রাধারাণী গল্পের নাট্যরূপ। রাধারাণী গল্পের নাট্যরূপ প্রকল্প।
রাধারাণী
( প্রথম পরিচ্ছেদ )
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
চরিত্র গুলি
- রাধারাণী ( দশ এগারো বছরের এক বালিকা, [মূল চরিত্র] )।
- রাধারাণীর মা।
- রুক্মিণীকুমার রায় ( ভদ্রলোক )।
- পদ্মলোচন ( কাপড়ের দোকানদার )।
ভূমিকা:
রাধারাণী নামে এক বালিকা মাহেশে রথ দেখিতে গিয়াছিল। বালিকার বয়স একাদশ পরিপূর্ণ হয় নাই। তাহাদিগের অবস্থা পূর্বে ভাল ছিল- বড়মানুষের মেয়ে। কিন্তু তাহার পিতা নাই; তাহার মাতার সঙ্গে একজন জ্ঞাতির একটি মোকদ্দমা হয়; সর্বস্ব লইয়া মোকদ্দমা, মোকদ্দমাটি বিধবা হাইকোর্টে হারিল। সে হারিবামাত্র, ডিক্রীদের জ্ঞাতি ডিক্রী জারি করিয়া ভদ্রাসন হইতে উহাদিগকে বাহির করিয়া দিল। প্রায় দশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি; ডিক্রীদার সকলই লইল। খরচা ও ওয়াশিলাত দিতে নগদ যাহা ছিল, তাহাও গেল; রাধারাণীর মাতা, অলঙ্কারাদি বিক্রয় করিয়া, প্রিবি কৌন্সিলে একটি আপীল করিল। কিন্তু আর আহারের সংস্থান রহিল না। বিধবা একটি কুটীরে আশ্রয় লইয়া কোন প্রকারে শারীরিক পরিশ্রম করিয়া দিনপাত করিতে লাগিল । রাধারাণীর বিবাহ দিতে পারিল না।
রথের পূর্বে রাধারাণীর মা ঘোরতর পীড়িতা হইল-যে কায়িক পরিশ্রমে দিনপাত হইত, তাহা বন্ধ হইল। সুতরাং আর আহার চলে না। মাতা রুগ্না, এ জন্য কাজে কাজেই তাহার উপবাস; রাধারাণীর জুটিল না বলিয়া উপবাস। রথের দিন তাহার মা একটু বিশেষ হইল, পথ্যের প্রয়োজন হইল, কিন্তু পথ্য কোথা? কি দিবে?
![]() |
রাধারাণী |
রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে কতকগুলি বনফুল তুলিয়া তাহার মালা গাঁথিল। মনে করিল যে, এই মালা রথের হাটে বিক্রয় করিয়া দুই একটি পয়সা পাইব, তাহাতেই মার পথ্য হইবে।
কিন্তু রথের টান অর্ধেক হইতে না হইতেই বড় বৃষ্টি আরম্ভ হইল। বৃষ্টি দেখিয়া লোকসকল ভাঙ্গিয়া গেল। মালা কেহ কিনিল না। রাধারাণী মনে করিল যে, আমি একটু না হয় ভিজিলাম-বৃষ্টি থামিলেই আবার লোক জমিবে। কিন্তু আর বৃষ্টি থামিল না। লোক আর জমিল না। সন্ধ্যা হইল-রাত্রি হইল-বড় অন্ধকার হইল অগত্যা রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিল।
অন্ধকার-পথ কর্দমময়, পিচ্ছিল- কিছুই দেখা যায় না। তাহাতে মুষলধারে শ্রাবণের ধারা বর্ষিতেছিল। মাতার অন্নাভাব মনে করিয়া তদপেক্ষাও রাধারাণীর চক্ষুঃ বারি বর্ষণ করিতেছিল। রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড় খাইতেছিল- কাঁদিতে কাঁদিতে উঠিতেছিল। আবার কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড় খাইতেছিল। তথাপি রাধারাণী সেই এক পয়সার বনফুলের মালা বুকে করিয়া রাখিয়াছিল-ফেলে নাই।
এমত সময়, অন্ধকারে, অকস্মাৎ কে আসিয়া রাধারাণীর ঘাড়ের উপর পড়িল। রাধারাণী এতক্ষণ উচ্চৈস্বরে ডাকিয়া কাঁদে নাই-এক্ষণে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিল।
দৃশ্য – ১
রুক্মিণীকুমার : (যে রাধারাণীর ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছিল, সে বলিল,) কে গা তুমি কাঁদ ?
[ পুরুষ মানুষের গলা- কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনিয়া রাধারাণীর রোদন বন্ধ হইল। রাধারাণীর চেনা লোক নহে কিন্তু বড় দয়ালু লোকের কথা-রাধারাণীর ক্ষুদ্র বুদ্ধিটুকুতে ইহা বুঝিতে পারিল।]
রাধারাণী : (রোদন বন্ধ করিয়া ) আমি দুঃখিলোকের মেয়ে। আমার কেহ নাই কেবল মা আছে।
রুক্মিণীকুমার : তুমি কোথা গিয়াছিলে ?
রাধারাণী : আমি রথ দেখিতে গিয়াছিলাম। বাড়ী যাইব। অন্ধকারে বৃষ্টিতে পথ পাইতেছি না।
রুক্মিণীকুমার : তোমার বাড়ী কোথায়?
রাধারাণী : শ্রীরামপুর।
রুক্মিণীকুমার : আমার সঙ্গে আইস আমিও শ্রীরামপুর যাইব। চল, কোন্ – পাড়ায় তোমার বাড়ী—তাহা আমাকে বলিয়া দিও-আমি তোমাকে বাড়ী রাখিয়া আসিতেছি। বড় পিছল, তুমি আমার হাত ধর, নহিলে পড়িয়া যাইবে !
[ এইরূপে সে রাধারাণীকে লইয়া চলিল। অন্ধকারে সে রাধারাণীর বয়স অনুমান করিতে পারে নাই, কিন্তু কথার স্বরে বুঝিয়াছিল যে, রাধারাণী বড় বালিকা। এখন রাধারাণী তাহার হাত ধরায় হস্তস্পর্শে জানিল, রাধারাণী বড় বালিকা।]
রুক্মিণীকুমার : তোমার বয়স কত ?
রাধারাণী : দশ এগারো বছর।
রুক্মিণীকুমার : তোমার নাম কি ?
রাধারাণী : ( তার নাম বলিল ) রাধারাণী।
রুক্মিণীকুমার : তুমি ছেলেমানুষ, একেলা রথ দেখিতে গিয়াছিলে কেন ?
[ তখন সে কথায় কথায়, মিষ্ট মিষ্ট কথাগুলি বলিয়া, সেই এক পয়সার বনফুলের মালার সকল কথাই বাহির করিয়া লইল। শুনিল যে, মাতার পথ্যের জন্য বালিকা এই মালা গাঁথিয়া রথহাটে বেচিতে গিয়াছিল-রথ দেখিতে যায় নাই- সে মালাও বিক্রয় হয় নাই-এক্ষণেও বালিকার হৃদয়মধ্যে লুক্কায়িত আছে। ]
রুক্মিণীকুমার : আমি একছড়া মালা খুঁজিতেছিলাম। আমাদের বাড়ীতে ঠাকুর আছেন, তাঁহাকে পরাইব। রথের হাট শীঘ্র ভাঙ্গিয়া গেল—আমি তাই মালা কিনিতে পারি নাই। তুমি মালা বেচ ত আমি কিনি। ইহার দাম চারি পয়সা-এই লও ! (এই বলিয়া রুক্মিণীকুমার মূল্য দিল)।
[ রাধারাণীর আনন্দ হইল, কিন্তু মনে ভাবিল যে, আমাকে যে এত যত্ন করিয়া হাত ধরিয়া, এ অন্ধকারে বাড়ী লইয়া যাইতেছে, তাহার কাছে দাম লইব কি প্রকারে? তা নহিলে, আমার মা খেতে পাবে না। তা নিই। এই ভাবিয়া রাধারাণী, মালা রুক্মিণীকুমারকে দিল। ]
রাধারাণী : এ কি পয়সা? এ যে বড় বড় ঠেকছে। ডবল পয়সা দেখিতেছ না দুইটা বই দিই নাই । এ যে অন্ধকারেও চকচক করচে। তুমি ভুলে টাকা দাও নাই ত?
রুক্মিণীকুমার : না। নূতন কলের পয়সা, তাই চকচক করছে।
দৃশ্য – ২
[ কিছু পরে তাহারা রাধারাণীর মার কুটীরদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া ]
রাধারাণী : তুমি ঘরে আসিয়া দাঁড়াও, আমরা আলো জ্বালিয়া দেখি, টাকা না পয়সা।
রুক্মিণীকুমার : আমি বাহিরে দাঁড়াইয়া আছি। তুমি আগে ভিজা কাপড় ছাড়- তার পর প্রদীপ জ্বালিও ।
রাধারাণী : আমার আর কাপড় নাই- একখানি ছিল, তাহা কাচিতে দিয়াছি। তা, আমি ভিজা কাপড়ে সর্বদা থাকি, আমার ব্যামো হয় না। আঁচলটা নিঙড়ে পরিব এখন। তুমি দাঁড়াও, আমি আলো জ্বালি।
রুক্মিণীকুমার : আচ্ছা।
[ ঘরে তৈল ছিল না, সুতরাং চালের খড় পাড়িয়া চকমকি ঠুকিয়া, আগুল জ্বালিতে হইল। আগুন জ্বালিতে কাজে কাজেই একটু বিলম্ব হইল। আলো জ্বালিয়া রাধারাণী দেখিল, টাকা বটে, পয়সা নহে। তখন রাধারাণী বাহিরে আসিয়া আলো ধরিয়া দেখিল যে, যে টাকা দিয়াছে, সে নাই চলিয়া গিয়াছে। রাধারাণী তখন বিষণ্ণবদনে সকল কথা তাহার মাকে বলিয়া, মুখপানে চাহিয়া রহিল। ]
রাধারাণী : (সকাতরে) মা ! এখন কি হবে?”
রাধারাণীর মা : কি হবে বাছা ! সে কি আর না জেনে টাকা দিয়েছে? সে দাতা, আমাদের দুঃখ শুনিয়া দান করিয়াছে-আমরাও ভিখারী হইয়াছি, দান গ্রহণ করিয়া খরচ করি।
[ তাহারা এইরূপ কথাবার্তা কহিতেছিল, এমত সময়ে কে আসিয়া তাহাদের কুটীরের আগড় ঠেলিয়া বড় সোরগোল উপস্থিত করিল। রাধারাণী দ্বার খুলিয়া দিল—মনে করিয়াছিল যে, সেই তিনিই বুঝি আবার ফিরিয়া আসিয়াছেন। পোড়া কপাল! তিনি কেন? পোড়ারমুখো, কাপুড়ে মিসে]
দৃশ্য – ৩
[রাধারাণীর মার কুটীর বাজারের অনতিদূরে। তাহাদের কুটীরের নিকটেই পদ্মলোচন শাহার কাপড়ের দোকান। পদ্মলোচন খোদ, পোড়ারমুখো কাপুড়ে মিন্ সে–একজোড়া নূতন কুঞ্জদার শান্তিপুরে কাপড় হাতে করিয়া আনিয়াছিল, এখন দ্বার খোলা পাইয়া তাহা রাধারাণীকে দিল। ]
পদ্মলোচন : রাধারাণীর এই কাপড়।
রাধারাণী : ওমা ! আমার কিসের কাপড় !
পদ্মলোচন : (বিস্মিত হয়ে) কেন, এই যে এক বাবু এখনই আমাকে নগদ দাম দিয়া বলিয়া গেল যে, এই কাপড় এখনই ঐ রাধারাণীকে দিয়া এস ।
রাধারাণী : ওমা সেই গো! সেই। তিনিই কাপড় কিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পদ্মলোচন : তোমরা চেন না ?
রাধারাণী : না।
পদ্মলোচন : আমি বলি তোমাদের কুটুম্ব। আমি চিনি না।
[ রাধারাণী, প্রাপ্ত টাকা ভাঙ্গাইয়া মার পথ্যের উদ্যোগের জন্য বাজারে গেল। বাজার করিয়া, তৈল আনিয়া প্রদীপ জ্বালিল। মার জন্য যৎকিঞ্চিৎ রন্ধন করিল। স্থান পরিষ্কার করিয়া মাকে অন্ন দিবে, এই অভিপ্রায়ে ঘর ঝাঁটাইতে লাগিল। ঝাঁটাইতে একখানা কাগজ কুড়াইয়া পাইল হাতে করিয়া তুলিল-“এ কি মা!” ]
রাধারাণীর মা : একখানা নোট !
রাধারাণী : তবে তিনি ফেলিয়া গিয়াছেন।
রাধারাণীর মা : হ্যাঁ তোমাকে দিয়া গিয়াছেন। দেখ, তোমার নাম লেখা আছে।
[ রাধারাণী বড়ঘরের মেয়ে, একটু অক্ষরপরিচয় ছিল। সে পড়িয়া দেখিল, তাই বটে। লেখা আছে। ]
রাধারাণী : মা, এমন লোক কে মা !
রাধারাণীর মা : তাহার নামও নোটে লেখা আছে। পাছে কেহ চোরা নোট বলে, এই জন্য নাম লিখিয়া দিয়া গিয়াছেন। তাঁহার নাম রুক্মিণীকুমার রায়।
[ পরদিন মাতায় কন্যায়, রুক্মিণীকুমার রায়ের অনেক সন্ধান করিল। কিন্তু শ্রীরামপুরে বা নিকটবর্তী কোন স্থানে রুক্মিণীকুমার রায় কেহ আছে, এমত কোন সন্ধান পাইল না। নোটখানি তাহারা ভাঙ্গাইল না- তুলিয়া রাখিল- তাহারা দরিদ্র, কিন্তু লোভী নহে। ]