তৃতীয় বিশ্ব কী। তৃতীয় বিশ্ব কাকে বলে।
Q – তৃতীয় বিশ্ব বলতে কী বোঝায় / তৃতীয় বিশ্ব কী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষা বা অভিধা হল তৃতীয় বিশ্ব বা ‘Third World’ – এই অভিধাটি রাজনৈতিক/ রাষ্ট্রনৈতিক, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ১৯৫২ সালে ফ্রান্সের জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ আলফ্রেদ সভে (Alfred Sauvy) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের (Tiers Monde ) ধারণাটি প্রচলন করেন এবং তৃতীয় বিশ্ব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।
সভে ফরাসী বিপ্লবকালে ‘Tiers Monde’র বা ‘Third Estate’ সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ‘Third World’ কে সম্পৃক্ত করেন এবং বলেন যে ফরাসী বিপ্লবের সময় যেমন থার্ড এস্টেট অনেক কিছু হতে চেয়েছিল তেমনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিও যুদ্ধোত্তরকালে অনেক কিছু পেতে চেয়েছিল। তাঁর মতে ফরাসী বিপ্লবের সময়কালীন তৃতীয় এস্টেটের ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মধ্যেও বৈপ্লবিক সম্ভাবনা যথেষ্ট মাত্রায় রয়েছে। সাভে আরও বলেন যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যেমন শিল্পোন্নত দেশগুলির সঙ্গে যুক্ত নয়, তেমনি সাম্যবাদী শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়।
১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং নগরে আফ্রো-এশিয় দেশগুলির সম্মেলনে একদল সমাজতত্ত্ববিদ ‘Le Tiers Monde’ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন, পরে ফরাসী অর্থনীতিবিদ ফ্রাঙ্কোয়েস পেরক্সও (Francois Perroux) অনুরূপ নামে একটি গ্রন্থ লেখেন ১৯৫০’র দশক থেকেই ফরাসী সংবাদ মাধ্যম এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলি সম্পর্কে তৃতীয় বিশ্ব অভিধাটি বহুল পরিমাণে ব্যবহার করতে থাকে।
তবে কেবল ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্তিকামী আন্দোলন গড়ে তুলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলির বাইরেও অনেকগুলি রাষ্ট্র ছিল যারা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের নিরিখে তৃতীয় বিশ্বভুক্ত দেশ রূপে পরিচিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো হলো ইরান, জর্ডন, তুরষ্ক, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশসমূহ, ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, কলম্বিয়া, প্রভৃতি লাতিন আমেরিকার দেশ, ইত্যাদি।
![]() |
তৃতীয় বিশ্ব বা ‘Third World’ |
তৃতীয় বিশ্বের সংজ্ঞাকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথা পন্ডিত মহলে অনেক ধরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে। ফ্রানজ ফ্যানন এর মতে তৃতীয় বিশ্ব বলতে বোঝায় সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী শিবিরের মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থিত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দেশগুলিকে ।
অন্যদিকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে আরভিও হরোটইজ দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে Third World বলতে বোঝায় সেই সকল দেশ যারা ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক – উভয়ের কোন মডেলেরই অর্থনীতি গ্রহণ না করে নিজস্ব পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক বিকাশের পথ বেছে নিয়েছে।
গণ প্রজাতান্ত্রিক চীনের প্রথম কর্ণধার তথা বিশ্বের অন্যতম অগ্রগণ্য কমিউনিস্ট নেতা মাও জে দণ্ডের মতে তৃতীয় বিশ্ব হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ানের নেতৃত্বে পরিচালিত দুই বৃহৎ শক্তিকে অনুসরণ না করে এশিয়া ও আফ্রিকার শোষিত দেশসমূহ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা।
এরিক হবসবম তার ‘Age of Extremes’ নামক গ্রন্থে তৃতীয় বিশ্বকে প্রথম বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে একদিকে যেমন প্রথম বিশ্বের দেশগগুলি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্থিতিশীল, তেমনই অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট ও সমস্যা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।