সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিজয় সেনের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
অথবা, বিজয় সেনের কৃতিত্ব আলোচনা করো / বিজয় সেনের কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর।
হেমন্ত সেনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী বিজয় সেন ছিলেন বাংলা সেন বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা এবং সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজা। তার রাজত্বকালের ইতিহাস জানার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সভাকবি উমাপতি ধর রচিত দেওপাড়া প্রশস্তি এবং ৬২ তম রাজত্ব বর্ষের ব্যারাকপুর তাম্র শাসন।
হেমন্ত সেন তার পুত্র বিজয় সেনার জন্য সুনির্দিষ্ট এলাকা রেখে না গেলেও এমন এক পরিবেশ তৈরি করে গিয়েছিলেন যার ওপর ভিত্তি করে বিজয় সেন, সেন বংশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেন (আ:১০৯৫-১১৫৮ খ্রি:) । বিজয় সেন ছিলেন সেন বংশের প্রথম স্বাধীনচেতা শাসক। বিজয় সেন নিজ নামে বিজয়পুর নামক স্থানে সেন রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
বিজয় সেনের বাস্তব বুদ্ধি ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ছিল যথেষ্ট। বাংলায় সেন বংশের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বিশেষ কিছু লাভ না করেও কিভাবে বিজয় সেন একটি শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তুলেছিলাম তা নিয়ে ঐতিহাসিক উপাদান গুলি অনেকাংশেই নিরব। বিজয় সেনের ব্যারাকপুর তাম্র শাসন থেকে জানা যায় যে, তিনি শূর বংশীয় কন্যা, বিলাস দেবীকে বিবাহ করেন এবং এর ফলে বিজয় সেনের রাজনৈতিক সুবিধা হয়। শূর পরিবারের সঙ্গে এই বৈবাহিক বন্ধন রাঢ় অঞ্চলে বিজয় সেনের প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। অনুমান করা হয় যে, পাল শাসক রামপাল এর মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্যের গোলযোগের সুযোগ নিয়ে বিজয় সেন নিজ শক্তি বৃদ্ধি ঘটাতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। উল্লেখ্য আনন্দ ভট্টের বল্লাল চরিত এ উদ্ধৃত একটি কিংবদন্তি অনুসারে বিজয় সেন ছিলেন কলিঙ্গরাজ অনন্ত বর্মন চোর গঙ্গের সখা।
![]() |
বিজয় সেন |
বাংলার প্রায় সমগ্র অংশ বিজয় সেনের অধিকার ভুক্ত হয়েছিল। দেওপাড়া প্রশস্তি অনুসারে বিজয় সেন তার রাজত্বকালের শুরুতেই শাসনরত বর্মন শাসকদের পরাজিত করেন এবং ক্রমান্বয়ে নান্য,বীর,রাঘব,বর্ধন ও গৌড়, কামরূপ ও করিঙ্গের রাজগণকে পরাভূত করেন। এখানে রাঘব ও কলিঙ্গরাজ একই ব্যক্তি। কলিঙ্গরাজ অন্তত বর্মন চোড় গঙ্গেরপুত্র ছিলেন রাঘব। তিনি ছিলেন গঙ্গ বংশীয় রাজা। নান্য মিথিলার কর্নাট বংশীয় নান্য দেবের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়। নান্যকে পরাজিত করে বিজয় সেন মিথিলায় তার রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ঘটাতে পেরেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। বীর ও বর্ধন উভয়েই শিলং রামচরিত্রে উল্লিখিত রামপালের দুই সামন্ত মিত্রের সঙ্গে অভিন্ন। বীর হলেন বিষ্ণুপুরের নিকটস্য জঙ্গলমহলের কোটাটবীর রাজা বীরগুন এবং বার্ধন হলেন কৌশাম্বীর সামন্ত রাজা দ্বোরপবর্ধন ।
ভারতের নাট্যসূত্র টীকার পুষ্পিকায় বলা হয়েছে যে নান্যদেব বঙ্গ ও গৌড়ের শক্তি নাশ করেছিলেন সম্ভবত তিনি পাল রাজা ও বিজয় সেন কে পরাজিত করে পড়ে বিজয় সেনের কাছে পরাজিত হন মিথিলা অঞ্চলে সেন শাসনের স্মৃতি বিজয় সেনের নান্যের ওপর এই সাফল্যকে প্রমাণ করে। বিজয় সেন কর্তৃক পরাজিত গৌড়ের রাজা হলেন পাল বংশীয় মদন পাল। এখানে গৌড় জয় বলতে বরেন্দ্রী জয় কে ধরা হয়ে থাকে।
বিজয় সেনের দেওপাড়া প্রশস্তির ২২ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমী রাজ্যকে জয় করার উদ্দেশ্যে গঙ্গা নদীর প্রবাহ ধরে বিজয় সেনের নৌ বাহিনী অগ্রসর হয়েছিল। বিজয় সেনের পশ্চিম দিকের এই অভিযানের সম্ভাব্য পশ্চিমী রাজ্যগুলি হল মিথিলার কর্ণাট শাসক নান্যদেব, কনৌজ অঞ্চলের গাহরবালরাজ গোবিন্দ চন্দ্র, এবং মগধের একাংশ শাসনকারী পাল রাজ মদন পাল বা গোবিন্দ পাল।
মূল্যায়ন
শুধু সেন বংশ নয়, বাংলার ইতিহাসে বিজয় সেনের কৃতিত্ব স্মরনীয় হয়ে থাকবে। তিনি কেবল বাংলায় সেন শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত রূপ দিয়েছিলেন তাই নয়, এর ভিত্তিকে দৃঢ় ও মজবুত করেছিলেন। তার সাহস ও মনোবল প্রশংসারযোগ্য। বাংলার ইতিহাসে বিজয় সেনের শাসনকাল এক স্মরণীয় অধ্যায়। তিনি শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। দেওপাড়া প্রশস্তির রচয়িতা বিখ্যাত কবি উমাপতিধর এবং খ্যাতনামা শিল্পী শুলপানি তার রাজ্যসভা অলঙ্গৃত করেছিলেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার যথাযথ লিখেছেন যে, সামান্য একজন সামন্ত রাজা থেকে নিজ বুদ্ধি, সাহস, রণকৌশল, ও ব্যক্তিত্বকে ব্যবহার করে বিজয় সেন বাংলায় সার্বভৌম শাসক রুপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যা তার অসামান্য কৃতিত্বকেই প্রমাণ করে।
FAQ (Frequently Asked Questions)
বিজয় সেন শৈব ধর্মের অনুসারী ছিলেন। বিজয় সেনের রাজত্বকাল ছিল আ:১০৯৫-১১৫৮ খ্রি:।বিজয় সেন কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন
বিজয় সেনের রাজত্বকাল কত?