সুয়েজ সংকটে ভারতের ভূমিকা

সুয়েজ সংকটে ভারতের ভূমিকা।

১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল চালু হওয়ার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ও ভৌগোলিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়, বিংশ শতকে তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং আরব ইজরায়েল দ্বন্দ্ব শুরু হলে মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত মধ্য প্রাচ্যে ব্রিটিশ প্রাধান্য থাকলেও যুদ্ধান্তে গ্রেট ব্রিটেন মধ্য প্রাচ্য থেকে সরে আসে, ফলে একটা শূন্যস্থান তৈরী হয়।

প্রথমদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে অগ্রহী না হলেও পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সোভিয়েত আগ্রাসনের আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। ভৌগোলিক এবং কৌশলগত কারণে ইওরোপের পরেই মধ্যপ্রাচ্যের স্থান নির্ধারিত হয়েছিল এবং আমেরিকা ইজরায়েলের সমর্থনে ভূমধ্যসাগরে ষষ্ঠ নৌবহর প্রেরণ করে এবং টুম্যান প্রশাসন ইজরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। পশ্চিমী জোট মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য গড়ে তোলে সেনটো নামক শক্তিজোট। শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির খেলা।
প্রায় সমসাময়িক কালে নাসেরের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী মিশরের উত্থান পরিস্থিতিকে জটীল করে তোলে। আরব ঐক্যের প্রতীক নাসের সুয়েজ খাল সংলগ্ন এলাকার উপর মিশরের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। ইউনিভার্সাল মেরিটাইম ক্যানাল কোম্পানী সুয়েজ খালের মধ্যে দিয়ে সমগ্র বিশ্বের জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল কিন্তু নাসের সুয়েজ খালকে মিশরের অংশ হিসাবে ঘোষণা করায় ঐ প্রণালী দিয়ে স্বাধীন জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। যার ফলে, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ভীষন রকম চিন্তিত হয়ে পড়ে। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স মনে করেছিল যে নাসেরের আগ্রাসী কার্যকলাপ উপনিবেশগুলির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং এই আশঙ্কায় ঐ দুই দেশ নাসেরের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে। তেল পরিবহনের জন্য ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সুয়েজ খালের উপর নিয়ন্ত্রন বজায় রাখতে চেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ইজিপ্টের প্রতি সহানুভূতিশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্যপ্রার্থী নাসেরকে অস্ত্র সরবরাহ না করতে চাইলেও অর্থ সাহায্য দিতে চেয়েছিল নাসের প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ানের কাছে অস্ত্রসাহায্য চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি মত মিশরের আসোয়ান বাঁধের জন্য অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়। নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিলে সুয়েজ সংকট  ঘণীভূত হয়ে ওঠে।
Suez Crisis
Suez Crisis
১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ ও ফরাসী বাহিনী সুয়েজ খালের উপর অধিকার স্থাপন করার চেষ্টা করে, ইজরায়েলও সামরিক বাহিনী পাঠায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপে রাজী ছিল না, তারা অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করতে চেয়েছিল। আমেরিকার চাপে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয় এবং পশ্চিমী জোটের মধ্যে মতদ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। এর ফলে আরব দুনিয়ায় নাসেরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং রাশিয়া সুযোগ বুঝে আরব অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৫৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার ডকট্রিন (Eisenhower Doctrine) ঘোষণা করে বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যে কোন প্রান্তে রাজনৈতিক বিপদের মোকাবিলা করবে। মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণপন্থী দেশগুলি, যেমন, লেবানন, জর্ডন এবং সৌদি আরব স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য আইজেনহাওয়ার ডকট্রিনকে সমর্থন জানায়। অন্যদিকে নাসেরের সহযোগিতায় সোভিয়েত রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ঠান্ডা যুদ্ধ ‘র প্রভাবধীন হয়ে পড়ে।
সুয়েজ সংকটের সমাধানে ভারতের ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।  ভারত একদিকে সুয়েজ খাল খোলা রেখে বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে চেয়েছিল, অন্যদিকে মিশরের উপর বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের সামরিক ও কূটনৈতিক ক্রমাগত চাপকে বন্ধ করতে চেয়েছিল। ভারত স্বীকার করে নেয় যে ক্যানেল কোম্পানীর জাতীয়করণের অধিকার মিশরের রয়েছে কিন্তু জাতীয়করণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে। প্রথম থেকেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স মিশরের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক শাস্তি গ্রহণের দাবি জানাতে থাকে এবং সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
১৯৫৬ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনে সমস্যা সমাধানের জন্য দুটি বৈঠক হয় যেখানে ভারত সুয়েজ খালের স্বাভাবিক ব্যবহার অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে যুক্তি দেয় কিন্তু সেইসাথে মিশরের পক্ষ অবলম্বন করে। এই বৈঠক দুটিতে মিশরের কোন প্রতিনিধি না থাকায় ভারতের প্রতিনিধি কৃষ্ণমেনন লন্ডন সম্মেলনের সদস্য এবং কায়রো (মিশরের রাজধানী) সরকারের মধ্যে সংযোগকারী বা মধ্যস্থের ভূমিকা নেন। মেনন সম্মেলনে জানান একদিকে যেমন পশ্চিমী শক্তিবর্গ ও অন্যান্য খাল ব্যবহারকারী রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করার জন্য মিশরের দিক থেকে কিছু ঘোষণার প্রয়োজন আছে, তেমনই সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীকে জাতীয়করণ এবং তার নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে মিশরের স্বাধীনতা প্রাপ্য কারণ তা মিশরের সার্বভৌমত্বের আওতাধীন। মেনন কার্যত স্বীকার করে নেন যে মিশরই পারে অন্য রাষ্ট্রকে স্বাধীনভাবে সুয়েজ খাল ব্যবহারের অনুমতি দিতে। সুতরাং শান্তিপূর্ণভাবে মিশরের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করাই শ্রেয়।
এই সম্মেলনে মেনন পাঁচ দফা পরিকল্পনা উত্থাপন করেছিলেন, ১) খাল ব্যবহারকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি পরামর্শদাতা কমিটি গঠন যারা উপদেশ দেবে ও সংযোগ স্থাপন করবে, ২) খাল ব্যবহার সংক্রান্ত ১৮৮৮ সালের কনভেনশনকে সংশোধন করতে হবে, ৩) মিশরকে খাল রক্ষা ও সংস্কার সম্প্রসারণের দায়িত্ব প্রদান, ৪) মিশর ও খাল ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিভেদ হলে মধ্যস্থতার মাধ্যমে তা সমাধান, ৫) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সঙ্গে সুয়েজ খাল জনিত বিষয়টিকে সম্পর্কিত করা। ভারতের এই পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য একটি বিকল্প ছিল কিন্তু পশ্চিমী শক্তিবর্গ তা না মেনে লন্ডন সম্মেলনে অন্য একটি প্রস্তাব পাশ করে। এতে বলা হয় ১) ১৮৮৮ সালের কনভেনশন অনুযায়ী একটি সুয়েজ ক্যানেল বোর্ড গঠিত হবে যা খালের তত্ত্বাবধান করবে, ২) খালের উপর মিশরের সার্বভৌমত্ব নামেমাত্র স্বীকৃত হবে এবং ৩) খালের পরিচালনা থেকে যা লাভ হবে তার ন্যায্য অংশ মিশর পাবে। বলা বাহুল্য মিশর এই প্রস্তাব মানেনি।
ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মিশর এই বিবাদকে ২৩শে সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যায়, ১৩ই অক্টোবর ভবিষ্যত আলাপ আলোচনার ভিত্তি হিসাবে ছয় দফা পরিকল্পনার কথা তিনটি রাষ্ট্র মিলে ঘোষণা করে যাতে ভারতের প্রস্তাবগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিবাদের নিষ্পত্তি হয়নি কারণ ২৯শে অক্টোবর ইজরায়েল মিশর আক্রমণ করে এবং ৩১ শে অক্টোবর ব্রিটেন ও ফ্রান্সও মিশর আক্রমণে ইজরায়েলের সঙ্গে যোগ দেয়। ভারত ও সমগ্র আফ্রো-এশিয় জগত এই আক্রমণের নিন্দা করে এবং মিশরকে কূটনৈতিক সমর্থন জানায়। কলম্বোয় অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীদের সম্মেলনে বিবৃতি দিয়ে মিশরের উপর আক্রমণকে নিন্দা করা হয়।
২৯ শে অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে মিশর থেকে সৈন্য অপসারণের প্রস্তাব দেয় কিন্তু ব্রিটেন’ ও ফ্রান্স এই প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে। পরে সাধারণ সভার জরুরী অধিবেশনে ভারত ও সদ্যস্বাধীন দেশগুলি, সোভিয়েত ইউনিয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একযোগে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করে। সাধারণ সভা মার্কিন ও সোভিয়েত মদতপুষ্ঠ প্রস্তাব পাশ করলে ৫ই নভেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয় যা কার্যকর করার জন্য এবং মিশর দখলদারি সৈন্যদের অপসারণের জন্য আলাপ আলেচনা শুরু হয়। ভারত এই আলাপ আলোচনায় অংশ নেয় যদিও মধ্যস্থের ভূমিকায় ছিল কানাডা।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা চলে যে, সুয়েজ সংকটে ভারত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

Faq:

সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন কে?

সুয়েজ খাল গামাল আবদেল নাসের জাতীয়করণ করেন।

সুয়েজ সংকট সমাধানের জন্য কোন ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রী লন্ডন সম্মেলনে যোগ দেন

সুয়েজ সংকট সমাধানের জন্য ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রী কৃষ্ণমেনন লন্ডন সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *