ভারতে ‘সীমান্ত পার সন্ত্রাস’ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।
ভূমিকা
ভারতে সীমান্ত পার সন্ত্রাস সাধারণভাবে জম্মু-কাশ্মীর, মুম্বাই, উত্তরপূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য এবং মধ্য ভারত সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপের মূল জায়গা যদিও তাদের আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে প্রায় সমগ্র ভারতকেই। ২০০৬ সালের হিসাবানুযায়ী ভারতের ২৩২ টি জেলায় সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ভারতে সীমান্ত পার সন্ত্রাস
পশ্চিম ভারতে সব থেকে বেশি আক্রান্ত মুম্বাই ২০০৮’র ২৬ থেকে ২৯ শে নভেম্বরের ভয়াবহ স্মৃতির ঘা এখনও শোকাইনি। প্রত্যক্ষ এবং ধারাবহিক সন্ত্রাসবাদী এই আক্রমণে অন্তত ১৭২ জন মারা যায়, যার মধ্যে হেমন্ত কারকারের মত এ টি এস প্রধান এবং সদিপ উন্নিকৃষ্ণনের মত মেজরও ছিলেন। এন এস জি কম্যান্ডো, জলবাহিনীর সেনা এবং মুম্বাই পুলিশের তিনদিনের অক্লান্ত চেষ্টায় (অপারেশন টর্নেডোর মাধ্যমে) তাজ ও ট্রাইডেন্ট হোটেল, নরিম্যান পয়েন্টের মত স্থানগুলি উগ্রপন্থীদের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল শতাধিক স্বদেশি এবং বিদেশির প্রাণের বিনিময়ে। এই ঘটনা ভারত-পাক সম্পর্ককে নঞর্থকভাবে প্রভাবিত করে এবং ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে কূটনৈতিক চরমপত্র ‘ডিমার্শ” পাঠানো হয়। পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ প্রায় সকল দেশ কূটনৈতিক চাপ দিতে থাকে।
![]() |
Mumbai Taj hotel attack |
সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ মুম্বাইএ অবশ্য নতুন কোন ঘটনা নয় এর আগেও মুম্বাই মারাত্মক আক্রমণের – শিকার হয়েছে ১২ই মার্চ ১৯৯৩ ১৩টি বোমা বিস্ফোরণে মারা যান ২৫৭ জন, 2002’র ৬ই ডিসেম্বর, ২০০৩ সালের ২৭ শে জানুয়ারী, ১৪ই মার্চ, ২৮ শে জুলাই নানা স্থানে বোমা বিস্ফোরণ হয়, ঐ বছরেই গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া এবং জাভেরি বাজারে গারী বোমা বিস্ফোরণে মারা যান অন্ততপক্ষে ৫০ জন। ২০০৬ সালের ১১ই জুলাই মুম্বাই শহরতলীর নানা স্থানে ট্রেনের মধ্যে বিস্ফোরণে মারা যান ২০৯ জন সাধারণ মানুষ। প্রতিবার ঘটনার আকস্মিকতা এবং বিহ্বলতা কাটিয়ে মুম্বাই জেগে ওঠে নতুন প্রাণের সন্ধানে তৈরী হয় সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে নতুন করে লড়াইয়ের জন্য।
সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের লীলাস্থল জম্মু-কাশ্মীর। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর থেকে উগ্রপন্থীদের পক্ষে এখানে কাজ চালানোও সহজ হয়। সামরিক বাহিনীর গাড়ি ও ছাউনি, পর্যটকদের বাস, হোটেল, দর্শনীয় স্থান সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের নিশানা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার ফলে একদা পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ কাশ্মীর এখন সেখানকার সাধারণ মানুষদের কাছেই বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার মানুষ কাশ্মীরে হিংসার বলি হয়েছেন।
বিহারের বিষয়টি একটু আলাদা- এখানে উগ্রপন্থী কার্যকলাপের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল জাতিগত বিদ্বেষজনিত পারস্পরিক আক্রমণ এবং গণহত্যামূলক কার্যকলাপ যা মূলত পরিচালিত হয় সি পি আই – এম এল, পিপলস ওয়ার গ্রুপ, এম সি সি, রনবীর সেনা, বলবির মিলিট্যান্টস দ্বারা। উচ্চ বর্ণের মানুষদের জমির উপর একচেটিয়া স্বত্ব এবং তা ধরে রাখার জন্য রনবীর সেনা নামক সশস্ত্র বাহিনী গঠন এবং অন্যদিকে স পি আই এম এল, পিপলস ওয়ার গ্রুপ প্রভৃতি সংগঠন দ্বারা উচ্চবর্ণের শোষণের বিরুদ্ধে আগ্রাসী কার্যকলাপ এই দুইয়ের মাঝে বিহারের জনজীবনে কিছুদিন আগে পর্যন্ত আতষ্কের পরিবেশ তৈরী হয়েছিল। অধুনা হিংসাত্মক উগ্রপন্থী কার্যকলাপ একটু হলেও হ্রাস পেয়েছে।
পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদ এর প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৮০’র দশকে যখন জার্নাল সিং ভিন্দ্রেনওয়ালার নেতৃত্বে শিখ সম্প্রদায়ের একাংশ পৃথক খালিস্তান দাবি করে ভারত থেকে পৃথক হতে সচেষ্ট হয়েছিল (ভিল্ড্রেনওয়ালা ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য খালিস্তান গঠনের পক্ষপাতি ছিলেন না কিন্তু আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য তিনি সন্ত্রাসকে অস্ত্র করেছিলেন)। অবশেষে ১৯৮৪ সালে শিখদের এই আন্দোলন দমনের জন্য ভারতীয় সেনাবহিনী অপারেশন ব্লু স্টার পরিচালনা করে এবং প্রায় ৭৪ ঘণ্টা লড়াইএর পর শিখ উগ্রপন্থীদের আশ্রয়স্থল অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের উপর অধিকার স্থাপন করে। এই সংঘর্ষের ফলে মন্দিরের কিছু অংশ এবং অকাল তখত বা গ্রন্থাগারের ক্ষতি হয়, ৮৩ জন সেনা আধিকারিক এবং ৪৯৩ জন উগ্রপন্থী মারা যান। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঐ বছরেই ৩১ শে অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে তার দুই শিখ দেহরক্ষী গুলি করে হত্যা করেন ভারত জুড়ে শিখ বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়।
পরবর্তীকালে ১৯৮৫ সালে শিখ সন্ত্রাসবাদীরা কানাডা থেকে ভারতে চলাচলকারী বিমান এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ (এম্পারার কণিষ্ক) তে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এই ঘটনায় ৩২৯ জন্য মারা যান। বাধ্য হয়ে শিখ সন্ত্রাসবাদকে দমন করার জন্য ১৯৮৮ সালে পাঞ্জাব পুলিশ প্রথমে জুলিও রোবেইরো এবং পরে কে পি এস গিলের নেতৃত্বে অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার পরিচালিত করে। পরে বেনেজির ভুট্টো ভারত সরকারের হাতে পাঞ্জাব সন্ত্রাসের যাবতীয় নথি তুলে দেন এবং তাকে কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাবের সন্ত্রাসকে ৯০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হয়।
রাজধানী দিল্লী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের শিকার হয়েছে। ২০০৫’র ২৯শে অক্টোবর বোমা বিস্ফোরণে মারা যান ৬০ জন, আহত ২০০, ২০০৮’র ১৩ ই সেপ্টেম্বর পুনরায় দিল্লীতে বোমা বিস্ফোরণ হয়। তবে রাজধানীর বুকে সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণটি ঘটে ২০০১’র ১৩ই ডিসেম্বর যখন খোদ সংসদ ভবন বা পার্লামেন্ট আক্রান্ত হয়। ৪৫ মিনিট ধরে গুলির লড়াই চলার পর পাঁচজন সন্ত্রাসবাদী এবং ১ জন নিরাপত্তাকর্মী মারা যান। এই ঘটনার ফলে ঐ দিনের মত পার্লামেন্টের দুই কক্ষের সভা মুলতুবি রাখা হয়।
ধর্মীয় উপাসনাস্থলগুলি বহু ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা এবং বারাণাসী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০০৫ সালের ৫ই জুলাই অযোধ্যার বাবরি মসজিদ স্থল আক্রান্ত হয় লস্কর-ই-তৈবার সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে দু ঘন্টা গুলির লড়াই চলার পর ৬ জন সন্ত্রাসবাদী মারা যান। দেশের সব রাজনৈতিক দল এই ঘটনার নিন্দা করে এবং পরদিন দেশব্যাপী বন্ধ পালিত হয়। অন্যদিকে বারাণসী সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের সামনে পড়ে ২০০৬’র ৭ ই মার্চ। ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে ১৫ জন মারা যান এবং শতাধিক আহত হন। এই আক্রমণের দায়ভার কেউ গ্রহণ না করলেও এপ্রিল মাসে পুলিশ ৬ জনকে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে গ্রেফতার করে যার মধ্যে একজন ছিলেন পাকিস্তানি গুপ্তচর বিভাগ (ইন্টার- সার্ভিস- ইন্টালিজেন্স) এর সঙ্গে যুক্ত।
উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি যেমন আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ডও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের স্বাক্ষী। এই রাজ্যগুলিতে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায় এবং অন্যান্যদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা, জীবনযাত্রার খারাপ মান ইত্যাদি কারণে উক্ত রাজ্যগুলিতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, বিশেষত, আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও ত্রিপুরাতে। নাগাল্যান্ডে ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড-ইসাক মুইভা পৃথক নাগাল্যান্ডের দাবিতে ঐ অঞ্চলের সামরিক ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ চালায়, ১৯৯২ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এদের আক্রমণে ৫৯৯ জন নাগরিক, ২৩৫ জন নিরাপত্তাকর্মী ৮৬২জন সন্ত্রাসবাদী মারা যান- অবশেষে ২০০১ সালের ১৪ই জুন সরকার এবং ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড-ইসাক-মুইভার মধ্যে যুদ্ধ বিরতি স্বাক্ষরিত হয় -নাগা ন্যাশানাল কাউন্সিল ফেডেরাল এবং নাগাল্যান্ড কাউন্সিল ওফ নাগাল্যান্ড-খাপলা’র মত সন্ত্রাসবাদী গোষ্টীগুলিও এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানায়।
আসামে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ প্রথম পর্বে শুরু হয় পৃথক বোরোল্যান্ডের দাবীতে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পৃথক সমাজতান্ত্রিক আসাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাদের কার্যকলাপ শুরু করে। ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার বাধ্য হয়ে উলফা (আলফা) কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং আসামকে উপদ্রুত এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করে। আসামে আলফা পরিচালিত সন্ত্রাসবাদ এখনও জারি রয়েছে। ২০০৪ সালে আলফা একটি রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ে হানা দিয়ে ১৯ টি শিশুকে হত্যা করে। মণিপুরে পিপলস লিবারেশন আর্মি নামক উগ্রপন্থী সংগঠন মৈতৈ উপজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পৃথক ও স্বাধীন মণিপুরের দাবিতে নানান হিংসাত্মক কাজ চালায়, ৯০’র দশকের মাঝামাঝি ভারতীয় সেনাবাহিনী কঠোর হাতে এই সংগঠনকে নিয়ন্ত্রনে আনে। অধুনা কাঙ্গলেই ইয়াফুল কান্না লুপ নামক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন মনিপুরে সক্রিয় ২০০৫’র সেপ্টেম্বরে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এরা ইস্পফলের কাছে ১৪ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি যেমন অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাডুও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের এভিয়ারে চলে এসেছে। ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটইটিউট অফ সায়েন্সে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্ত্রাসবাদীরা হানা দেয় এবং ২০০৮’র ২৬ শে জুলাই ব্যাঙ্গালোর শহরে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণ হয়। অন্ধ্র প্রদেশের তেলেঙ্গানা অঞ্চলে পিপলস্ ওয়ার গ্রুপ বেশ সক্রিয় পুলিশ, উচ্চপদস্থ সরকারী আধিকারিক এবং মন্ত্রীরা এদের আক্রমণের শিকার। অন্ধর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু একবার অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছিলেন যখন তার কনভয় আক্রান্ত হয়েছিল। তামিলনাড়ুতে আবার সক্রিয় এল টি টি ই (লিবারেশন টাইগারস অফ তামিল ইলম) ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী তাদের হাতেই আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে ১৯৯১ সালে শ্রীপেরেমবুদুরে মারা যান।
মূল্যায়ন
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে প্রায় সমগ্র ভারত জুড়েই ভারতে সীমান্ত পার সন্ত্রাস যথেষ্ট সক্রিয় । আত্মঘাতী হামলা, রিমোটের সাহায্যে দূর থেকে বা আড়াল থেকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি এবং সম্পত্তিহানি ঘটানোর সাবেক রীতি পরিত্যাগ করে অধুনা সন্ত্রাসবাদীরা মুম্বাই’র ২৬/১১ প্যাটার্নে প্রত্যক্ষ এবং সরাসরি আঘাতের পদ্ধতি অবলম্বন করছে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সন্ত্রাসবাদীরা আরও বলীয়ান হয়ে উঠেছে।