ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান।
1485 খ্রিস্টাব্দে আইলেবেনের এক ধনী পরিবারে মার্টিন লুথারের জন্ম হয়। অল্প বয়সেই অ্যারিস্টটলীয় পাঠক্রমে 1502 খ্রিস্টাব্দে স্নাতক হন। এবং 1505 এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পিতার উপদেশে এরপর লুথার আইন পড়াশোনা করেন। 1512 সালে তিনি উইটেন বাগ বিশ্ববিদ্যালয় পবিত্র ধর্মগ্রন্থের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। শিক্ষকতার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব। ও আত্মসমর্পণ এর বিষয়টি তার মনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠ। এভাবে লুথার যে ধর্মতত্ত্বকে সৃষ্টি ও প্রচার করেন তা প্রচলিত ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্বের ভিতকে প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছিল যার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মসংস্কার আন্দোলন। আর ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
লুথারের ধর্মতত্ত্বের তিনটি মূল সূত্র ছিল –
- Sold-fida বা কেবলমাত্র বিশ্বাস,
- sola scriptural বা কেবলমাত্র পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এবং
- sola gratia বা কেবলমাত্র দয়া কৃপা ইত্যাদি সৎ গুন।
এই তিনটি সূত্রের মাধ্যমেই ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা যায় বলে তিনি মনে করতেন।
চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই রোমাঞ্চ চার্চের চরিত্র ছিল রাজবংশীয়, যাজকীয় এবং ধর্মানুষ্ঠানমূলক। বিশ্বজনীন চার্চ যেমন কোন নৈতিক ভুল করতেন না। তেমন পোপের নির্দেশ ও অভ্রান্ত বলে মনে হয়েছিল। ব্যাপটিজম, ইউক্যারিস্ট, প্রায়শ্চিত্য, বিবাহ এবং চূড়ান্ত তোষামাতের মাধ্যমেই চার্জ ও ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের একমাত্র পথ বলে মানুষ পরিচালিত হতে থাকে। যাজকরা নাকি অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে মাস উৎসবে খ্রিস্টের দেহ ও রক্তে কেক ও সুরা প্রবেশ করিয়ে মানুষকে মুক্ত করতে পারতেন। ফলে লুথারের মতামত প্রচলিত ক্যাথলিক ধর্মের বিরোধী ছিল।
![]() |
Martin Luther |
এই পরিস্থিতিতে টেটজেল ইনডালজেন্স বিক্রির উদ্দেশ্যে উইটেন বার্গে এসেছিলেন। এই ইনডালজেন্স গুলির মাধ্যমে পোপ যিশুখ্রিস্ট ও অন্যান্য কতৃক সঞ্চিত অন্য ভান্ডার থেকে পুনঃ জীবিত বা মৃত উভয় শ্রেণীর মানুষের কাছে বিক্রি করতে পারতেন। বলাবাহুল্য মানুষের প্রায়শ্চিত্তের ওপর পোপের এই নিয়ন্ত্রণ অধিকার লুথারের পক্ষে মানা সম্ভব ছিল না।
তিনি 1517 এর অক্টোবরে উইটেনবার্গের দরজায় ইনডালজেন্স বিরোধী “Ninety-five Theses” (95 থিসিস) টাঙিয়ে দেন। এই সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে তিনি যেকোনো ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ববিদদের সঙ্গে তার মতামত নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। পোপ দশম লিও এই 95 টি বিধানকে এক বিদ্রোহী সন্ন্যাসীর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরলেও লুথার কে তলব করাকেই বিচক্ষণ বলে মনে করেন। স্যাসনির ডিউক ফ্রেডারিক দি ওয়াসিস মার্টিন লুথার কে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন।
![]() |
Ninety-five Theses |
1520 খ্রিস্টাব্দে অবশ্য লুথার তার তিনটি বিপ্লবাত্মক রচনার মাধ্যমে ধর্মসংস্কার আন্দোলনে পথ বাড়ান।
- এড্রেস টু দ্য ক্রিস্টিয়ান নবিলিটি অফ দা নেশন, তে জার্মান রাজাদের রোমের চার্চের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
- the Babylonian captivity of the church তে পোপ তার ধর্মসংস্থান মূলক বুজরুকি আক্রান্ত হয় এবং
- the liberty of a Christian man এ লুথার তার justification of faith এ তত্বকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করেন।
জার্মান ভাষায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলিতে লুথার চার্চের নৈতিক অধ্যায় বাহিক আচার অনুষ্ঠান।
চার্চের আড়ম্ভর বৈভবকে নস্যাৎ করে কার্যত আধ্যানিক জগতের ওপর পোপের অভ্রান্ত তাতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। এক কথায় তিনি the detebtable tyrranny of the laity clarify over এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। লুথার এমন এক অভিন্ন পুরোহিত তন্ত্রের কথা বলে সেখানে সকল খ্রিস্টান একই ধর্মের দীক্ষায় দীক্ষিত, সবাই একই গসপেলে বিশ্বাসী এবং একই আধান্তিক জগতে সকলে পুরোহিত। সেখানে ঈশ্বর প্রদত্ত বিশ্বাস ও সৎ গুণ কোন মাধ্যম ছাড়াই মানুষের কাছে আসে। ধর্মগ্রন্থ পড়েই মানুষ তা জানতে পারে।
সম্রাট চার্লস লুথার কে কেন শাস্তি বিধান করতে পারেননি কারণ লুথারের মতবাদ কে কেন্দ্র করে জার্মান রাজনীতিতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। ফ্রেডারিক দ্য ওয়াইসের গোপন বন্দিশালায় লুথার আশ্রয় নিয়ে লুথার বাইবেলকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। 1522 এর মধ্যে নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম প্রকাশনা আবির্ভাব হয় এবং 1534 এর মধ্যে সমস্ত বইটি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক ব্যারি ডবসনের মতে, এর ফলে জার্মান ভাষা ও সাহিত্যের পথ যে মন প্রশস্ত হয়েছিল তেমনি জার্মানিতে লুথারীও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন আধ্যান্তিক ও বৌধিক দিক দিয়ে যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছিল। লুথার ও তার সহকারী অধ্যাপক মেলাঙ্কথন ও তার সহযোগিতারা স্যাক্সনিতে ক্যাথলিক বিরোধী এক বিকল্প চার্ট গড়ে তোলেন। স্যাক্সনির অনুসরণে আলব্রএথ, ও শ্লেজভিগ ডিউক, ব্রান্ডেনবাগ, লুথারীও ধর্মের অনুগামী হন। এই অঞ্চলে ক্যাথলিক ধর্মের জমি ও সম্পত্তি অধিকার করে, লুথারীও প্রোটেস্ট্যান্ট চাচ প্রতিষ্ঠা করা হয়। লুথারদের মৃত্যুর আগেই কলন, মিউনিখ ও রেজেস বাগ ছাড়া সকল জার্মান শহরই লুথারীয় ধর্মাবেগের কাছে নতি স্বীকার করে।
এমন নয় যে সমস্ত জার্মান রাজ্যই লুথারীয় ধর্মমতের সমর্থক হয়ে উঠেছিল। ক্যাথলিক জার্মান রাজ্যগুলির অস্তিত্বও ছিল। এবং 1529 এ তারাই লুথারীয় ধর্মমতের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। 1530 এ প্রোটেস্টান্ট রাজ্য গোষ্ঠী জার্মানিতে পুনরায় ধর্মীয় ঐক্য স্থাপনের জন্য সম্রাট পঞ্চম চার্লসের কাছে স্বীকারোক্তি পাঠালেও তা খারিজ করা হয়। শুধু তাই নয় জার্মান সম্রাট পঞ্চম চার্লস স্মল ক্যালডিগ জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি নেন। 1547 এর এপ্রিলে চার্লসের সাম্রাজীক বাহিনী লীগের বাহিনীকে পরাজিত করেন।
ব্রাইস এবং গ্রাফটন দেখেছেন যে অদ্ভুত সব স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে জার্মান সাম্রাজ্যের আঞ্চলিক শাসকরা এক একটি ধর্মমতের পক্ষ নিয়ে ছিলেন। এমনিতেই ক্যাথলিক চার্চ আঞ্চলিক শাসকদের অর্থনৈতিক শাসকদের বহুদিন ধরে ক্ষুন্ন করেছিল।
লুথার ক্যাথলিক চার্চের সম্পত্তি ও মঠগুলি কে ধর্মনিরপেক্ষ রাজ্য কর্তৃক অধিগ্রহণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত: চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই জার্মান শাসকরা ধর্মীয় পদ লাভে ইচ্ছুক ছিলেন। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম গ্রহণ করে ক্যাথলিকদের ক্ষমতা উচ্ছেদ করে অনেক জার্মান শাসকই তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন। ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকরা রিফর্মেশনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছিলেন। অনেকেই প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের বিরুদ্ধাচারণ করে ক্যাথলিক চার্চ এর কাছে থেকে দাবি-দাওয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়ে নিজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মূল্যায়ন
লুথার মারা গিয়েছিলেন 1546 খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তার মৃত্যুর অনেক আগেই জার্মানিতে তার মতবাদের প্রভাব ও প্রক্রিয়া ভীষণভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। 1520 খ্রিস্টাব্দে 10ই ডিসেম্বর লুথার কে মঠ থেকে বহিষ্কারের নির্দেশনামা পুড়িয়ে ফেলা হয়। পোপ জার্মান সম্রাট পঞ্চম চালাস কে বহিষ্কারের জন্য নির্দেশ দিলেও বিচক্ষণ সম্রাট লুথার কে ওয়ামসের ডায়েটে আলোচনার জন্য আহ্বান জানান। বলাবাহুল্য এই ডায়েটেই সম্রাট ও লুথারের মত পার্থক্য প্রকট হয়ে যায়, তার সত্ত্বেও বলা যায় যে, ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান অনস্বীকার্য।