ভারতীয় শিল্পকলায় নন্দলাল বসুর অবদান

 

ভারতীয় শিল্পকলায় নন্দলাল বসুর অবদান।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকগুলিতে ভারতীয় শিল্পী সমাজ যখন পশ্চিমী শিল্প আন্দোলনের জোয়ারে প্রায় দিশাহীন, সেইসময় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত নন্দলাল বসুর আবির্ভাব ঘটে। ১৮৮২ সালে খড়গপুরে নন্দলালের জন্ম।গ্রামে কুমোরদের পুতুল তৈরির দৃশ্য তাঁকে যথেষ্ট, প্রভাবিত করে। সম্ভবত তাঁর শিল্পী জীবনের সূত্রপাত সেখান থেকেই। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি কলকাতায় এসে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে শিক্ষা সমাপ্ত না করেই তিনি শিল্পী হওয়ার ব্রত গ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে নন্দলাল বসু কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯১১ সালে সেখানকার শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। শিল্পী অতুল মিত্রের কাছে তিনি ড্রয়িং ও পেইন্টিংয়ের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই শিক্ষাপর্বই ছিল তাঁর শিল্পীজীবনের পশ্চাদভূমি।

ভারতীয় শিল্পের জনক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নন্দলাল বসু। তাঁর শিল্পীজীবনকে মোটামুটি চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম জীবনে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসে নন্দলাল প্রভাবিত হন এবং গভীরভাবে চিত্রাঙ্কনে মনোনিবেশ করেন।এটিই তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম অধ্যায় বলে মনে করা হয়। এরপর শিলাইদহ হয়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এলে তাঁর শিল্পীজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। পরবর্তীকালে শিল্পাচার্য হিসেবে শান্তিনিকেতনের কার্যভার গ্রহণ করার পর শুরু হয় তাঁর জীবনের তৃতীয় অধ্যায়।

নন্দলাল বসুর জীবনের প্রথমপর্বের ছবিগুলির মধ্যে ‘গরুড়স্তম্ভের পাদমূলে শ্রীচৈতন্য’, ‘সতী’, ‘অহল্যার শাপমুক্তি’, ‘জগাই-মাধাই’, ‘জতুগৃহদাহ’, ‘শিব’, ‘শিবের বিষপান’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠির’ ইত্যাদিতে অবনীন্দ্ররীতির পূর্ণ প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। মূলত রেখাধর্মী এই ছবিগুলিতে স্বদেশিয়ানা তথা ভারতীয় শিল্প-প্রকরণের পরম্পরা দৃশ্যমান। ১৯০৯ সালে বিরেকান্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতার উৎসাহে তিনি অজন্তা, বাগগুহা ইত্যাদি ঘুরে এসে সেখানের চিত্রাবলীর উপর একটি মূল্যবান অ্যালবাম রচনা করেন।

১৯০৯ সালেই নন্দলাল রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে আসেন ‘চয়নিকা’ অলঙ্করণের সূত্র ধরে। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে এসে কাজ শুরু করেন। ১৯২০ সালে তিনি পাকাপাকিভাবে শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেন। এতদিন তাঁর চিত্রকর্মে পুরাণ ও ধর্মীয়তার ছোপ থাকলেও শান্তিনিকেতনে আসার পর তিনি খুঁজে পান মানুষ ও প্রকৃতির অন্তহীন ছন্দবদ্ধরূপ।

 ১৯২৩ সালে অসিত হালদারের কর্মস্থল স্থানান্তরিত হলে নন্দলাল বসু কলাভবনের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯২৩-৫১ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। এই কাজের পাশাপাশি সৃজনশীলতা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও মৌলিক রচনার উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরির জন্য তিনি দেহ-মন নিয়োজিত করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রভাবান্বিত হয়ে তিনি বিশ্বশিল্পের মূল ধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। চিন, জাপান, মিশর ইত্যাদি দেশের শিল্প পরম্পরার মূল স্রোতে অবগাহন করে ভারতীয়তাকে তুলে ধরেন স্বদেশ ও বিদেশের মাটিতে। নন্দলাল বসু একদিকে যেমন রেখানির্ভর রূপ নির্মাণে ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন, তেমনি বর্ণ প্রয়োগেও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য রীতিকে সংযোজিত করার পরামর্শ দিতেন।

পরিণত বয়সে নন্দলাল বসু নতুন আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ হলে ভারতীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে গুরু অবনীন্দ্রনাথের অপূর্ণ কাজ অনেকটাই সম্পূর্ণ করেন। একাধিক মাধ্যমে ও রীতিতে তিনি কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। জলরঙে ‘ওয়াশ’ ও ‘গুয়াশ’—উভয় পদ্ধতিতেই তাঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এছাড়া ফ্রেস্কো, টেম্পারা, উডকাট, লিথোগ্রাফিতে তাঁরযথেষ্ট দখল ছিল। তবে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে তিনি খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। শিক্ষক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি কম ছিল না। তাঁর অজস্র ছাত্রের মধ্যে হীরাচাঁদ দুর্গার, ধীরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মন, বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, শ্রীমতি রেণুকা কর, শঙ্খ চৌধুরি, কে. জি. সুব্রহ্মণ্যয়ম, রামকিংকর বেজ, রামানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান ‘অঙ্কার’ প্রাপক সত্যজিৎ রায়ও একসময় তাঁর ছাত্র ছিলেন।

নন্দলাল বসুর উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের মধ্যে পূর্বে উল্লেখিত চিত্রগুলি বাদে ‘সাঁওতালী মেয়ে’, ‘সন্ধ্যারতি’, ‘হলকর্ষণ’, ‘কৈকেয়ী-মন্থরা’, ‘নটীরপূজা’, ‘ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী’, ‘ঝড়ের রাত’, ‘অভিসারিকা’ইত্যাদি বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথের একাধিক বইয়ের অলঙ্করণের কাজ তিনি করেছিলেন, যার মধ্যে ‘সহজপাঠ’ অত্যন্ত পরিচিত। তাঁর আঁকা স্কেচ ও নক্সাধর্মী কাজের সংখ্যাও নৃত্য, নাটকের একাধিক অনুষ্ঠানে রূপসজ্জা ও সজ্জাবিন্যাসের কাজ করেও তিনি বিদ্যোৎসমাজের প্রশংসা লাভ করেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৬ সালে এই মহান শিল্পীর জীবনাবসান হয়। ভারতীয় তথা বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল বসুর অবদান অনস্বীকার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *