মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য সম্রাট অশোক কতটা দায়ী ছিল

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য সম্রাট অশোক কতটা দায়ী ছিল ।

মৌর্য সম্রাট অশোকের মৃত্যুর ( খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ ) ৪৫ বছর পর আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭ শব্দ নাগাদ প্রথম সর্বভারতীয় আধিপত্যের অধিকারী মৌর্য সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটে। পুরান ও বানভট্টের হর্ষচরিত অনুযায়ী শেষ মৌর্য সম্রাট অশোক বৃহদ্রহের সেনাপতি পুষ্য মিত্র শুঙ্গ কতৃক ক্ষমতার চুক্তি ও হত্যা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ও শুঙ্গ বংশের পতন ঘটায়। সু-বৃহৎ অসীম ক্ষমতাশালী মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনে সম্রাট অশোক কতটা দায়ী ছিল – এনিয়ে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন তত্ত্ব পরিবেশন করেছেন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের এই অবিশ্বাস্য পতনের জন্য ড: হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী, পরবর্তী মৌর্য সাম্রাজ্যের অযোগ্যতার দায়ী করেছেন। রোমিলা থাপারের অনুমান, অশোক পরবর্তী যুগে মৌর্য সাম্রাজ্য ব্যর্থ দ্বিধা বিভক্তি হয়েছিল। এদের মতে মৌর্য সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা অশোকের মত দক্ষ প্রশাসকের কিন্তু তা পাওয়া যায়নি।
Ashoka
সম্রাট অশোক
অন্যদিকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য সম্রাট অশোকের দায়িত্ব কম নয়। অশোকের ধম্ম নীতি কয়েকটি অনুশাসন বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক তার এবং তার উত্তরাধিকারীদের জৈনদের প্রতি ঝোঁক ব্রাহ্মণদের সাথে প্রতিকূল হওয়ায় তারা পুষ্যমিত্রের নেতৃত্বে এক রাষ্ট্র বিপ্লব ঘটায় এবং এর ফলেই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। দ্বিতীয় অভিমত অনুযায়ী হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মনে করেন অশোকের অহিংস নীতি বাস্তবে মৌর্য সাম্রাজ্যকে অকার্য করেছিল। 
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, অশোকের মত এক শূদ্র রাজা কতৃক ব্রাহ্মণদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছিল পশু বলিদান নিষিদ্ধ করণের নির্দেশ। তার মতে, ব্রাহ্ম গিরির শিলা অনুশাসনে ভূদেব হিসেবে ব্রাহ্মদের স্বীকৃতি ছিল। অশোক তাকে মিথ্যাপাতপন্ন করেছিল। এছাড়া অশোক কর্তৃক ধর্মমহামাত্র -দের নিয়ম, ব্যবহার সমতা ও দন্ড সমতার প্রয়োগ ব্রাহ্মণদের বিশেষ সুবিধা ভোগের অধিকার কে সংকুচিত করেছিলেন। এ কারণেই সংগঠিত হয় এক ব্রাহ্মণ্যবাদী বিপ্লব যা মৌর্য সাম্রাজ্যকে পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। 
কিন্তু সাম্প্রতিককালীন গবেষণায় পন্ডিত শাস্ত্রীর অভিমতের বিরুদ্ধে গেছে। প্রথমত অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর মতে, অশোকের পশু বলি নিষিদ্ধ শত ব্রাহ্মণদের প্রতি শর্ত নয় কারণ বৈদিক যুগে অনেক ব্রাহ্মণ পশু বলির নিন্দা করেছেন। অশোক নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে পশু বলি বন্ধ করেন। এমনকি খাদ্যের জন্য প্রাণী বধের তার আপত্তি ছিল। দ্বিতীয়ত, মৌর্যদের শূদ্র বংশ যোগ বলাও অযুক্তি অন্যান্য আকার গ্রন্থে মৌর্যদের ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মগিরীর অনু শাসনে “মৃসা” শব্দটির অর্থ পন্ডিত শাস্ত্রী করেছেন মৃথ্যা কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ ছিল মিশ্র বা মিলন। চতুর্থত, ধর্মমহামাত্র -দের নিয়োগ ও ব্রাহ্মণদের স্বার্থে ছিল না কারণ এদের বংশের নির্দিষ্ট দায়িত্বই ছিল ব্রাহ্মণদের অধিকার ও কল্যাণ সুনির্দিষ্ট করা। পঞ্চমত, দন্ড সমতা ও ব্যবহার সমতা প্রয়োগ করে অশোক বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে রজুকদের ক্ষমতা সংকুচিত করার চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। 
প্রকৃতপক্ষে অশোক ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী ছিলেন এ ধারণা অমূলক। তাঁর লেখ ও অনুশাসনের ব্রাহ্মণদের প্রতি স্বার্থ অনুশাসিত হয়েছে। তবে মগধের শেষ মৌর্য শাসক বৃহদ্রথ ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র হাতে নিহিত হয়েছিলেন। সেই পুষ্পমিত্র ব্রাহ্মণ-ই ছিলেন না। মৌর্যদের প্রধান সেনাপতিও ছিলেন। কোন ‘ব্রাহ্মণ্য বিপ্লব’ ঘটিয়ে তিনি মগধের সিংহাসন গ্রহণ করেন নি। ব্যক্তি স্বার্থে নিজের পদ মর্যাদা অপব্যবহার করেছিলেন মাত্র। 
ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী অশোকের ধম্ম নীতি– কে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক অবলম্বিত শাস্তি ও অহিংসা নামে মৌর্য সেনাবাহিনীকে অকার্য করে দিয়েছিল। অর্থয মৌর্য শাস্তির প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রশাসন ঘটেছিল যুদ্ধ ও আগ্রাসীনীতির সাফল্যের কারণে। সাম্রাজ্যই অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ করতো। এই নীতিতে দ্বিগবিজয় পরিবর্তে ধম্ম বিজয়, ভেরি ঘোষ এর পরিবর্তে ধম্ম ঘোষের পদ সৃষ্টি, বিহার যাত্রা পরিবর্তে ধর্মযাত্রা প্রবর্তিত হওয়ায় প্রবল প্রতাপশালী মৌর্য বাহিনী প্রায় আলস্যের দিন কাটিয়ে ছিল। 
ড. নীলকন্ঠ শাস্ত্রী অবশ্যই এই মত সমর্থন করেননি। কারণ যুদ্ধে সদা ব্যস্ত থাকলেই কোন দেশ অর্পণ শক্তি সামর্থ অটুট রাখতে পারবে তা বলা যায় না। ‌ রোমিলা থাপার জানিয়েছেন যে, অশোক তার সামরিকভাবে কোন বিশৃঙ্খলা আশ্রয় দেননি। সীমান্তে প্রতি তার সজ্জন দৃষ্টি ছিল। তিনি অহিংস নীতি নিলেও তিনি যুদ্ধ বর্জন করেননি বা প্রাণদণ্ড লেপ করেননি। ঐতিহাসিক ব্যাসাম জানিয়েছেন কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভর্ষ তার অনুতপ্ত হলেও পরাজিত রাজাকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দেননি। কবিতা পক্ষে তিনি তার অর্জিত রাজ্য কে স্থায়ীত্ব দিতে চেয়েছিলেন। এবং যুদ্ধ নীতি বর্জন করেছিলেন তা অপ্রয়োজনীয় বলে। 
ডি.ডি কৌশাম্বী মৌর্য আমলে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অশোকের দায়িত্ব প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এই সময় Punch Marked Coin – এ খাদের পরিমাণ বেশি থাকা এবং অভিনেতা ও গণিকাদের ওপর অত্যাধিক কড়ারত অর্থনৈতিক ক্ষয়ের প্রধান লক্ষণ। ড. রায় চৌধুরী মতে অশোকের দানশীলতা ও ধর্ম প্রচারের জন্য অত্যাধিক ব্যয় মৌর্য সাম্রাজ্যের ছাপ সৃষ্টি করেছিলেন। ঐতিহাসিক কৌশাম্বী যুক্তি অতি দুর্বল প্রথমত, তিনি যেগুলি মৌর্যত্তোর পর্বে মুদ্রা বলে সনাক্ত বলেছিল তার তারিখ নিয়ে সংশয় আছে। দ্বিতীয়ত, মাত্রাতিরিক্ত করের জন্য যে তথ্য দিয়েছিল তারও উপযুক্ত প্রমাণ নেই। তবে মৌর্য অর্থনীতি যে শেষ দিকে সংকটের পড়েছিল তার রোমিলা থাপার ও স্বীকার করেন। রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক হওয়ায় অশোকের পর্বে আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা বিলুপ্ত প্রক্রিয়া অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। তবে কৌশাম্বী, হস্তিনাপুর, শিশুপালবাদ, প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য নগরায়ন পক্ষে থাকায় অর্থনৈতিক বুনিয়াদ যে একেবারে ভেঙে পড়েছিল তা ভাবা ঠিক নয়।
প্রকৃতপক্ষে মৌর্য শাসন ব্যবস্থা ছিল মাত্রাতিরিক্ত কেন্দ্র নির্ভর ও আমলাতান্ত্রিক। আমল আরা সকলে সম্রাটের ওপর নির্ভর করতেন ব্যক্তিগতভাবে তারা রাজার আনুগত্য থাকাই শাসক অক্ষম বা দুর্বল হলে রাজা আনুগত্যের চির ঘটতো। এছাড়া রাজকর্মচারী নিয়োগ নির্দিষ্ট কোন নিয়ম না থাকায়। রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্রমশ আমলাদের হাতে চলে গিয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক অপশাসন ও উৎপৃরন মৌর্য রাজ্য প্রজার উৎপত্তি বৃদ্ধি ঘটায়। রাজ্য পরিবার কুলদের শাসনের পর সাম্রাজ্যের বিভাজন এবং একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকা শাসন শ্রেণীর সঙ্গে সেনা নায়ক বিচ্ছিন্ন থাকায় তার পতন ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

মূল্যায়নঃ

তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার করে বলা যায় যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোক কতটা দায়ী ছিল – এনিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও অশোকের ধম্ম নীতি, ব্রাহ্মণ্য বিপ্লব এবং অহিংস নীতি মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনকে তরান্তরিত করেছিল। তাই বলা যায়, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য সম্রাট অশোকের দায়িত্ব কম নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *