শশাঙ্ককে কি বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা বলা যুক্তিযুক্ত
শশাঙ্ক ছিলেন বঙ্গ অঞ্চলের একীভূত রাষ্ট্রের প্রথম স্বাধীন রাজা। তিনি বাংলায় প্রথম আলাদা রাজনৈতিক সত্তা তৈরি করেন। বাংলার প্রথম সার্বভৌম শাসক ছিলেন শশাঙ্ক। আর্যাবর্তে বাঙালির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা ব্যক্তির নাম রাজাধিরাজ শশাঙ্ক। ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলায় রাজত্ব করেন বলে জানা যায়।
![]() |
শশাঙ্ক |
শশাঙ্ক সম্ভবত ৬০৬ খ্রিঃ সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসার পর উত্তর ও পশ্চিম বাংলার কিছু অংশ তিনি গৌড়ের অন্তভূক্ত করেন। গৌড়ে তাঁর অধিকার স্থাপন করে প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজ্যবিস্তার শুরু করেন। তিনি দন্ডভুক্তি (মেদিনীভুক্ত) রাজ্য, উড়িষ্যার রাজ্য এবং বিহারের মগধ রাজ্য জয় করে তার রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন।
শশাঙ্ক গৌড় জয় করার পর তাঁর রাজধানী হয় কর্ণসুবর্ণ। অনেক ঐতিহাসিক এবং ভাষ্যকার মনে করতেন যে, শশাঙ্ক কেবল গৌড় নয়, তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা । উত্তর এবং পশ্চিম বঙ্গ তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি ধর্মপাল ও দেবপালার মতো পরবর্তী পাল শাসকদের আগ্রাসী উত্তর ভারতীয় নীতির অগ্রদূত ছিলেন।
মহাসেনগুপ্তের মৃত্যুর পরে শশাঙ্ক গৌড়রের রাজা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি তাঁর বিজয় উদযাপনের জন্য সোনার মুদ্রা জারি করেছিলেন এবং মহারাজধিরাজ হিসাবে পরিচিত হন । রাজধানী কর্ণসুবর্ণ তাঁল আমলে সম্পদময়ী হয়ে ওঠেছিল। তিনি গৌড়দেশের মর্যাদা গঠনের আয়োজনও করেন। মেদিনীপুরের দাঁতন বা দন্ডভুক্তি অঞ্চলে দিঘী জলসেচ ব্যবস্থা জন্য তা প্রচেষ্টার সাক্ষ্য দেন।
শশাঙ্ক ছিলেন স্বাধীনতা গৌড় সাম্রাজ্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী উত্তর ভারতীয় প্রতিপক্ষ,সুতরাং তাঁকে বাংলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজা হিসাবে দেখা যেতে পারে, যিনি প্রথমবারের মতো উত্তর ভারতের নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য রাজ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নিয়ে আসেন।
জয়রামপুরের তাম্রশাসনের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন, শশাঙ্কের আগে যে স্বাধীন বঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার ভিত্তির ওপর তিনি বাঙালি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, শশাঙ্কই প্রথম আর্যাবতে বাঙালির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন এবং তা আংশিকভাবে কার্যে পরিণত করেন। তাঁর সময়ে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ-মালদহ মুর্শিদাবাদ থেকে আরম্ভ করে একেবারে উৎকল পর্যন্ত সর্বপ্রথম এক রাষ্ট্রীয় ঐক্য লাভ করে। তিনিই সর্বপ্রথম একটি মাত্র নাম নিয়ে প্রাচীন বাংলার জনপথগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ফলে সপ্তম শতকেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ নিজস্ব রাষ্ট্র লাভ করে এবং নিজস্ব শাসনতন্ত্র গড়ে তোলে।
কনৌজ-উজ্জয়িনী-প্রয়াগ-বারানসি কেন্দ্রিক মধ্য ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত স্বতন্ত্র সার্বভৌম বাঙালি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, এর নায়ক ছিলেন শশাঙ্ক। তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুল কেশীর মতো সকলোত্তরপথনাথ হর্ষবর্ধনকে সার্থক প্রতিরোধ করে বাঙালি সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব অটুট রাখেন।
বাঙালির জাতীয় নায়ক মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক ৬৩৭-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে কুষ্ঠ জাতীয় কোনো এক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আর বাংলার এই খ্যাতিমান নৃপতির মৃত্যুর পর পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসে গৌড়তন্ত্র বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ইতিহাসে এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। শুরু হয় মাৎস্যন্যায়ের শত বৎসর।
মূল্যায়ন :
রাজ্য বিস্তারের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে শশাঙ্ক প্রাকৃতিক সীমা লাভের চেষ্টা করেন। এবং মগধ প্রথম থেকেই তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই শশাঙ্ককে বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা বলা যুক্তিযুক্ত।