেতু ন্যায়ধর্ম বিরোধী ঋণ আদায়ের জন্য মহাজনদের ফন্দিফিকিরকে তারা প্রকাশ্য প্রবঞ্চনা বলে গণ্য করত। আদালত মহাজনের অভিযোগের ওপর নির্ভর করে একতরফা রায় দিয়ে দিত।
![]() |
সাঁওতাল বিদ্রোহ |
মহাজনরা সাঁওতালদের ইচ্ছেমতো খাটাত, ধার কখনও শোষ হত না, গোলামি (কামিয়াতি) থেকে মুক্তিও জুটত না। বংশানুক্রমে এই বাধ্যবাধকতা থেকে যেত। সাঁওতালরা মনে করত মহাজনের একাজ হল পাপ, ন্যায় বিরোধী বলেই পাপ। সাঁওতালদের এই ন্যায়ের ধারণা অলঙ্ঘনীয় কোনো বিশ্ববিধানের ধারণা, এ বিধান সকলের ক্ষেত্রে, সর্বত্র প্রযোজ্য। নৈতিক বিচারের সীমা অনির্দিষ্ট, মহাজন সম্পর্কে তিক্ততা যত বাড়ে নৈতিক বিচারের অস্পষ্টতাও বাড়ে। অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা ভুলে দিকু দুশমনদের সম্পূর্ণ বিনাশ তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস থেকে দামিন-ই-কোহ সাঁওতালরা মহাজনদের ওপর হামলা শুরু করে দিয়েছিল। প্রশাসন মহাজনদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের অভিযোগ দূর করার কোনো চেষ্টা করেনি। বরং ডাকাতির অভিযোগ এনে হামলাকারীদের গুরুতর সাজা দেওয়া হত। প্রশাসনের সহানুভূতিহীন আচরণ সাঁওতালদের গভীরভাবে বিক্ষুব্ধ করেছিল। সম্মিলিত প্রতিরোধের চিন্তা-ভাবনা তখন থেকে শুরু হয়েছিল, বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এর এক বছর পরে। মধ্যবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে দেখা দেয় বহু দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সংশয় ও বিকল্প পথের সন্ধান। এক প্রচণ্ড অস্থিরতা সমগ্র সাঁওতাল সমাজকে আলোড়িত করেছিল, নানা বিচিত্র ধরনের গুজব সাঁওতাল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে সাঁওতালরাজ স্থাপিত হবে, ন্যায় ধর্মের জয় এবং দিকু শোষণ শাসনের অবসান হল অনিবার্য পরিণতি। ব্রিটিশরাজের অবসান ঘটবে কিন্তু ক্ষমতা বিনাশের উপায় সম্পর্কে সাঁওতালদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। অস্পষ্টভাবে তারা ধরে নিয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল হবে ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠী নির্মূল । সাঁওতালদের সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কিত ধারণা কিছুটা স্ববিরোধী, একদিকে তারা বলেছে দিকুরা নিশ্চিহ্ন হবে, আসলে তারা চেয়েছিল দিকুদের কাজকর্মের ওপর সাঁওতালরাজের নিয়ন্ত্রণ। জমির খাজনার ন্যায়সংগত হার ঠিক করবে সাঁওতালরাজ। পুরোনো কায়দায় মহাজনি কারবার চলতে দেওয়া হবে না। সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে নতুন এক বিশ্বাসের জগৎ গড়ে উঠেছিল।
মূল্যায়ন
এক আদর্শ সাঁওতাল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য প্রচার চলেছিল। নেতারা সাঁওতাল পুরাণ, লোকগাথা ও সৃষ্টিতত্ত্বে ব্যবহৃত ভাষা ও প্রতীক ব্যবহার করেন। স শত্রুদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ কোনো বিচ্ছিন্ন আঞ্চলিক ঘটনা নয়। সাঁওতাল ধর্মগুরুরা অভিন্ন সাঁওতালি সত্তা সম্পর্কে বোধ ছড়িয়ে দেন। দৈব শক্তির হস্তক্ষেপ সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও সাঁওতালরা সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছিল, বাইরের শক্তির সাহায্য লাভের চেষ্টাও চালিয়েছিল। নিজেদের মধ্যে সংহতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়াস চালিয়েছিল। নতুন বোধ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল সমগ্র সাঁওতাল সমাজ। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল অনিবার্য।