উনবিংশ শতকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ব্যাখ্যা কর / পর্যালোচনা কর।
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির স্পর্শে উনিশ শতকের চিন্তার জগতে যে আলোড়ন ঘটেছিল তার ফলে ভারতের বিভিন্ন ভাষা সাহিত্যের এক নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য ইংরেজরা বাংলায় তাদের প্রথম সাম্রাজ্য স্থাপন করায় বাংলা সাহিত্যেই প্রথম জোয়ার এসেছিল কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ প্রতিটি শাখায় উনবিংশ শতকে বাংলা সাহিতের বিকাশ ঘটেছিল।
বাংলা কাব্যে যুগান্তর আনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কবি তার চিন্তাভাবনা ও ছন্দের জগতে তিনি এক বিপ্লব আনেন। তিনি বাংলায় সূত্রপাত কালে এক নতুন ছন্দ রীতির যার নাম ‘অমিত্রাক্ষর’। নতুন আঙ্গিকে তিনি লিখনের একের পর এক মহাকাব্য এর মধ্যে “মেঘনাথ বধ” তার খুবই প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব নিদর্শন। এখানে রাবণ কে চিহ্নিত করেছেন এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণে। এখানে রাম লক্ষণ নয় বরং রাবণ মেঘনাথই নারক সহনারকে পরিণত হয়েছেন। ‘মেঘনাথ বধ’ ছাড়াও তার রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য গুলি হল ‘ তিলোত্তমা’, সম্ভার, বীরাঙ্গনা কাব্য প্রভৃতি।
![]() |
উনবিংশ শতকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ |
বাংলা সাহিত্যে গীতি কবিতার ঐতিহ্য আগাগোড়াই উজ্জ্বল আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রথম গীতি কবি হলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। প্রেম স্বদেশ অনুরাগ, নি:স্বর্গ প্রকৃতি ছিল তার কাব্যের প্রধান উপকরণ। ‘বন্ধু বিয়োগ’, ‘প্রেম প্রবাহিনী’,‘নি:স্বর্গ সন্দক্ষন’, বঙ্গ সুন্দরীর মধ্যে তার নি:স্বর্গ চেতনা ও কল্পনা শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হল – ‘সারদামঙ্গল’ এখানে কবি সারদাকে কখনো জননী কখনো প্রেয়সী আবার কখনো কন্যা হিসেবে কল্পনা করেছেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী কাব্য সাহিত্যে গীতি কবিতার যে ধারণা সূত্রপাত করেছিলেন তাকে আরো বিকশিত করেছেন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার,অক্ষয় কুমার বড়াল , দেবেন্দ্রনাথ সেন, প্রমুখ গীতি কবি।
উনবিংশ শতকে বাংলা কাব্য সাহিত্যের একচ্ছত্র সম্রাট হলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রেম প্রকৃতি স্বদেশ অনুরাগ আধাত্ত্ব চেতনা শিশু মনস্তত্ব, ইত্যাদি এমন কোন বিষয় নেই। যা তার কাব্য প্রতিভায় ধরা পড়েনি। সন্ধ্যাসঙ্গীত ছবি ও গান ভানুসিংহের পদাবলী, কেড়ি ও কমল প্রকৃতি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তার কবি-সত্ত্বার উন্বেষণ ঘটেছে। কৈশোরের আবেগ ও ভাবপ্রবণতা থেকে মুক্ত হয়ে কবি চেতনা যখন ক্রমশ বাস্তবের সম্মুখীন হয় তখনই রচিত হয়েছিল তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি তথা ‘মানষী’, ‘চিত্র’, ‘সোনার তরী’, প্রভৃতি। কথা ও কাহিনী নৈবেদ্য খেয়া ইত্যাদি কবির উল্লেখযোগ্য কাব্য। প্রাচীন ভারতীর ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ এই কবিতাগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য এ ছাড়া ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমালা’, তার আধাত্ম, চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। বলাকা সুরভী মনুষ্য হলো কবির পরিণত বয়সের ফসল। কবি শেত পর্বের কাব্য গুলির মধ্যে ‘পুনশ্চ’,‘শেষ সপ্তক’, ‘ম্যামলি’,‘সানাক্ট’, ‘জন্মদিনে প্রধান’।
রবীন্দ্র কাব্যের দীপ্তিতে বাংলার কবি সমাজ যখন আনন্দ তখন সে কয়েক জন কবি স্বতন্ত্র বজায় রাখতে সংরক্ষণ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মোহিতলাল মজুমদার যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। মোহিতলালের কবিতায় উপলব্ধির গভীরতা ভাবের মৌলিক তার সঙ্গে আটোসাটো প্রকাশ ভঙ্গির সুসমতন্ত্রের ঘটেছে । আর যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতায় মন সুরদিল নৈরাশ্য পিড়ীত দুঃখ বাদ, ‘অগ্নিবিনা’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’ ইত্যাদি অসংখ্য কবিতার লেখক নজরুল ইসলাম পরিচিতি লাভ করেছিলেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পর্বে বাংলা কাব্য সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারার বিকাশে অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ ও সুবীন্দ্রনাথ দত্ত । জীবনানন্দ দাশের কবিতায় একদিকে যেমন বাংলার প্রকৃতির আশ্চর্য রূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে। তেমনি প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুচেতনা ও স্বদেশ সমাজ চেতনা, ‘বনলতা সেন’, ‘রূপসী বাংলা’, ‘ধূসার পাণ্ডুলিপি’, ‘সাতটি তারার তিমির’ প্রভৃতি তার বিখ্যাত কবিতা। অন্যদিকে সুবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধুনিক জীবনের বিষণ্ণতা ফুটে উঠলেও তার কঠিন অভিধা ঘেষা শব্দচরণের জন্য অনেকের কাছে তার কবিতা দুবোধ্য বলে বিবেচিত হয়।
নাটক
প্রধানত রঙ্গমঞ্চের চাহিদা মেটাতে বাংলা সাহিত্যের নাটকের আবির্ভাব হয়েছিল। প্রথম দিকে নাটকে কোন অভিনবত্য ছিলনা এগুলি ছিল মূলত সংস্কৃত বা ইংরেজি নাটকের অনুবাদ। বাংলা ভাষায় প্রথম স্বার্থক নাটক হল রামনারায়ণ তর্ক রত্নের লেখা কুলিনকূল সর্বস্ব যার মধ্যে ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের অনিষ্ঠ কর ফল তুলে ধরা হয়েছে। ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ এই তিনটি নাটক ও ‘একেই বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এই দুটি প্রহসন রচনা করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাট্য সাহিত্যে নবযুগের সূত্রপাত করেছেন। মধুসূদনের সমসাময়িক ভিন্ন প্রকৃতির একজন কীর্তি নাট্যকার ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। তার প্রথম এবং সবচেয়ে প্রিয় নাটক হল নীলকর সাহেবদের অত্যাচার কে কেন্দ্র করে রচিত ‘নীলদর্পণ’। আর অন্যান্য নাটকের মধ্যে ‘সধবার একাদশী’, ‘নভীন তপসিনী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’, ‘কমলে কামিনী’, প্রভৃতি বিখ্যাত।
মধুসূদন দীনবন্ধুর পর নাট্যকার হিসেবে যাদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য তারা হলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রায় সব ধরনেরই নাটক লিখেছেন। তার রচিত ঐতিহাসিক নাটক গুলির মধ্যে সিরাজউদ্দৌল্লা, মীর কাসিম, ছত্রপতি শিবাজী, আর পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক নাটকের মধ্যে জনা, বিল্ব মঙ্গল ,অভিমুন্য বধ, উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তার জনপ্রিয় পারিবারিক ও সামাজিক নাটক প্রফুল্ল, হাডুনিধি, বলিদান, প্রকৃতিতে বাঙালির নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন ফুটে উঠেছে, দ্বিজেন্দ্রলাল উড়ার খ্যাতি ছিল ঐতিহাসিক ও দেশাত্মবোধক নাটক রচনার জন্য। তার লেখা নাটক গুলির মধ্যে নুরজাহান, মেবারের পতন, চন্দ্রগুপ্ত, শাহজাহান, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ক্ষীরোদ প্রসাদের বিখ্যাত নাটক হল আলমগীর, তবে আরব্য রজনী, কাহিনী অবলম্বনে লেখা তার নিত্য গীত সম্বলিত আলী বাবা, খ্যাতির শীর্ষ আহরণ করেছিল।
উনবিংশ শতকে বাংলা নাটক সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের ও নীতিনাট্য লিখেছিলাম। এ ধরনের নাট্য প্রয়াসের মধ্যে বাল্মিকী প্রতিভা, কর্ণ কুন্তী সংবাদ, গান্ধীর অবদান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার সবচেয়ে অবদান হলো ভাবধর্মনী ও রূপক প্রদান নাটক, এ ধরনের নাটকের মধ্যে রাজা অচলায়তন, ফাল্গুনী, মুক্ত বীর, রঙ করবী, প্রকৃতি বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মনস্তত্ত্ব ধর্মে নাটক লিখেছিলেন রাজা ও রানী, বিসর্জন, মালিনী, এই শ্রেণীর নাটক। সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথ গোঁড়ায় গলদ, বৈকুণ্ঠের খাতা, চিরকুমার, সত্তা মাদক কিন্তু হাস্য রসাত্মক ও প্রহসন ধর্মী নাটকও লিখেছিলেন।
উপন্যাস
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়। দুর্গেশ নন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, চন্দ্রশেখর, প্রভৃতি হল তার ইতিহাস, আশ্রিত রোমান্স ধর্মী উপন্যাস, তার দেশাত্মবোধক উপন্যাসের মধ্যে পড়ে আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী, সীতারাম, এছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ের উপর লেখা তার বৃষ বৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, রজনী, রাধারানী, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাসিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট দক্ষতার এড়িয়ে দিয়েছেন তার লেখা। কিছু শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস হলো বউ ঠাকুরানীর হাট, চোখের বালি, নৌকাডুবি, গোড়া, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, দুই বোন, চার অধ্যায়, ইত্যাদি।
বাংলা উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান অস্মরণীয়। সেকালের গ্রামীন সমাজে সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি তিনি মধ্যবিত্ত ও বৃত্তহীন মানুষদের স্নেহ প্রেম সুখ-দুখ আশা নিরাশার কথা অত্যন্ত ফুটিয়ে তুলেছেন তার উপন্যাস। তারে লেখা শ্রেষ্ঠ কিছু উপন্যাস হলো গৃহদাহ, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, দেনা পাওনা, পল্লী সমাজ, বিন্দুর ছেলে প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
শরৎ পরবর্তী আরো কিছু লেখক যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারসম্ভুর বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু প্রমুখের কথা সাহিত্যে তাদের অবদানের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।