দ্বাদশ শতকের নবজাগরণের ( রেনেসাঁস ) প্রেক্ষাপট বা পটভূমি।
রেনেসাঁস শব্দের অর্থ নবজাগরণ। তবে রেনেসাঁস বলতে সাধারণ ভাবে চতুর্দশ শতকের শিক্ষণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে পুনর্জাগরণ ঘটেছিল তাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। অনেক ঐতিহাসিক এর মতে চতুর্দশ শতকের এই নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটেছিল দ্বাদশ শতকে।
![]() |
দ্বাদশ শতকের রেনেসাঁস |
মধ্যযুগে শার্লমানের আমলে দেখা গিয়েছিল ক্যারোলিঞ্জীয় রেনেসাঁস এবং দশম শতকে দেখা গিয়েছিল অটো নিয়ান রেনেসাঁস। দ্বাদশ শতকের শুরুতে লাতিন ইউরোপের রাজনীতিতে নৈরাজ্য দেখা দিলেও শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় মনীষীর মুক্তি কামনা এ সময়েই আরম্ভ হয়েছিল। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খ্রিস্টান জগতের সর্বত্র ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, জার্মানি এবং স্পেনে যে মুক্ত মনের পদ ধ্বনি ধ্বনিত হয়েছিল তা প্রতিফলিত হয় সাহিত্য দর্শন এবং ধর্ম শাস্ত্রে।
ঐতিহাসিক টমসন ও জনসনের মতে দ্বাদশ শতকে পশ্চিম ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা নতুন সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। ইউরোপীয় মনীষীর আত্মপ্রকাশ পূর্ণতর হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদী ভাবধারার সঙ্গে আরব ইহুদি প্রভাব এবং প্রাচ্যের সভ্যতার ভাব সম্মেলন এর ফলে। এই নতুন চিন্তা ও ভাব সম্মিলন সম্ভব হয়েছিল ইউরোপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদার এবং মুক্ত আবহাওয়ার জন্য। ফ্রান্সের ক্যাথিড্রাল সংলগ্ন বিদ্যালয় গুলিতে শত্রের, লিয়ঁ,অলিয়ঁ এবং প্যারীতে শিক্ষার্থীরা সংস্কার মুক্ত হয়ে উদারতার সঙ্গে নতুন ভাব ধারা গ্রহণ এবং তার ভিত্তিতে পুরাতনের নব মূল্যায়নে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
শহরাঞ্চলে নতুন সমাজ ও সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ধর্মীয় উদারতার সৃষ্টি করেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে নতুন বণিক শ্রেণীর যেমন সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি এই নব্য বণিক শ্রেণীর মারফৎ অন্যান্য দেশের সভ্যতা সংস্কৃতিও পশ্চিম ইউরোপে এসে পৌঁছায়। পুরাতন সমাজের অভিজাত ও গির্জার কর্মীরা শিক্ষার সমর্থকে পরিণত হয়। কোন কোন রাজসভায় বিদ্যোৎসাহী শাসকের পৃষ্ঠপোষকতাও এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের সাংস্কৃতিক স্ফূরণ প্রথম শুরু হয় ক্যারোলিঞ্জীয় রেনেসাঁসতে। নবম শতকের বর্বর আক্রমণে ইতিপূর্বের প্রাচীন মূল্যবান গ্রন্থাদির পান্ডুলিপি, দুর্লভ, পুঁথিগুলির অনেক নষ্ট হয়ে গেলেও সুরক্ষিত হয়েছিল বেশ কিছু। আর ইতিমধ্যে ক্যারোলিঞ্জীয় ‘ মিনিসকল’ এ সামান্য কিছু হেরফের সত্বেও প্রায় সমস্ত খ্রিস্টান জগতে গৃহীত হওয়ায় তা দ্বাদশ শতকের বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছিল।
জার্মান ঐতিহাসিক ফ্রিডরীশ হিয়ার দ্বাদশ শতাব্দীতে ব্যবহৃত লাতিন ভাষায় ব্যবহৃত এক অদ্ভুত পূর্ব উদারতা এবং মুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। যে ভাষা এতদিন গম্ভীর পাণ্ডিত্যের অবলম্বন হয়ে সীমিত পরিসরে সংকীর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে টিকে ছিল তা ক্রমশ প্রাণবন্ত ও নমনীয় হয়ে উঠেছিল। ত্রয়োদশ শতকের ‘স্কলমেন’রা লাতিনের এই প্রয়োগকে অযৌক্তিক অসচ্ছ ও অবৈজ্ঞানিক বলে নিন্দা করলেও দ্বাদশ শতকীয় মনীষীর পার্থিব ও অপার্থিব আধ্যানতিক এবং ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়গুলির বিকাশে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করেছিল।
একাদশ শতকে স্পেনে খ্রিস্টানদের অনুপ্রবেশের ফলে পশ্চিম ইউরোপ আরবিয় সংস্কৃতি সংস্পর্শে আসে। ক্লুনির ধর্ম সংস্কার আন্দোলন এবং ধর্মযুদ্ধের ঘটনা পশ্চিম ইউরোপের বৌদ্ধিক সীমা সম্প্রসারিত করেছিল। নর্মানদের ইংল্যান্ড আক্রমণ, সিসিলি ও দক্ষিণ ইতালিতে নর্মান অধিকার স্থাপন ইউরোপের সংস্কৃতিকে উন্নত এবং সমৃদ্ধ করেছিল। শিক্ষিত আইনবিদদেরও প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। ধর্মীয় আলোচনা চিকিৎসা শাস্ত্র এবং রোমান আইন চর্চা ও শুরু হয়ে যায়।
একাদশ শতকের যুক্তি নির্ভরতা, ডায়ালেটিক্সের ব্যবহার, সাইলোজেস্টিক লজিক এর ব্যবহার দ্বাদশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবিত করে। পূর্ণ মুদ্রণ দ্বাদশ শতকের নবজাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। একাদশ শতকের যে সমস্ত ব্যক্তির লেখা বা অনুবাদ দ্বাদশ শতকে পূর্ণ মুদ্রিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রধান হলেন অ্যারিস্টোটল। গাবার্ড ছিলেন দ্বাদশ শতকের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। যুক্তিনির্ভরতা ছিল দ্বাদশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। কুলবাট শিষ্য ব্যারেঞ্জার ঘোষণা করেন যে, কতিত্ব ও প্রযুক্তির মধ্যে সংঘাত বাধলে যুক্তিকেই অনুসরণ করা উচিত। এ সময় সত্যানুসন্ধান গড়ে ওঠার ফলে মুক্তির বেগ লেগেছিল। ইউরোপের জীবনে যুক্তিবাদকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এ সময়ের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কাছে চিরাচরিত ধ্যান-ধারণা বর্জন তাদের দ্বিতীয় ধর্ম হয়ে ওঠে। ধর্মের মহিমাকে আর কেউই সত্যের মহিমার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে রাজি ছিলেন না।