ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।
ইতিহাস শব্দটির ব্যুৎপত্তি ‘ইতি হ আস’ অর্থাৎ অতীতে এরকমই ঘটেছিল। ইতিহাস শব্দটির উদ্ভব গ্রীক শব্দ ইস্তোরিয়া বা ‘istoria’ থেকে যার অর্থ অনুসন্ধান, অন্বেষণ ও তথ্য। কালানুক্রম মেনে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসরে পরীক্ষিত তথ্যের আলোকে যে অতীতকে ইতিহাস অনুসন্ধান ও অনুধাবন করে তা বস্তুতপক্ষে মানুষের ইতিহাস, মানব সভ্যতার ইতিহাস। বোঝাই যায় যে অতীত ও ইতিহাস এক নয়, ইতিহাস হল অতীতের চর্চা, তথ্য বা উপাদানের উপর ভিত্তি করে অতীতকে দেখা ও তাকে লেখার প্রক্রিয়াকে সাধারণভাবে ইতিহাসচর্চা বলা হয়। ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার মধ্যে পার্থক্য গভীর। নিকট বা সুদূর অতীতকে তুলে ধরার জন্য ইতিহাসচর্চা ও ইতিহাস রচনা শুরু হয়েছিল বহু প্রাচীন কাল থেকেই।
আদিমতম ইতিহাস বা ইতিহাস অনুরূপ রচনার নিদর্শন পাওয়া যায় ব্যালাড জাতীয় ঐতিহ্যবাহী গাথায়, ব্যাবিলনের গিলগামেশ, ভারতের রামায়ন, মহাভারতের মত মহাকাব্যে, মিশরীয়, হিটাইট, অসিরীয়, চৈনিক, ভারতীয় ইত্যাদি অঞ্চলের প্রাচীন শাসকদের উৎকীর্ণ বা লিপিবদ্ধ কাহিনী বা প্রশস্তিতে, ওল্ড টেস্টামেন্টের একাধিক গ্রন্থে ইতিহাসের মত এরূপ রচনার ধারাকে ইতিহাসবিদ আর জি কলিংউড আধা ইতিহাস (quasi-history) বা পৌরাণিক ইতিহাস নামে চিহ্নিত করেছেন কারণ সাধারণভাবে এই ধরণের রচনায় ইতিহাসচর্চার মূল দুটি গুরুত্বপূর্ণ শৈলী অতীতের অনুসন্ধান ও তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না।
![]() |
ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চা |
ইতিহাস হল উদাহরণ সহযোগে মানবদর্শনের পাঠ যেখানে বাস্তব জীবনের শিক্ষাকে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দেওয়া হয়। অতীতের স্মরণযোগ্য ঘটনাই ইতিহাসে স্থান লাভ করে অর্থাৎ সেই সকল ঘটনা যা অভিনব তাৎপর্যপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস এমন এনটি বিষয় যা মানুষকে বুদ্ধিমান করে তোলে, যে বুদ্ধির প্রয়োগে মানুষ খারাপ ও ভালোর মধ্যে প্রভেদ করতে পারে। অন্যদিকে, ইতিহাস চর্চা বাস্তবকে উন্মোচিত করে এবং তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করে যার মাধ্যমে মানবসভ্যতার সামারিক ছবিটি তুলে ধরা হয়।
ইতিহাসের জ্ঞান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কারণ ইতিহাসের মাধ্যমেই মানব সমাজ ও তার প্রতিষ্ঠানসমূহের অগ্রগতির ধারাকে অনুধাবন করা যায়। অন্যদিকে, ইতিহাসচর্চায় স্থান লাভ করে ধর্মনিরপেক্ষতা, যৌক্তিকতা ও প্রগতির ধারণা।
ইতিহাস হল অতীতের গল্প কাহিনী, অতীতে যা ঘটেছিল তা সম্পূর্ণই ইতিহাস। অন্যদিকে ইতিহাস চর্চা হলো অতীতে যা ঘটেছিল তার সত্যানুসন্ধান ব্যাখ্যা। অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছিল যার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি যা ইতিহাস চর্চার বিষয়বস্তু নয়।
ইতিহাস হলো একটি বিষয় যা মানব সভ্যতার ঘটনাগুলি তুলে ধরে। অন্যদিকে ইতিহাস চর্চা হলো এমন একটি কাজ যা ঐতিহাসিকরা করে থাকেন। ইতিহাস চর্চার বিষয়বস্তু হল সমগ্র ইতিহাস দর্শন। ইতিহাসের উপাদান নির্বাচন, উপাদান যাচাই করার পদ্ধতি, ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত মনন ইত্যাদি অনেক কিছুই ইতিহাসচর্চার বিষয়বস্তু। ঐতিহাসিকরা ততক্ষণ পর্যন্ত কোন ঐতিহাসিক ঘটনাকে ইতিহাস বলে বিবেচিত করতে পারেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই ঘটনার যুক্তিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। ইতিহাস এক হতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিকরা তাদের ইতিহাস চর্চায় ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়ে থাকেন। ফলে একই ইতিহাসের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হয়ে থাকে।
সুতরাং, ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও স্বাভাবিক ভাবেই এই দুই স্বতন্ত্র জ্ঞানচর্চার মধ্যে একটি নিবিঢ় যোগাযোগ বা সম্পর্ক স্থাপিত হয়।